ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রযুক্তির অপব্যবহারে নষ্ট হচ্ছে নৈতিকতা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:০৯ পিএম, ২৩ জুন ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০৬:৪৭ পিএম, ২৩ জুন ২০১৯ রবিবার

প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কেড়ে নিয়েছে। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের সমাজের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। সভ্যতার উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তির অবদান অপূরণীয়। তবে প্রযুক্তির অপব্যবহারে নষ্ট হচ্ছে তরুণদের নৈতিকতা।

বিশেষ করে গুগল ও ইউটিউবকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, তরুণরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অপব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তরুণরা। নষ্ট হচ্ছে তরুণদের নৈতিকতা। তাদের যে সময় ব্যয়ের কথা ছিল নিজেদের গোছানোর, সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিপাটি করতে, নিজেদের যোগ্য রূপে গড়ে তুলতে অথচ সে সময়টুকু যাচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহারে।

এমনটাই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সম্প্রতি একুশে টিভি অনলাইনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন।

দেশবরেণ্য এ শিক্ষাবিদনের কথায় উঠে এসেছে কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের চাকরির সমস্যাসহ শিক্ষাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি-গলদ। তিনি মনে করেন বিদ্যমান সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি পরীক্ষার্থী হিসাবে গড়ে উঠছে। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান। এর চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অনেকের অভিমত, শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অনেকটাই সনদনির্ভর। দেশপ্রেম, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। এগুলোর চর্চার অভাবে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়?

ড.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিবর্তন হচ্ছে। শিল্পায়ন, নগরায়ন, বস্তুতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা আমাদের একাকী করে দিচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাছে। সামাজিক বিকাশ ব্যহত হচ্ছে। যে কারণে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে নানান অপরাধ। এ থেকে উত্তোরণের জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সমাজে প্রযুক্তির অপব্যবহারে সময় নষ্টকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ বিপদগামী হচ্ছে। পশ্চিমারা প্রযুক্তিকে এমনভাবে সাজিয়েছে যাতে তরুণ সমাজ শুধু নয় যেকোনো বয়সের ব্যক্তিও ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি দিনের পর দিনও তাতে আবদ্ধ থাকতে অতিক্রম করতে অনেকটা বাধ্য হচ্ছে।

বিশেষ করে গুগল ও ইউটিউবকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, তরুণরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অপব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তরুণরা। নষ্ট হচ্ছে তরুণদের নৈতিকতা। তাদের যে সময় ব্যয়ের কথা ছিল নিজেদের গোছানোর, সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিপাটি করতে, নিজেদের যোগ্য রূপে গড়ে তুলতে অথচ সে সময়টুকু যাচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহারে। সিনেমার কাহিনী,নাচ-গানে সাজ-সজ্জার দৃশ্য এমনভাবে নির্মিত হয়, তরুণসমাজ বাস্তবজীবনেও এর প্রয়োগ ঘটাতে আগ্রহ দেখায়। ফলে সমাজজীবন হচ্ছে ব্যাহত। বিয়ে-সংসার বেশিদিন টিকছে না। সামান্য অজুহাত, মান-অভিমানে একে অপরকে আলাদা করে দিচ্ছে। বাড়ছে সন্দেহপ্রবণতা, কমছে বিশ্বস্ততা।

বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। বিবাহরীতি ভেঙে বেড়েছে লিভ টুগেদার প্রথা। ভিনদেশি নাটক-সিরিয়াল দেখে নিজেদের চরিত্রে রূপ দিতে গিয়ে সংসারে নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে হারিয়ে যায় সন্তানাদি শোনে না বাবা-মায়ের কথা। কেউ মানে না কারো নিয়ন্ত্রণ করে না। এজন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার শিক্ষা রাখতে হবে। এবং সমাজে প্রত্যেক ক্ষেতে নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। তাহলে দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ তৈরি হবে।

একুশে টিভি অনলাইন: কীভাবে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করে নিরেট সেবায় রূপান্তর করা যায়?
ড.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অনেক ভাল মানের শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করছে। তবে কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনেকেই আবার টাকার মাধ্যমে সনদ বাণিজ্য করছে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে আমাদের নিজেদের মানসিকাতার পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষাকে সেবা হিসাবে নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।

একুশে টিভি অনলাইন: সৃজনশীল পদ্ধতিকে আপনি কিভাবে মূলায়ন করেন?

ড.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের আরও বেশি পরীক্ষার্থী হিসাবে গড়ে উঠছে। এ পদ্ধতি আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউ সৃজনশীল বোঝে না। তারা নোট-গাইডের আশ্রয় নেয়। শিক্ষার্থীরা গাইড পড়ে, কোচিংয়ে যায়। শিক্ষকরাও গাইড থেকে প্রশ্ন করে। এখন যারা সৃজনশীলই বোঝে না তারা তো প্রশ্ন ফাঁসের পেছনে দৌঁড়াবেই।

একুশে টিভি অনলাইন: মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : একুশে পরিবারের প্রতিও শুভ কামনা।

‘‘অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক। ইংরেজির ছাত্র হয়েও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গদ্যশিল্পী, মননশীল লেখক হিসেবে পরিচিত তিনি। সৃষ্টিশীল জীবনে প্রায় ১১০টিরও বেশি গ্রন্থের স্রষ্টা। শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় থেকে অসংখ্য স্বপ্নবাজকে জন্ম দিয়েছেন সুন্দর পৃথিবীর বিনির্মাণে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর অগণিত শিষ্য। সফল ও সার্থক জীবনে শুধু সাহিত্য রচনা ও শিক্ষকতায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। জাতির ক্রান্তিলগ্নে কলমের খুরধারায় মোকাবেলা করেছেন সব অপশক্তিকে।

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৫০ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগোরিস হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হন নটরডেম কলেজে। সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েটে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। ১৯৫৬ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

এরপর নিজ এলাকা মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। এসময় জগন্নাথ কলেজেও খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এ শিক্ষাবিদ। পরের বছর ১৯৫৭ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের লিডস ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট এবং লেজিস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে তিনি মাসিক পরিক্রমা (১৯৬০-৬২), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা (১৯৭২), ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র (১৯৮৪) ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন।’’

টিআর/