ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

তারকা শিল্পীদের বিদায়ে সঙ্গীতাঙ্গনে শূন্যতা

সোহাগ আশরাফ :

প্রকাশিত : ০১:৫৭ পিএম, ৮ মে ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ০৭:২৮ পিএম, ৮ মে ২০১৯ বুধবার

জীবন মানেই ছন্দময় তরঙ্গের এক অনাবিল সুর। সুরহীন শরীর স্পন্দন পায় না কোন কালে। যে মানুষের মধ্যে স্পন্দন নেই সে এক কথায় মৃত। তাই বেঁচে থাকার অনাবিল সুখ পেতে সঙ্গীতের সঙ্গে মানুষের বসবাস করতেই হয়। এই সঙ্গীত মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মানুষ মাত্রই সঙ্গীত বা গানের জন্য এক ধরণের ভালোবাসা বুকে রাখে। যে ভালোবাসা অসীম-অম্লান।

গানে যখন নিজ জীবনের প্রতিচ্ছবি ভেসে আসে তখন সঙ্গীত হয়ে যায় মানুষের আত্মার স্পন্দন। মানুষ গানের মাধ্যমেই নিজেদের সুখ, দু:খ-বেদনার কথা প্রকাশ করে থাকে। সেখানেই খুঁজে পায় নিজের সত্তা। আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনের রয়েছে এক বিশাল ভাণ্ডার। যেখানে অজস্র সুর ও কথামালা শাখায় শাখায় বিশালতাকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা আটকে গেছি এক নিদৃষ্ট গণ্ডির মধ্যে। আমাদের গানের স্রোতধারা একটি সীমানায় এসে থমকে গেছে। সময়ের একটি নিদৃষ্ট রেখায় থেমে যাওয়া গানের তরঙ্গ যেনো কোনভাবেই আলোর পথ দেখতে পারছে না। তারউপর একের পর এক নক্ষত্রের পতন সঙ্গীতাঙ্গনকে করছে শূণ্য।

বাংলাদেশের গানের স্বর্ণালী যুগ বলে আমরা বুঝি স্বাধীনতার পূর্ব ও তৎপরিবর্তী কিছু সময়কে। সেই সময়ের গানগুলোই আজ আমাদের সম্পদ। যে গানগুলো আজও হৃদয়ে দোলা দেয়। সেই সব দিনের গান, গানের কথা, সুর হাজার বছর বেঁচে থাকবে। একথা আমরা সকলেই জানি, মানি ও বিশ্বাস করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, যারা এসব গানের গীতিকার, সুরোকার, শিল্পী তাঁরা একের পর এক আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে আমরা হারিয়েছে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সঙ্গীত তারকাদের।

স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত অনেক গুনি শিল্পীকে আমরা হারিয়েছি। সেই তালিকা দীর্ঘ। তবে যারা আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনকে এতো দিন টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই গত অর্ধ যুগে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। বিদায় নিয়েছেন অসংখ্য বিখ্যাত তারকা শিল্পী। যেমন ধরুন - ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, আমরা হারিয়েছি প্রথিতযশা নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগমকে। যিনি সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে নজরুল সঙ্গীতের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

আমরা হারিয়েছি কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী লাকী আখন্দকে। ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান মুক্তিযোদ্ধা ও সংগীতশিল্পী লাকী আখন্দ।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা ও খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ মিহির নন্দী মারা যান ২০১৭ সালের ৬ মে। একই বছরের ২৭ জুন বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী স্বরলিপিকার ও নজরুল গবেষক সুধীন দাশ মারা যান।

আমরা হারিয়েছি বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারকে। তিনি ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক বহু জনপ্রিয় গানের শিল্পী আব্দুল জব্বার। তার গাওয়া ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’, ‘পীচ ঢালা এই পথ’, ‘বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা’ সহ অগণিত সাড়াজাগানো গান আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনকে করেছে সমৃদ্ধ।

একই বছর আমরা হারিয়েছি জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও নন্দিত বংশীবাদক বারী সিদ্দিকীকে। তিনি ২৪ নভেম্বর ২০১৭ সালে আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনকে শূণ্য করে চলে গেছেন। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘শুয়াচান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া’, ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’ ইত্যাদি।

ঢাকাই সিনেমার অসংখ্য জনপ্রিয় গানের শিল্পী শাম্মী আখতার মারা যান ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি। শাম্মী আখতার প্রায় ৪০০ সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন। ‘ভালোবাসলেই সবার সঙ্গে ঘর বাঁধা যায় না’, ‘ঢাকা শহর আইসা আমার’, ‘আমি যেমন আছি তেমন রবো বউ হবো না রে’, ‘খোদার পরে তোমায় আমি বড় বলে জানি’, ‘ঢাকা শহর আইসা আমার’ সহ অসংখ্য গানের জনপ্রিয় এই শিল্পীকে হারিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গন বিশাল শূণ্যতার মধ্যে পড়ে।

শ্রোতাদের হৃদয় শূণ্য করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন দেশের জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। যিনি একাধারে গায়ক, লিডগিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার, প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

তার জনপ্রিয় গানগুলো মধ্যে রয়েছে- ‘এক আকাশের তারা তুই একা গুনিস নি’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘উড়াল দেব আকাশে’, ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি’, ‘সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে’ ইত্যাদি।

আমরা হারিয়েছি বরেণ্য গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। তিনি ২২ জানুয়ারি ২০১৯ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান হচ্ছে- ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সেই রেল লাইনের ধারে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’, ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেখ গো মালি’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, ‘আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’ ইত্যাদি।

আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন দেশের সুপরিচিত সঙ্গীত শিল্পী শাহনাজ রহমত উল্লাহ। ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে, এবার বল’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’সহ বহু জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দেয়া এই প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী  মারা গেছেন ২৩ মার্চ ২০১৯ সালে।

সব শেষ আমরা হারালাম একুশে পদকপ্রাপ্ত ও দেশ বরেণ্য জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দীকে। তিনি চলে গেলেন চলতি বছরের ৭ মে। ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘পাখিরে তুই দূরে থাকলে’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভাল’ সহ অসংখ্য গানের সুর শ্রোষ্ঠা সুবীর নন্দী ছিলেন দেশের সঙ্গীত জগতের এক জনপ্রিয় শিল্পী।

এই তালিকার বাইরেও অনেক তারকা শিল্পী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য- যাদের হাতে বাংলা গানের তথা বাংলাদেশের গানের চাবি ছিল তারা যোগ্য উত্তরসূরী আজও পায়নি, পাচ্ছে না। বর্তমান সময়ে আমাদের সঙ্গীতাঙ্গন মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন অসংখ্য তরুণ শিল্পীরা। যারা বাংলাদেশের গানকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং যাবেন। কিন্তু মেধাবী, সৃষ্টিশীল, হাজার বছর বেঁচে থাকার মত গানের শ্রোষ্ঠার বড়ই অভাব। এই অভাব পূরণ করতে না পারলে বাংলাদেশের গান, সঙ্গীত ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। যে স্বর্ণালী যুগ আমরা অতিক্রম করেছি তা নিমজ্জিত হবে অন্ধকারে।

এসএ/