ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

বিকৃত ওয়াজ ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গি: ইউটিউবে টাকা আয়ের হিড়িক

তানভীরুল ইসলাম

প্রকাশিত : ০৬:৩১ পিএম, ১০ জুন ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৮:৪৮ পিএম, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রবিবার

বিকৃত ওয়াজ ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গিকে পুঁজি করে ইউটিউবে টাকা আয়ের হিড়িক পড়েছে। ইসলামি বক্তা থেকে শুরু করে পর্ণ স্টাররাও নানা ধরনের ভিডিও তৈরি করে আকর্ষণ করছে বর্তমান যুব সমাজকে। সেই সাথে ফেসবুক-ইউটিউব থেকে আয় করে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। এমনকি এইসব বক্তা ও তারকাদের হাস্যরস ভিডিওগুলো থেকে চুম্বকাংশ নিয়ে ট্রল ভিডিও বানিয়ে ভাইরাল করছে একদল তরুণ।

সম্প্রতি একটি ইউটিউব চ্যানেলে নানা সময়ে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ব্যক্তির ডায়লগ নিয়ে তৈরি একটি গান আপ করা হয়। যা মুহুর্তেই নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। গানটিতে ব্যবহার করা হয় অস্ট্রিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সেফায়েত উল্লাহর বেশ কিছু কথা। এছাড়া বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনেতা ডিপজল, সম্প্রতি হয়ে যাওয়া মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের প্রতিযোগীর `এইচটুও` এবং `সুন্দরবনকে উইশ করা` সংক্রান্ত ভাইরাল হওয়া ডায়লগও রয়েছে। তবে গানের নাম নেয়া হয়েছে আরেক ভাইরাল ভিডিও ওয়াজ থেকে।

এর আগেও এমন ভাইরাল ডায়লগ দিয়ে মিউজিক ভিডিও তৈরি করা হয়েছে এই ইউটিউব চ্যানেল থেকে। এর সবগুলোই দেখা হয়েছে কয়েক লাখ বার। এছাড়াও সেফায়েত উল্লাহ ওরফে সেফুদার নানা ভিডিও থেকে চুম্বকাংশ নিয়ে তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য ভিডিও, যা লাখেরও বেশিবার দেখা হয়েছে।

মুসলমানদের আবেগ অনুভূতির একটা জায়গা হলো ইসলাম ও ধর্মীয় নানা ওয়াজ। এই ওয়াজ নিয়েও নানা ধরনের ট্রল ভিডিও তৈরি হচ্ছে। কিছু আলেম নামধারী ব্যক্তিদের জন্য সামগ্রীকভাবে ইসলাম ও আলেম উলামাদের সম্মান ও মর্যাদাহানি হচ্ছে। এমনকি তাদের হাস্যকর ওয়াজের কারণে ইসলামের সৌন্দর্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

সম্প্রতি ফেসবুক ও ইউটিউবে এক মুফতির বিরক্তিকর ওয়াজ ভাইরাল হয়েছে। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া সে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, নরসিংদীতে অনুষ্ঠিত ওয়াজ মাহফিলে এই মাওলানা সারাক্ষণ অপ্রাসঙ্গিক কথায় কান্না করে ওয়াজ করছেন।

কান্নাস্বরে তিনি কোথায় কোনদিন ওয়াজ তারও বর্ণনা করেন। এছাড়া তিনি ভারতে ওয়াজ করতে গিয়েছেন দাবি করে কান্না করতে থাকেন। এ নিয়ে ফেসবুকে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। ওয়াজ মাহফিলে এরকম নিজের ব্যক্তিগত হাজারো কথা বলে, ওয়াজের শুরে কান্না করতে থাকেন এই হুজুর। আমার ওয়াজ করতে রাজশাহী যাওয়ার কথা ছিল....বগুড়া যাওয়ার কথা ছিল........সুর করে টেনে টেনে নানাবিধ ভঙ্গিতে এসব বলতে থাকেন ওই হুজুর।

এছাড়াও ইন্টারনেটে খোলামেলা ও অসামাজিক কথাবার্তা এবং অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগে বিতর্কিত মডেল-অভিনেত্রী সানাই মাহবুব সুপ্রভাকে আটকের পর মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয় পুলিশ। এর দুদিন পরই ইউইটিউবার থেকে অভিনেতা হওয়া সালমান মুক্তাদিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আটক করে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। তার নামে ‘অভদ্র প্রেম’ শিরোনামে একটি মিউজিক ভিডিও নিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে।

