ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

ডিম জুতার রাজনীতি

আজাদুল ইসলাম আদনান

প্রকাশিত : ০৭:৩২ পিএম, ৯ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৯:১৮ পিএম, ১৩ মে ২০১৯ সোমবার

‘রাজনীতিতে ডিম-জুতার কাহন’ বা ‘ডিম-জুতার রাজনীতি’ এমন কথা শুনতে অবাক লাগলেও বিশ্ব রাজনীতির মাঠে বিশ্ব নেতাদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হয়েছে অসংখ্যবার। এমপি, মন্ত্রী থেকে শুরু করে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রধানকেও এমন কলঙ্কজনক ও লজ্জাজনক অবস্থার মুখে পড়তে হয়েছে।

গত মার্চে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টাচার্চে সন্ত্রাসী হামলার পর, এ ঘটনায় সেদেশের এক সিনেটর মুসলিমদের দায়ী করলে, ক্ষুব্ধ হয়ে এক বালক তার মাথায় ডিম ভাঙেন। যা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

সবশেষ, গত সোমবার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন আসন্ন অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে এক অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে কেউ একজন তাকে ডিম নিক্ষেপ করে।
প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও, আইনশৃঙ্খলার বাহিনী ডিম নিক্ষেপকারী ঐ নারীকে আটক করে।

শুধু অস্ট্রিলিয়ার প্রধানমন্ত্রী নন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্তব্য ও আচরণের কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প, ভারতের সাবেক প্রধামন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী, ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমদে নিজাদ, পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, পাকিস্তানের সাবেক সেনা প্রধান ও রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশাররফ, ভেনিজুয়েলার প্রধানমন্ত্রী নিকোলাস মাদুরো, আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফাস্ট লেডি হিলারি ক্লিন্টনসহ অনেককে।

শুধু কি বিশ্ব নেতারা? এ তালিকায় আছে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরও নাম।

২০০৮ সালে ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করায় সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর ও সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন টেলিভিশন টকশোতে এক নারী সাংবাদিককে নিয়ে রিরুপ মন্তব্য করার মামলায় আদালতে জামিন নিতে গিয়ে ডিম-জুতার হামলার শিকার হন তিনি।

অবশ্য ডিম জুতার এ রসায়ন নতুন কিছু নয়। বিংশ শতকে প্রথম এর চিত্র আমরা দেখতে পাই। একুশে টিভির পাঠকদের জন্য আজ এমনি কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি-

১. আমেরিকার ইতিহাসে রিচার্ড নিক্সন প্রথম ডিম নিক্ষেপের হামলার শিকার হন। ১৯৫৮ সালে পেরুর রাজধানী লিমায় আমেরিকার সাবেক এ প্রেসিডেন্টের গাড়ি লক্ষ্য করে ডিম নিক্ষেপ করে স্থানীয় জনতা। লজ্জা এড়াতে তিনি বলেছিলেন, আমাকে নয়, গাড়ি লক্ষ্য করে তারা ডিম নিক্ষেপ করেছিল।

২. দ্বিতীয় ঘটনাটি সান ফ্রান্সিসকোর সাবেক মেয়রের ওপর ঘটে। দীর্ঘদিন থেকে গৃহহীন থাকা সাধারণ মানুষের জন্য ১৯৯৮ সালে মেয়র উইলি ব্রাউন বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন। তবে, সেগুলো তাদের জন্য তেমনটা ইতিবাচক ছিলনা। ক্ষুব্ধ জনতা এক সমাবেশে তাকে লক্ষ্য করে ডিম, সবজিসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত বস্তু নিক্ষেপ করে।

৩. আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার। ক্যালিফোর্নিয়ার এ গভর্নর ছিলেন সফল একজন শাসক। হলিউডে অভিনয় দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও অল্প সময়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ২০০৩ সালে এক নির্বাচনী প্রচারণায় ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী তাকে আক্রমন করে বসে।

৪. বিশ্বজুড়ে যে ঘটনা আজো সবার মুখে মুখে, তা হলো আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ।
২০০৮ সালে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পাঁচ বছর পর বাগদাদ সফরে গিয়ে তৎকালীন ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকিকে সঙ্গে নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করছিলেন তৎকালীন এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইরাকের আল-বাগদাদিয়া টিভির সাংবাদিক মুনতাজা আল জায়েদি। তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে জর্জ বুশকে ‘কুকুর’ বলে সম্বোধন করে তাকে লক্ষ করে তার দুটি জুতা ছুঁড়ে মারেন। ওই সময় জায়েদি চিৎকার করে বলেন, ‘দুটি জুতার একটি হচ্ছে ইরাকি জনগণের বিদায়ী চুম্বন। আর অপরটি মার্কিন অভিযানে নিহতদের স্ত্রী-সন্তানদের পক্ষ থেকে। যদিও, অল্পের জন্য জুতাগুলো তার গায়ে লাগেনি।’

এ ঘটনা পশ্চিমা বিশ্বসহ গোটা দুনিয়াব্যাপী তোলপার সৃষ্টি করে। লজ্জারমুখে পড়তে হয় আমেরিকার শাসকদের। তাৎক্ষণিকভাবে ঐ সাংবাদিককে আটক করা হলেও, পরবর্তীতে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। যে জুতা গুলো নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তা নিলামে তোলা হয়। গত বছরের সাধারণ নির্বাচনেও অংশ নেন সেই ইরাকি বীর জায়েদি।

