ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

আমাদের ধর্মবোধ ও ঈদ আনন্দের ইতিকথা

গোলাম সারোয়ার

প্রকাশিত : ১২:১০ এএম, ৫ জুন ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ০৭:২৭ পিএম, ৫ জুন ২০১৯ বুধবার

পৃথিবীতে বর্তমানে মানুষ আছে প্রায় সাত’শ ত্রিশ কোটি আর ধর্ম আছে প্রায় চার হাজার দু’শটি। বিশ্বের মানুষেরা এসব ধর্ম বিশ্বাস মতে জীবনযাপন করে, আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কিছু মানুষ অবশ্য এসব কোন ধর্মকেই মানেন না। তারা পালন করেন মানব ধর্ম। এরকম মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। নাস্তিকতাবাদ, অজ্ঞেয়বাদ, ইহবাদ, জুচে মিলে পৃথিবীতে ধর্মহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় একশ দশ কোটি, বাকিরা ধর্মপ্রাণ। মানুষ যে বিশ্বাসেরই হোক না কেন প্রতিটি মানুষ আনন্দ, উল্লাস আর উচ্ছ্বাস পালন করে থাকে। বিভিন্ন বিশ্বাসের আছে বিভিন্ন পর্ব, পার্বণ আর উৎসব।

ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী মানুষের সংখ্যা মোতাবেক পৃথিবীর প্রধান চারটি ধর্ম হলো খ্রিস্টান, ইসলাম, হিন্দু এবং বৌদ্ধ। পৃথিবীতে ইসলাম ধর্মের অনুসারী আছেন প্রায় ১৮০ কোটি। সে হিসেবে পৃথিবীতে প্রতি একশ জন মানুষের মাঝে মুসলমান আছেন প্রায় ২৪ জন। তার মানে পৃথিবীর অন্তত ১৮০ কোটি মানুষের একটি একক উৎসব হলো ঈদের উৎসব। মুসলমানদের ঈদ দুটি। একটি ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আযহা। এক মাস রোযা পালনের পর পহেলা সাওয়াল ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হয়। তার দু`মাস দশ দিন পর অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল আযহা। ‘সাওয়াল’ একটি আরবি মাসের নাম। সাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদ। ‘ঈদ’ শব্দটির অর্থ হলো ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আনন্দ-উৎসব। ঈদ অর্থ বার বার ফিরে আসাও বুঝায়। ঈদ নামকরণ করা হয়েছে এ কারণে যে, তা প্রতি বছর নতুন সুখ ও আনন্দ নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে।

নবুয়তের প্রথম দিকে এক সঙ্কটময় মুহূর্তে মহানবীকে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে হয়। সে ঘটনা থেকে আরবীতে হিজরি সন গণনা করা হয়। হিজরি মাস গণনা করা হয় চাঁদ দেখা সাপেক্ষে। ঈদের আগের রাতটিকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় লাইলাতুল জায়জা, যার অর্থ হলো পুরস্কার রজনী। আমাদের দেশে ঈদের আগের রাতটিকে বলে ‘চাঁদ রাত’। চাঁদ রাত মুসলিম শিশু কিশোরদের আনন্দের রাত। তারা আসন্ন ঈদের উত্তেজনায় বিভোর থাকে এ রাতে। এক মাস রোজার পর অবশেষে আসে সেই আনন্দের দিন। ঈদের দিন রোজা রাখা কিন্তু ইসলামে নিষিদ্ধ।

মুসলমানরা যে ঈদ পালন করে থাকেন তা শুরু হয় মূলত মদিনাতে রাসুলের হিজরতের পর। জাহেলিয়াতের যুগে মদিনাতে দুটি উৎসব হতো। একটির নাম ছিলো নওরোজ এবং অন্যটি মিহিরজান। তখন আরবের পৌত্তলিকরা এসব উৎসবে সীমা লঙ্গন করতো। ওকাজ মেলা হতো যেখানে তারা অশ্লীলতায় মেতে উঠতো। ইসলাম এসব অশ্লীলতার পরিবর্তে উপহার দিলো নির্মল আনন্দের ঈদ যা, আনন্দের সাথে সাথে ইবাদতের আমেজও বহন করে। ঈদের নামাজের পর ধনী-গরীব, উচু-নিচু, সাধারণ-অভিজাত সবাই কোলাকুলি করে আনন্দে একাকার হয়। এটি এক ধরণের বৈষম্যহীন সমাজের প্রতিচ্ছবি।

আমাদের দেশে মুসলিম সংস্কৃতি আসে আরবরা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এখানে আসার পর। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক থেকে বাংলায় আরবরা আসতে থাকে। পাহাড়পুরের মহাস্থানগড়ে খননকালে খলিফা হারুনর রশিদের আমলের রৌপ্যমুদ্রা (৭৮৮-তে উত্কীর্ণ) পাওয়া যায়। এ থেকে সে সময়কালে বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমনের সত্যতা পাওয়া যায়। বাংলায় আরবদের আগমনের ইতিহাস জানা যায়, ‘তাযকিরাতুল সোলহা’ নামের এক গ্রন্থ থেকে। শেখউল খিদা নামের একজন আরব সুফি সাধক হিজরি ৩৪১ সনে (৯২১ খ্রিস্টাব্দে) ধর্ম প্রচারের মানসে ঢাকায় এসেছিলেন। অনুমান করা হয়, শেখউল খিদা সম্ভবত চন্দ্র বংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের আমলে (৯০৫-৯৫৫ খ্রি.) বাংলায় আসেন। এ ছাড়া শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমি ইংরেজী ১০৫০ সালে নেত্রকোনা অঞ্চলে এবং বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুর পরগনার রামপালে আস্তানা গেড়ে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। এঁরা ব্যক্তিগত জীবনে এবং সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নামাজ, রোজা ও ঈদ পালন করতেন। এভাবে ক্রমে ক্রমে আসা মুসলমান বণিক, ধর্মসাধক ও ইসলাম প্রচারক গোষ্ঠীর প্রভাবে এ অঞ্চলের মানুষ ইসলাম ধর্মকে গ্রহন করেন। নতুন ধর্মান্তরিত মুসলমানরাও ক্রমে রোযা, নামাজ ও ধর্মীয় আচার আচরণ পালন করতে শুরু করেন।

