ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

মাহে রমযানে কী খাবেন

ডা. মনিরুজ্জামান

প্রকাশিত : ১১:১২ পিএম, ১৫ মে ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ১২:৩৯ পিএম, ১৬ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার

সিয়াম সাধনা বা রোজা শুধু আত্মিক উন্নতি সাধনই করে না, বরং মানসিক প্রশান্তি ও দৈহিক সুস্থতাও বয়ে আনে। ১৯৯৪ সালে ক্যাসাব্ল্যাঙ্কায় অনুষ্ঠিত ‘সুস্বাস্থ্য এবং রমযান‘ শীর্ষক প্রথম আন্তর্জাতিক সেমিনারে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫০ জনেরও অধিক মুসলিম ও অমুসলিম গবেষকদের গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, এক মাস রোজা দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনে।

মাসব্যাপী খাবারের সংযম বছরের বাকি মাসগুলোতে শরীরকে অধিক কর্মক্ষম করে। বিশেষ করে পরিপাকতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। লিভার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রোজার ফলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিশ্রাম লাভ করে। শরীরের সঞ্চিত বিষাক্ত পদার্থগুলো দূর হয়ে যায়।

. রোজা বা উপবাসে সাময়িক খাদ্য সংকটকালে দেহকোষের অভ্যন্তরে সৃষ্ট টক্সিনগুলোর বিনাশ ঘটে। এই প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম অটেফেজি। জাপানের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইউশিনোরি ওসুমির গবেষণা অনুসারে, অটোফেজি চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকে যখন দেহ ১২-১৬ ঘণ্টা না খেয়ে থাকে। দীর্ঘ অনাহারে একদিকে দেহে যেমন শুদ্ধি অভিযান চলে; তেমনি মনও মুক্ত থাকে ঝগড়া-ফ্যাসাদ এবং গীবতের মতো ধ্বংসাত্মক চর্চা থেকে।

. পৃথিবীতে প্রতি বছর অপুষ্টিতে যত মানুষ মারা যায় তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় অতিপুষ্টিতে বা অতিরিক্ত পানাহারের ফলে সৃষ্ট সমস্যা থেকে।

. যখনই একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে তখনই দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগ মুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে। অতিভোজনের ফলে দেহে যে টক্সিন তৈরি হয় তা স্নায়ুমন্ডলীকে বিষাক্ত করে তোলে। ফলে দেহে এক অস্বাভাবিক  রকমের ক্লান্তিবোদ ও জড়তা নেমে আসে।

. এক মাসের রোজায় ওজন হ্রাস পায়, রক্তের কোলেস্টেরল লেভেল কমে আসে, করোনারি ধমনীতে সঞ্চিত চর্বি কমতে থাকে যদি রোজায় চর্বি জাতীয় খাবার ও ভাজা-পোড়া খাবার কম খায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও  হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে যায়।

. গ্যাস্ট্রিক বা ডিওডেনাল আলসারের কারণে যারা রোজা রাখতে ভয় পান তাদের জন্য সুখবর, রোজা আলসার বৃদ্ধি করে না। এটি আজ চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অভিমত। কেননা রোজা যেহেতু মানসিক প্রশান্তি নিয়ে আসে সেহেতু এসিড নিঃসরণ স্বাভাবিক থাকে। রোজায় গ্যাস্ট্রিক আলসারের রোগীরা ভাল থাকেন। তবে ডিওডেনাল আলসারের রোগীদের ক্ষেত্রে কখনও কখনও রোজায় ব্যথা বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে Tab. Ranitidine (150 mg) বা Tab. Pantoprazole (20mg) বা Tab. Omeprozole (20mg) সেহরি ও ইফতারির সময় খাওয়া যেতে পারে।                             

  কী খাবেন:

. রমজান আত্মশুদ্ধির মাস, আত্মসংযমের মাস। তাই খাবার গ্রহণেও সংযম প্রদর্শন করুন।

. সেহেরিতে মাঝারি খাবার গ্রহণ করুন। প্রোটিন বা আমিষজাতীয় খাবার কম খান। গবেষণায় দেখা গেছে, সেহেরীতে যত আমিষ জাতীয় খাবার বেশি খাবেন ততো বেশি পিপাশা লাগবে। আর রোজাদার ব্যক্তি কাবু হন মূলত পিপাসায়। তাই পরিমিত ভাত বা লাল আটার রুটির সাথে পর্যাপ্ত সবজি খান। পরিমিত ডাল খান। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ পরিহার করুন। এতে সারাদিন পানির পিপাসা কম লাগবে।

সেহেরিতে প্রচুর পানি পান না করে স্বাভাবিক পানি পান করুন। কেননা প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রসাব হয়ে বের হয়ে যায়।

. ইফতারে ভাজা পোড়া তৈলাক্ত খাবার পরিহার করুন। এগুলো যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তেমনি ওজন বৃদ্ধি করে। এছাড়া এটি রোজার মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। ভাজা-পোড়া খাবার পেটে গ্যাস তৈরি করে যা রোজাদারের জন্য দারুণ অস্বস্থিকর। এছাড়া এগুলো আলসার তৈরি করতে পারে।