এসব বিষয় নিয়ে পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের ডিসি আলিমুজ্জামান একুশে টিভি অনলাইকে বলেন, পর্ণস্টার বা কেউ যদি অশ্লীল ভিডিও তৈরি করে এবং আমাদের কাছে অভিযোগ আসে, আমরা তাদের ডেকে নিয়ে এসে সতর্ক করছি এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করছি। কিছুদিন আগে এসব অভিযোগে মডেল-অভিনেত্রী সানাই, ইউটিউবার সালমান মুক্তাদির, ভাদাইম্যাসহ বেশ কয়েকজনকে ডেকে এনে সতর্ক করেছি, মুছলেকা নিয়েছি এবং তাদের পরিচালিত ইউটিউব ও ফেসবুক গ্রুপ বন্ধ করে দিয়েছি। এরকম যাদের বিরুদ্ধেই আমাদের কাছে অভিযোগ আসে, তাদেরকেই আমরা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

আলিমুজ্জামান বলেন, সাইবার অপরাধের পরিধি দিন দিন বাড়ছে। পুলিশ তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। একজন হুজুর ওয়াজ মাহফিলে আবল-তাবোল বক্তব্য দিচ্ছে, কান্না করে বুক ভাসাচ্ছে, এইসব বিষয়ে তো আইন প্রয়োগ করার কিছু নাই। এখানে পুলিশ কিছু করতে গেলে তো নতুন করে আরও ঝামেলা তৈরি হবে। সুতরাং এ বিষয়ে আলেম-উলামা ও সাধারণ জনগণকে সচেতন হতে হবে।

তিনি বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা তাদেরকে এক ধরণের মেসেজ দিতে চাচ্ছি যে, এটা এক ধরণের অপরাধ। এরকম সামাজিক অপরাধ থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। সম্প্রতি আমাদের কাছে কিছু অভিযোগ আসছে, আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে যতটুকু ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব, আমরা সে ব্যবস্থা নিব।

দেশে কতজন পর্ণতারকা আছে বা তাদের কোন তালিকা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পর্ণের ব্যাপ্তি অনেক। আসলে কতজন এসব করে বা তাদের তালিকাটা আমরা দিতে পারবো না। দেখা যায় যে, আমরা একটা সাইটকে ধরছি বা বন্ধ করছি, তারা আরেকটা সাইট তৈরি করছে, এখানে তো আমাদের কিছু করার থাকে না। পর্ণগ্রাফী যদি একটা ডোমেইন দিয়ে চালায়, তাহলে আমরা বিটিআরসির মাধ্যমে আমরা সেগুলো বন্ধ করে দেই। ইতিমধ্যে আমরা অগণিত সাইট বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু যেটা ইউটিউব বা সাব ডোমেইনের মাধ্যমে আসছে, বা ফেসবুকের কোন পেইজ বা গ্রুপের মাধ্যমে যদি আসে, আর এটা নিয়ে কেউ যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করে, আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এটা আমাদের চলমান কাজ, আমরা সবসময় এটা করছি।

তিনি আরও বলেন, সাইবার অপরাধের পরিধি দিন দিন বাড়ছে। এগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে নতুন নতুন অপরাধ মোকাবেলা করা যাবে।

শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ও বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামার চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ একুশে টিভি অনলাইকে বলেন, ওয়াজ শব্দের অর্থ হলো উপদেশ। ওয়াজ শুনলে মানুষের ভিতরে আল্লাহর মহব্বত ও রাসূলের মহব্বত পয়দা হয়। আল্লাহর প্রতি তার আনুগত্য, ঈমান বিশ্বাস ও আখেরাতের চিন্তা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ একজন ব্যক্তিকে প্রকৃত মানুষ বানানোর জন্য হলো ওয়াজ। এই ওয়াজ কখনও বিনোদনের কারণ হতে পারে না। কেউ যদি এটাকে হাস্যরস ও বিনোদনের মাধ্যম বানায়, তাহলে ওয়াজের মূল লক্ষ্যই বিচ্যুত হয়ে যায়।

এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের উচিত হবে, যারা এই ধরনের ওয়াজকে বিনোদনের হাতিয়ার বা ইনকামের পথ বানায় তাদেরকে বয়কট করা। আর আলেম উলামাদের করণীয় হলো, এইসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করা। ইসলামে কখনই এটা পছন্দনীয় নয়।

পর্ণস্টারদের আপত্তিকর ভিডিও তৈরি ও তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে মাওলানা মাসউদ বলেন, যারা এই ধরনের কাজ করে যাচ্ছে অবশ্যই এটা নিন্দনীয়। তারা যা করছে তা ইসলামে চরম গর্হিত অপরাধ। এমন কেউ যদি মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, উগ্রবাদ সৃষ্টি করে তাহলে সেটা বন্ধ করা উচিত। প্রশাসনের উচিত এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।

প্রসঙ্গত, সরকার যুবসমাজকে রক্ষা করতে এরইমধ্যে দেড় হাজার পর্ণো ও জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে। নতুন প্রজন্মকে ইন্টারনেটের আপত্তিকর আসক্তি থেকে বের করে আনতে ইতিমধ্যে অশ্লীল কনটেন্ট, জুয়া বা বিপথগামী সাইট বন্ধ করে দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।