ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

‘পথ চলেছি একা’ একটি অনবদ্য জীবনীসাহিত্য

ড. শাহাজাদা বসুনিয়া

প্রকাশিত : ১২:০৭ পিএম, ৬ মে ২০১৯ সোমবার

আত্মজীবনী গ্রন্থ হচ্ছে সাধারণ মানুষের পঠনপাঠনের অন্যতম আকর্ষণীয় ক্ষেত্র। এ ধরনের গ্রন্থে জীবন পাঠশালার অনেক লোমহর্ষক কাহিনী থাকে যা সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জীবনীগ্রন্থে লেখকরা সাধারণত জীবনের অভিজ্ঞতা অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। ফলে আত্মজীবনী রচনায় লেখকের সন্নিবেশিত রকমারি অভিজ্ঞতাগুলো জীবনদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ধরনের গ্রন্থে যে যে দর্শন  থাকে তা উন্নত জীবনযাপনে পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে, মন্দ দর্শনকে এড়িয়ে চলা, ভালো দর্শনকে ধারণ করে পাঠকগণ এগিয়ে যায় ইস্পিত লক্ষ্যে। মোদ্দা কথা-প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে জীবনীগ্রন্থের লেখকরা তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন একজন শিক্ষকের মতন। তাদের অভিজ্ঞতা মুলতঃ শিক্ষণীয় বিষয় যা জ্ঞান কোষ হিসেবে আখ্যায়িত হয়। জীবনী সাহিত্যে লেখক কোন নীতি বা আদর্শ প্রচার করেন যা নিষ্ঠার সঙ্গে সাহিত্য সাহিত্যক রসবোধের সঙ্গে চিত্রিত করা প্রয়োজন।

                                                এএএম জাকারিয়া মিলন

 

এএএম জাকারিয়া মিলনের ‘পথ চলেছি একা’ বইটি পর্যালোচনা করলে এমনই প্রতীয়মান হয় যে, এ গ্রন্থটি নিছক আত্মপ্রচার নয়, তিনি মানব কল্যাণের জন্য ভবিষ্যতে আত্মজীবনী-সামত্মীজীবনী হয়ে উঠবেন নি:সন্দেহে। এটা স্বীকৃত যে, আমাদের দেশের লেখক-কবিরা আত্মজীবনী লেখার সময় নিজের জীবনের অন্ধকার অধ্যায়গুলো গুপ্ত রাখেন, তাদের লেখা পড়লে মনে হবে তাদের মতো ফেরেস্তা আর হয় না। মনে হবে তাদের কোনও দোষ নেই, তাদের জীবনে কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই, তাদের জীবনে কোনও ঈর্ষা-বিদ্বেষ নেই, তারা শুধুই মহামানব। এ ক্ষেত্রে জাকারিয়া মিলন অত্যন্ত ব্যতিক্রমী। তিনি ব্যক্তি ও কর্মজীবনে ভুল-ত্রুটির বিষয়াবলী সিদ্ধ হস্তে তুলে ধরেন; যাতে পাঠকগণ তার আত্মজীবনীর মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করে একটি পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতে পারেন।

‘পথ চলেছি একা’ গ্রন্থের অবতারণা অত্যন্ত অর্থবহ। জীবন পথে কখনও কখনও সঙ্গী পাওয়া যায় না। তবুও জীবন থেমে থাকে না, স্রোতস্বীনির মতই জীবন ধাবিত হয় জীবনের অভিষ্ট্য লক্ষ্যে। কখনও দল বেধে-কখনও চলতে হয় একাই। পার্থিব জগতে প্রত্যেক মানুষই মুসাফির, তাই জীবন পরিক্রমায় সুন্দর ঘটনাবলি মাঝে-মধ্যে অসুন্দর হতে দেখা যায়। সে জন্য জীবন থেমে যায় না বরং জীবন চলে সম্মুখপানে, জীবন চলে দুর্বিনীত লক্ষ্যে। জাকারিয়া মিলন তার প্রণীত আত্মজীবনী ‘পথ চলেছি একা’ গ্রন্থে ঘটনাবহুল অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। চলার পথে তার আহরিত অভিজ্ঞতা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘কখনও কখনও বড় নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে পরিবেশ-পরিস্থিতি। কখনও কখনও আঁধার নেমে আসে আবার ভোরের আলোয় আঁধার কেটে যায়। আলো আর আঁধারের মতো জীবনের জোয়ার ভাটায় পথিককে চলতে হয়।’ তিনি একটি নিষ্ঠুর সত্যকে তুলে ধরেন, জীবনে চলার পথে কখনও কখনও সঙ্গী পাওয়া যায় না, তাতে পথ চলা থেমে থাকে না। একাই চলতে হয়।