. তাই নবীজী (স.) এর মত খেজুর দিয়ে ইফতার করে মাগরিবের নামাজ পড়ে নিন। খেজুরে পর্যাপ্ত সুক্রোজ থাকে যা কিছুক্ষণের মধ্যে গ্লুকোজে রুপান্তরিত হয়ে রক্তে প্রবেশ করে আপনাকে চাঙ্গা করে তোলে।

নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে নিন। রাতের খাবারে রুটি বা ভাতের সঙ্গে  শাক-সবজি, ডাল, মাছ বা মুরগীর মাংস খাওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে রাতে এক গ্লাস দুধ খেতে পারেন।  ইফতারির পর বিরতি দিয়ে পর্যাপ্ত পানি পান করুন। যাদের কৌষ্ঠকাঠিন্য রযেছে তারা প্রচুর শাক-সবজি ও পানি পান করুন। প্রয়োজনে ইসুবগুলের ভুসি খেতে পারেন। এতেও কাজ না হলে Syr. Lactulose  ৩/৪ চামুচ করে দিনে ২ বার খেতে পারেন।

. বোতল বা প্যাকেটজাত ফ্রুট জুস না খেয়ে তাজা ফল খান। কোমল পানীয় বর্জন করুন।

. যাদের ওজন বেশি, রমজান তাদের জন্যে ওজন কমানোর এক সুবর্ণ সুযোগ ।

. যারা বিভিন্ন অসুখে ভুগছেন তারা সেহেরি ও ইফতারের পর প্রয়োজনীয় ঔষধ গ্রহণ করুন।

. হোটেলের খোলা খাবার ও পানি খাবেন না। কেননা তা থেকে পেটের পীড়া এবং জন্ডিস হতে পারে।

 

 ডায়াবেটিক রোগীদের করণীয়:          

. ডায়াবেটিসে আক্রান্ত  ব্যক্তিরাও অন্য দশজনের মতো রোজা রাখতে পারেন।

. ডায়াবেটিক রোগীদের অন্য সময়ের মতো রমজানেও নিয়ন্ত্রিত  জীবনযাপন করা উচিত।

. ডায়াবেটিক রোগীরা ডায়াবেটিক খাদ্য তালিকা অনুসরণ করে রমজানেও খাবার গ্রহণ করবেন ।

. যাদের ওষুধ ছাড়াই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়ামের সাহায্যে সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকে তাদের রমজানে খুব একটা অসুবিধা হয় না। তবে যারা ইনসুলিন বা ওষুধ নিয়ে সুগার নিয়ন্ত্রনে রাখেন তাদের ক্ষেত্রে ইফতার ও সেহরির সময় নির্দেশনা অনুযায়ী ইনসুলিনের ডোজ ঠিক করতে হবে।

. ইনসুলিন বা ওষুধ নিয়ে যারা সুগার নিয়ন্ত্রনে রাখেন তাদের সর্বদা ‘ হাইপোগ্লাইসিমা’ সর্ম্পকে সচেতন থাকতে হবে। ‘হাইপোগ্লাইসিমা’ এমন একটি অবস্থা যেখানে রক্তের সুগার কমে রোগী হঠাৎ ঘেমে যাওয়া, কাঁপুনি লাগা, বুক ধড়ফর করা, অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগা, অশান্তি, অস্থিরতা, ঘুম ঘুম ভাব, কথা বলতে কষ্ট হওয়া, মনযোগের অভাব, সমন্বয়হীনতা, বমি বমি ভাব, ক্লান্তি লাগা, মাথাব্যথা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।

এক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত এক গ্লাস  গ্লুকোজ বা চিনির শরবত খেতে দিতে হবে যেন দ্রুত  রক্তের সুগার স্বাভাবিক মাত্রায় চলে আসে। এ জন্য প্রতিটি ডায়াবেটিক রোগী যারা ওষুধ বা ইনসুলিন নেন তাদের পকেটে সবসময় অল্প পরিমান গ্লুকোজ বা চিনি থাকা উচিত।

. সেহরিতে গমের লাল আটার রুটি, সবজি থাকতে পারে। রুটির বদলে অল্প পরিমাণ ভাত খেতে পারেন। মিষ্টি বা চিনির তৈরি খাবার খাবেন না।

. খেজুর ও পানি খেয়েই নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে নিন। ইফতারিতে তৈলাক্ত, ভাজা-পোড়া খাবার বা জিলাপি, মিষ্টান্ন না খাওয়া উচিত। রুটি বা ভাতের সঙ্গে  সবজি, ডাল, মাছ বা মুরগীর মাংস খাওয়া যেতে পারে। 

একমাস সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদ। ঈদের আনন্দ সমস্ত দুঃখ কষ্ট ব্যথা বেদনা দূর করে দেয়। ছোট-বড়, ধনী- গরিব নির্বিশেষে সকলেই মেতে উঠে ঈদের আনন্দে। এই আনন্দ যেন আপনার সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। নিয়ন্ত্রিত খাবার খাওয়ার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছিল তা ধরে রাখুন। তবেই বছরের বাকী  ১১ মাস আপনি ভাল থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।