৫. আমেরিকার ইতিহাসে কম বয়সী ও বিতর্কহীন এবং সফল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ২০১০ সালে ফিলাডেলফিয়ার এক সমাবেশে কিছু একটা ছুঁড়ে মারে এক যুবক। তবে সেটি ডিম কিংবা জুতা নয়, সেটি ছিল একটি বই। এ ঘটনায় ওই যুবককে আটক করা হলে সে জানায়, এমনটার জন্য আমি দুঃখিত। তাঁকে এটা আমি পড়তে দিয়েছিলাম। ওবামা অবশ্য এ ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে নেন।

৬. জুতা নিক্ষেপের ঘটনা ভারতে নতুন কিছু নয়। অনেক নেতাকে এমন লজ্জানক অবস্থায় পড়তে হয়েছে। কখনো জুতা, কখনো চড়, থাপ্পর- কিলঘুষির মত অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে এ দেশের রাজনীতিবিদদের।

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-ও একবার এমন ঘটনার শিকার হয়েছিলেন৷ ২০০৯ সালে আহমেদাবাদে তাঁকে উদ্দেশ্য করে জুতা ছোঁড়া হয়েছিল৷

কংগ্রেস পার্টির সভাপতি ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজির গান্ধীর পুত্র রাহুল গান্ধী। কংগ্রেসের এ উদীয়মান নেতাকে জুতা হামলার শিকার হতে হয়েছে একাধিকবার। ২০১২ সালে উত্তরখন্ডের এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতাকালে এক যুবক তাকে জুতা ছুড়ে মারেন। যদিও সেটি রাহুল পর্যন্ত পৌঁছার আগেই আইনশৃঙ্খলাবাহীনি ধরে ফেলে।

২০১৬ সালে এক নির্বাচনী শোভাযাত্রায় পুনরায় রাহুল গান্ধীকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে (আরএসএস) দায়ী করেছিলেন তিনি। এছাড়া, ভারতের আরো কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাও বিভিন্ন সময় এমন আকস্মিক জুতা-হামলার শিকার হয়েছেন৷ ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও বিজেপি নেতা এল কে আদভানির নামও রয়েছে এই তালিকায়৷

৭. এবার দেখি মধ্য প্রাচ্যের দিকে। ২০১৪ সালে লাস ভেগাসের ম্যান্ডেল বে ক্যাসিনোতে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে আমেরিকার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফাস্ট লেডি খ্যাত হিলারি ক্লিন্টনকে এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনার শিকার হতে হয়। এক নারী তাকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করেন। কৌতুহল হিসেবে ধরে নিয়ে তাকে এ যাত্রায় লজ্জা ধরে রাখতে হয়।

৮. ২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ মিশর সফরে গিয়েছিলেন। এসময় তার গাড়ি লক্ষ্য করে কায়রোর এক যুবক জুতা ছুড়ে মারেন।

৯. বিশ্বজুড়ে যেসকল দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকট চলমান, ভেনিজুয়েলা সংকট তার একটি। দীর্ঘদিন থেকে নানামুখী সংকট চলা দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো ২০১৫ সালে রাজধানীর অদূরে অনাজুতিগুই শহরে গেলে তাকে লক্ষ্য করে ডিম কিংবা জুতা নয়, আম নিক্ষেপ করেছিল বিরোধীরা।

১০. যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ডোনাল্ট ট্রাম্প। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত ব্যক্তি সম্ভবত তিনি। ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য ও উদ্ভট আচরণের জন্য বারবার তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে দেশে, দেশের বাইরে এমনকি খোদ তার দলের ভেতরেও।

২০১৬ সালে এক র‌্যালিতে অংশ নিয়ে তাকে টমেটো নিক্ষেপ করেছিল কয়েকজন যুবক। পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে মুসলিম বিরোধী আইন, বিশেষ করে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্যের জন্যও তাকে বহুবার সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে নিজ দেশে।

এতো গেল বিশ্বনেতাদের অবস্থা। বাংলাদেশেও এমন কিছু রাজনীতিবিদ আছেন, যাদের বিতর্কিত বক্তব্য ও আচরণের জন্য এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন।

সাবেক ধর্ম ও নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। বলা হয়ে থাকে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বিতর্কিত মন্ত্রী। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বায়তুল মোকাররম মসজিদে আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগীতায় প্রধান অতিথির আলোচনায় ইসলাম ধর্ম ও ফতোয়া নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় উপস্থিত জনতা তাকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করতে থাকে। পরিস্থিতি এড়াতে নিরাপত্তা রক্ষিরা তাকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেন।

এমন বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন সরকারের আরেক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলগীর। শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর অভিযোগে ২০১৪ সালে নিজ নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুরের কচুয়ায় এক ওয়াজ মাহফিলে স্থানীয় জনতার হাতে জুতা হামলার শিকার হন তিনি।

গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত একটি ঘটনা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনকে নিয়ে ঘটে। টকশোতে এক নারী সাংবাদিককে অবমাননাকর মন্তব্য করায় তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হয়।

২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর রংপুরের আদালতে মানহানির মামলায় জামিন নিতে গেলে ডিম, জুতা হামলার শিকার হন তিনি।

সবশেষ, গেল সোমবার এমন লজ্জাজনক আকস্মিক হামলার শিকার হন অস্ট্রেলিয়ার প্রধামন্ত্রী স্কট মরিসন।

পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে ক্ষমতার পালা বদলে এমন ডিম-জুতা হামলার ঘটনা কখনোই কাম্য নয়। রাজনীতিবিদরা যতদিন না কাজের চেয়ে, চাপার জোর কমাবে, ততোদিন হয়তো এমন অবস্থা বদলাবেনা। তাই, মানুষের জন্য রাজনীতি হলে, সবার আগে চাই দেশ পরিচালনায় নিয়োজিতদের উন্নত চরিত্র, কথামত কাজ করার মানসিকতা।

এসি