১২০৪ সালে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে আসার পর থেকে বাংলায় মুসলিম শাসনের শুরু। ১২২৯ সালে দিল্লির সুলতান ইলতু্তমিশ যখন ক্ষমতায় সে সময় থেকে পূর্ব বাংলায় নামাজ, রোযা, ঈদ ও অন্যান্য মুসলিম উৎসব ধীরে ধীরে শুরু হতে থাকে। ঢাকা ও আশে পাশের এলাকার ঈদ এবং রোযার ইতিহাস পাওয়া যায় ‘বাজাস্তানী গাইবী’ গ্রন্থে। বইটি লিখেছেন মির্জা নাথান। মির্জা নাথান ঢাকায় আসেন ১৬০৮ ইংরেজী সালে সুবেদার ইসলাম খাঁর সাথে। আমাদের মনে আছে ইসলাম খাঁ মুঘল শহর ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ১৬১০ সালে। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও সপ্তদশ শতকের কবি ভারতচন্দ্রের কবিতায় মুসলমানদের রোজা পালন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মুকুন্দরামের বর্ণনায় শরিয়তি ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠা পাওয়া যায় তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে। তিনি লিখে যান, ‘…প্রাণ গেলে রোযা নাহি ছাড়ে’। ভারতচন্দ্রের কবিতায় ধর্মের সাথে ধর্মের মিলনের কথার মাঝে পাওয়া যায় রোযার কথা। যেমন-‘দেবদেবী পূজা বিনা কি হবে রোযায়’- অন্নদামঙ্গল।

মুঘল আমলে ঈদের চাঁদ দেখা ছিল এক আনন্দের ব্যাপার। চাঁদ দেখা যাওয়ার বিষয়টি মানুষকে জানানোর জন্য তোপধ্বনি করা হতো। আর দূরদূরান্তের মানুষকে চাঁদ দেখা যাওয়ার সংবাদ জানানোর জন্য ভারী কামান দাগা হতো। ঈদের নামাজ আদয়ের জন্য ঈদগাহ নির্মাণের কৃতিত্বও মুঘলদের। ঢাকার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেন, বাংলার সুবাদার শাহ সুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাশেম ১৬৪০ সালে ঢাকা শহরের ধানমণ্ডি এলাকায় একটি ঈদগাহ নির্মাণ করেন। তবে মুঘলদের সময় ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন গরীবদের জন্যে ঈদের আনন্দ ছিলো না। মানুষ ছিল কৃষিজীবি, অভাবী। ঈদের আনন্দ করার মতো মানসিকতা বা সামর্থ্যও তাদের ছিল না। সনাতন ধর্মালম্বীদের যারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তারা ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু। শান শওকতের সাথে ঈদের উৎসব করার মতো এদের সঙ্গতিও ছিল না। তবে ধীরে ধীরে তারা তাদের মতো করে নিজস্ব সংস্কৃতির মিশেলে ঈদের আনন্দে হা-ডু-ডু খেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠিখেলা, বর্ষাকালে ঈদ হলে নৌকা বাইচ জুড়ে দিয়ে আনন্দ করতো।

ঢাকায় তিনটি উৎসবে আনন্দ মিছিল হতো। এগুলো ছিলো হিন্দুদের জন্মাষ্টমি মিছিল, শিয়াদের মহররমের তাজিয়া মিছিল এবং ঢাকাবাসীর ঈদ মিছিল। বাংলায় এখন ঈদের অর্থনীতিই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। অনেক ব্যবসায়ীর সারা বছরের ব্যবসার প্রধান আকর্ষণ হলো রোজার মাস। বাংলাদেশে এখন পনের রোযার পর থেকে মার্কেটগুলোতে ঠাঁই নাই। এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে অঢেল অর্থ। যে কোন দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যখন কোন উৎসবে অংশগ্রহণ করে তখন সে উৎসব হয়ে উঠে ঐ অঞ্চলের প্রাণের উৎসব। এখন টিভি চ্যানেলগুলো ঈদের আগে-পরে সাত-আট দিন যাবত অনুষ্ঠান প্রচার করে। তার মানে বাঙালিরা সংস্কৃতিগতভাবেও ঈদকে আপন করে গ্রহণ করেছেন।

ইদানিং একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এই মন্ত্রবাণী যদি মধ্যবিত্ত শ্রেণী গ্রহণ করে, তবে সামাজিক অসহিষ্ণুতা দূর হয়ে রাষ্ট্রে শান্তি ফিরে আসবে। ঈদ বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ ও স্বস্তিময় বিশ্ব ।

লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক।