ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

রোজায় কেমন হবে কিডনি রোগীদের খাদ্যতালিকা

সোনিয়া শরমিন খান

প্রকাশিত : ০৩:৩২ পিএম, ৯ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৫:১৫ পিএম, ৯ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার

পুষ্টিবিদ, সোনিয়া শরমিন খান

পুষ্টিবিদ, সোনিয়া শরমিন খান

শুরু হয়েছে পবিত্র মাহে রমজান। সিয়াম সাধনার মাস। এ মাসে আল্লাহ তায়ালা সুস্থ ও সচল মানুষের উপর রোজাকে ফরজ করেছে। তবে অনেকেই বিভিন্ন রোগের কারণে রোজা রাখবেন কি রাখবেন না। এটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো কিডনি রোগ।

এরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা রোজা রাখা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। শুধু রোগী না অনেক সময় অনেক ডাক্তারও বিভ্রান্তিতে ভোগেন। এবিষয় সার্বিক পরামর্শ দিয়েছেন সিটি হেলথ সার্ভিসেস লিমিটেডের পুষ্টিবিদ, সোনিয়া শরমিন খান।

যারা কিডনি রোগে যারা ভুগছেন, তাদের সবসময়ই চিন্তার বিষয় থাকে গৃহীত খাবারটি যথাযথ হচ্ছে কি না? কিডনি রোগটি এমনই একটি রোগ যার সাথে অনায়াসে যুক্ত করা যায় আরো কিছু শারীরিক সমস্যাকে। যেগুলো হলো হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, প্রোটিনিউরিয়া (প্রস্রাবের সাথে প্রোটিন নিঃসৃত হওয়া), রক্তে ইউরিক এসিড ও ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়া সহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যা সমুহ।

সুতরাং,রোজায় কিডনি রোগের খাদ্যতালিকা প্রস্তুতের সময় অবশ্যই ব্যাক্তির অন্যান্য শারীরিক সমস্যাগুলোকে আমলে রেখেই খাদ্যতালিকা প্রস্তুত করতে হয়।

খাদ্যতালিকা বা ডায়েটচার্ট ছাড়াও আরো কিছু বিষয় এ রোগীকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রথমতঃ পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করা এবং নির্দিষ্ট পরিমানে প্রোটিন গ্রহণ করা,

দ্বিতীয়তঃ কিডনির কার্যকারিতা ঠিক রাখা, তৃতীয়তঃ রক্তের সোডিয়াম, গ্লুকোজ, ইউরিক এসিড, ক্রিয়েটিনিন এর মাত্রা ঠিক রাখা। সর্বোপরি ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে এইসব মাত্রার পরিমাণ সম্পর্কে আপডেট থাকা। এছাড়াও নির্দিষ্ট পরিমান পানি গ্রহণ।

এখন আসি এইসব মাত্রা কি পর্যায়ে কিডনি রোগীর জন্য প্রযোজ্য?সাধারণ ক্ষেত্রে রক্তচাপ নরমাল থেকে ৯০/ ১৪০ পর্যন্ত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ডাক্তারের এর নির্ধারিত রক্তচাপ এর পরিমাপ অনুযায়ী রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে, রক্তে গ্লুকোজ এর মাত্রা ইনসুলিন গ্রহণ বা না গ্রহণের উপর নির্ভর করে ডাক্তারের পরামর্শে নির্ধারিত হবে। রোগের ধাপ এর প্রেক্ষিতে সারাদিনের সোডিয়াম গ্রহণের মাত্রা ২০০০ মিগ্রা থেকে ২৪০০ মিগ্রা পর্যন্ত হবে যা মাত্র ৫ গ্রাম থেকে ৭ গ্রাম লবণেই পাওয়া যায়।

সর্বশেষ বলব কি কি খাওয়া যাবে এবং খাওয়া যাবে না। প্রথমেই ফলের কথা বলছি। যত রকম সাইট্রাস যুক্ত টক ফল যেমন, লেবু, কমলা, মাল্টা, আমলকি, আম, আংগুর এবং উচ্চ পটাশিয়ামযুক্ত ফল যেমন, কলা এবং ড্রাইফ্রুট বা শুকনা ফল এবং টমেটো খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে বা খুব কম পরিমানে খাওয়া যাবে। তাছাড়া আনারস, আপেল, বেদানা, নাশপাতি, পেয়ারা, কাঠাল, বড়ই ইত্যাদি পরিমিত পরিমান খাওয়া যাবে।