আত্মজীবনী গ্রন্থকে মূলতঃ অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বলা হয়। এ ধরনের গ্রন্থে যে অভিজ্ঞতাগুলো প্রতিফলিত হয় তা জীবন ও সমাজ নির্মাণে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ফলে এ ধরনের গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে আত্মজীবনী লেখককে অবশ্যই সমাজ সচেতন হতে হয়। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধন থেকে বিরত থাকতে হয়। অভিজ্ঞতার বিষয়বস্তু সর্বজনীন ও চিরন্তন হলে পাঠকগণ স্ব-স্ব অবস্থানে তা প্রয়োগ করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধনে সমর্থ হবে। অন্যদিকে, সামাজিক উন্নয়নে সর্বজনীন বিষয়বস্তু চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে। পাঠককে মিথ্যা বিশ্বাসে অভিভূত করার লক্ষে বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হলে সমাজ বিনির্মাণে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ নিস্ফল হবে।

এটা ইতিহাস স্বীকৃত যে, সাহিত্যের প্রাচীনকাল থেকে অদ্যবদি অসংখ্য আত্মজীবনী গ্রন্থ রচিত হয়েছে তন্মধ্যে গুটিকয়েক অন্যতম, বাকি সব জীবনবৃত্তান্তের গ্রন্থ হিসেবে  বিবেচিত। পঠকগণ অতি সহজেই বুঝতে পারেন যে, সাধারণ জীবনী ও আত্মজীবনী গ্রন্থের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সাধারণ জীবনী গ্রন্থের চেয়ে তুলনামূলকভাবে আত্মজীবনী গ্রন্থকে পাঠকরা বেশি পছন্দ করেন। কারণ আত্মজীবনীগ্রন্থ অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার যা মানুষের জন্য চিরকালের জ্ঞানকোষ। আত্মজীবনী গ্রন্থ হচ্ছে শিল্প-সাহিত্যের অন্যতম শাখা। অভিজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম হলো আত্মজীবনী গ্রন্থ। লেখকের জীবনী সাহিত্যে রূপ নেয় তখন, যখন লেখক তার অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষভাবে উত্থাপিত করেন। সংযত চরিত্র ও উদারতার মাধ্যমে সমাজবান্ধব উপজীব্য বিষয়াবলী জীবনী লেখনীতে বিধৃত হওয়া উচিত। সে জন্য হয়তো রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ বাংলা সাহিত্যে একটি শ্রেষ্ট আত্মজীবনী গ্রন্থ। তিনি এ গ্রন্থে আগের জিনিসকে পাছে এবং পাছের জিনিসকে আগে এনে বিষয়াবলী বর্ণনায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিপুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেন। এ ক্ষেত্রে এএএম জাকারিয়া মিলন পিছিয়ে নেই। তার রচিত ‘পথ চলেছি একা’ নি:সন্দেহে আত্মচরিত গ্রন্থ যা পূর্ণাঙ্গভাবে সাহিত্যের আদলে রচিত।

রবীন্দ্রনাথের রচিত ‘জীবনস্মৃতি’ মতই তিনি তুলে ধরেন, ‘মানুষ আজ উপরে তো কাল নিচে। আমাদের কোনও হাত নেই। নিয়তির হাতে বন্দি আমরা। কেতুর নাচের মত নাচছি। তার (খোদার) ইচ্ছায় সব ঘটছে কিন্তু দৃশ্যমান হচ্ছে মঞ্চের কেতুগুলো’। জাকারিয়া মিলন মানব জীবনের উত্থান-পতনকে নাগরদোলার সঙ্গে তুলনা করেন। নাগরদোলা ঘৃর্ণায়মান। স্থায়ীভাবে কেউ উপরে বা নিচে থাকেন না-সময়ের আবর্তনে অবস্থানের পরিবর্তন হয়। তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘আজকের উপরের মানুষটি নিচে এবং নিচের মানুষটিকে উপরে উঠতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই’। চলমান জীবনের আবর্তন ও বিবর্তন এ রকমের, এ যেন চিরন্তন বাণী। চলমান জীবনে অসামঞ্জস্যপূর্ণ-অনাকাঙ্খিত অনেক সূখ-দুঃখের  খণ্ড খণ্ড কাহিনী ‘পথ চলেছি একা’ গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে দারুণভাবে যা অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী এবং অতলস্পর্শী।

উল্লেখ্য যে, এএএম জাকারিয়ার ‘পথ চলেছি একা’ গ্রন্থটি নিছক আত্মকথন নয় বরং জীবন পরিক্রমায় এই গ্রন্থটি অভিজ্ঞতার অমিয়বাণী। ইতোপূর্বে তার লেখা ‘জীবনের পথে’ এবং মিল-অমিলের এই সংসার’ নামক দুটি আত্মজীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যা ছিলো পাঠক সমাদৃত।

‘জীবন পথে’ এই গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন, ‘সবাইকে নিয়েই মানুষ, একা-নিজ-ব্যক্তি এতো সমাজচ্যুতির শামিল। সমাজ মানে হলো সবাইকে নিয়ে, সবাইকে এক ছাতার তলে আনতে পারলে পারিবারিক জীবন সফল হবে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হবে’। সমাজ বিনির্মাণে তার এই মন্তব্য যেন চিরন্তনবাণী। নিজের স্বার্থসিদ্ধি, নিজের কার্পণ্যতা পিছে ফেলে তিনি সমাজ বিনির্মাণে স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্নে বিভোর থাকেন, বেদনার অন্ধকারে ছুঁতে চান নীল আকাশ মানবিক কল্যাণে।

অন্যদিকে তার রচিত ‘মিল-অমিলের এই সংসার’ গ্রন্থটি পাঠকদের নিয়ে যায় গভীর এক দর্শনে। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘জগৎ সংসারে কে কার? এর উত্তর জানা নেই, আজ যাকে আপন মনে হয়, একান্ত নিজের, সময়ের প্রেক্ষাপটে তাকে দেখি ভিন্নরূপে। আপন কে?’

উত্তরে তিনি নিজেই বলেন, ‘আত্মার বন্ধন-মনের মিল, এটাই বড় কথা’। তার ভাষায় মমতা বেরিয়ে আসে, চোখে জল আসে। মানবকল্যাণে তার উচ্চারিত বাণী হচ্ছে-জীবন সংসারে, চলমান জীবনে মিল-অমিল, পছন্দ-অপছন্দ দুটি শব্দ থাকলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মানবকল্যাণে ছাড় দিতে হয়, সমঝোতা করতে হয়। সমঝোতার মধ্যেই গড়ে ওঠে পরিবার-সমাজ-জীবন। সমাজ সংসারে কিছু না কিছু মিল-অমিল পরিলক্ষিত হতে পারে, যা মেনে নিয়ে  জীবন ও সমাজকে সুন্দর করতে হবে; তিনি স্বপ্ন দেখেন একটি সুন্দর পৃথিবীর। তিনি লোভ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন ‘পথ চলেছি একা’ গ্রন্থে।

তিনি উল্লেখ করেন, সুদূরপ্রসারী ফল লাভে বিশ্বাসীর সংখ্যা কম ‘সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের গল্পের নায়কের মতো প্রতিদিন একটি ডিম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার কিংবা অপেক্ষার সেই ধৈর্য আমাদের নেই। সব একত্রে পাওয়ার লোভ আমরা সংবরণ করতে পারি না’। অতীতকে ভুলে যাবার জন্য তিনি সুপারিশ করেন। অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সামনে চলার আহবান করেন, ‘অতীতকে মনে করে লাভ কী? কষ্ট পাওয়া ছাড়া তো কোনও কিছু হবে না। অতীত ঘেঁটে খামোখা সময় নষ্ট না করাই ভালো। অতীতের কথা ভাবে বোকারা। বুদ্ধিমানেরা কেবল বর্তমানের কথাই ভাবেন’।

সাহিত্যের মূখ্য উপাদান হচ্ছে মানবজীবন, সাহিত্যে মানুষের জীবনই রকমারিভবে প্রতিফলিত ও ব্যাখ্যাত হয়। ফলে আত্মজীবনী সাহিত্যে হৃদয়গত উপাদান বিদ্যমান যা সংবেদন জাগায়, বিষয় নির্বাচন এবং রূপ নির্বাচন করে প্রয়োগকৌশলীর মাধ্যমে লেখক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। বিশ্লেষণে বলা বাঞ্চনীয় জাকারিয়া মিলনের ‘পথ চলেছি একা’ গ্রন্থটি আসলে একটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য আত্মজীবনী। লেখক নিজের জীবন ও সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা তুল্যমূল্য করে রসোর্ত্তীন হতে পেরেছেন।

এ গ্রন্থে লেখক ২১টি টাইটেলে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ৫টি বাদে বাকি সব টাইটেলে তার সারা জীবনের খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে, অন্য পাঁচটি টাইটেলে যা তুলে ধরেন তা প্রবন্ধ হয়েছে। আত্মজীবনী গ্রন্থে গল্প বলার ছলে অভিজ্ঞতা সন্নিবেশিত হয়, অন্যদিকে প্রবন্ধ হলো ফ্যাক্টবেসিস।

প্রবন্ধ বলতে আমরা সাধারণত প্রকৃষ্ট বন্ধনকে বুঝে থাকি। এই বন্ধন বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হতে পারে, চিন্তারাশি সুসজ্জাজনিত হতে পারে। মূলত: সংযত যুক্তিশৃঙ্খলা, সুসজ্জা রচনাসৌন্দর্য থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ ভীষণ সার্থক। ফলে, প্রবন্ধ আত্মজীবনী গ্রন্থ থেকে ভিন্ন। এই সামান্য ক্রটি পরিহার করলে ‘পথ চলেছি একা’ একটি সার্থক আত্মজীবনী গ্রন্থ হতো বলে আমার কাছে স্পষ্ট প্রতীয়মান।

একে//