এবার আসি সবজির ক্ষেত্রে কি কি খাওয়া যাবে না? সব ধরনের সবুজ শাক ও পাতা জাতীয় সবজি খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে বা খুব পরিমিত গ্রহণ করা সম্ভব। মাটির নিচের সবজি বিশেষ করে আলু, মিষ্টি আলু, কচু ইত্যাদি খাওয়া বাদ দিতে হবে। তাছাড়াও পিউরিন সমৃদ্ধ বিভিন্ন ডাল, বীচি জাতীয় সবজি ( সীম, বরবটি ইত্যাদি) খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। তবে মাটির নিচের সবজি গাজর, মূলা, পেয়াজ পরিমিত খাওয়া যাবে। অন্যান্য সব্জির মধ্যে বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, লাউ, ঢেড়শ, ঝিংগা, চিচিংগা, তিতাকরল্লা, মটরশুঁটি, কাকরোল, ফুলকপি, ব্রকলি ইত্যাদি সবজি পর্যাপ্ত পরিমানে খাওয়া যাবে।

দুধ বা দুধ জাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে এক সার্ভিং এর বেশি খাওয়া যাবে না। বিশেষ করে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম গ্রহনে কিডনির দূর্বল কার্যকারিতার জন্য বাড়তি ক্যালসিয়াম পরিশোষনে কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি হয়।

প্রোটিন গ্রহণের ক্ষেত্রে রোগীর বয়স, ওজন, উচ্চতা, পরিশ্রমের প্রকার এবং রোগের ধাপ বা স্টেজ এর উপর নির্ভর করে পুষ্টিবিদের দ্বারা নির্ধারিত পরিমান প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত ব্যাক্তির প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.৮ গ্রাম প্রোটিন বরাদ্দ করা যায়। এক্ষেত্রে গরু, খাসী এবং ষাড়ের মাংস যতটা সম্ভব বাদ দিতে হবে। বিভিন্ন প্রকার মাছ, মুরগী, কবুতর, ডিম, পনির ইত্যাদি থেকে প্রোটিন এর চাহিদা মেটানো বাঞ্চনীয়। ফ্যাট এর পরিমান ও পুষ্টিবিদের নির্ধারণ করা পরিমানেই হতে হবে।

ডায়াবেটিস না থাকলে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার এর খুব বেশি বাধা নেই। তবে যতটা সম্ভব জটিল শর্করা গ্রহণ বাঞ্চনীয়। যেমন, গমের আটার রুটি, ওটস, মিক্সড গ্রেইন, সাগু ইত্যাদি খাওয়া যাবে। তাছাড়াও বাদ দেয়া খাবারের মধ্যে আরো আছে সব ধরনের প্যাকেটজাত খাবার, সফট ড্রিংকস বা কোমল পানীয়, ডাবের পানি, ফাস্ট ফুড বা জাংক ফুড, অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার এবং রিফাইন্ড চিনি। এছাড়াও ধুমপান বা অন্যান্য নেশা জাতীয় অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।

সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো, পানি গ্রহণের পরিমান। যেহেতু কিডনির ফিলট্রেশন কার্যকারিতা কমে যায়, তাই পানির পরিমান নিয়ন্ত্রণ করা অতিব জরুরি। রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাভাবিক পরিমাণ অর্থাৎ ব্যাক্তির প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.০৩ লিটার পানি গ্রহণ করা যাবে। এবং রোগের পরবর্তী ৩য়, ৪র্থ বা ৫ম স্টেজে জি আফ আর অনুযায়ী ডাক্তারের পরামর্শক্রমে পানির পরিমান নির্ধারিত হবে।

কিডনির কার্যকারিতা ত্বরান্বিত করতে কিছু বিষয় এ গুরুত্ব দেয়া উচিত। অতিরিক্ত ব্যায়াম আমাদের দেহের বিপাক বা মেটাবলিজম বাড়িয়ে দেয়। ফলে দেহে প্রোটিন এর বিপাক ও বেড়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে অতিরিক্ত প্রোটিন এর ফিলট্রেশন এ কিডনির উপর চাপ পরে। তাই অতিরিক্ত ব্যায়াম না করে কিছু হাল্কা ব্যায়াম যেমন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, ২০ থেকে ৩০ মিনিট স্বাভাবিকভাবে বা কিছুটা দ্রুত হাটা ইত্যাদি এক্টিভিটি মেনে ব্যায়াম করা উচিত।

এছাড়াও কিছু ডাই ইউরেটিক হার্ব আছে যেগুলো মূত্রের দেহের টক্সিক উপাদান কে বেশি বের হয়ে যেতে সাহায্য করে এবং কিডনির সুস্থতা বাড়াতে সাহায্য করে। এই ধরনের হার্ব গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ধনেপাতা, ধনে বীজ ভেজানো পানি, হলুদ, আদার রস, তুলসী পাতা, চিরতা, থানকুনি পাতা, কাচা কর্ন বা ভুট্টার সিল্ক বা আশ ইত্যাদি নির্দিষ্ট পরিমানে খাওয়া যেতে পারে।


টিআর/