ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে রিফাতের মূল হত্যাকারীরা?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:২১ পিএম, ২৯ জুন ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ০৩:২৬ পিএম, ২৯ জুন ২০১৯ শনিবার

শাহ নেওয়াজ রিফাত। অকালে ঝরে পড়া এক ফুটন্ত পদ্মপাতা। স্ত্রীর সঙ্গে অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করায় প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাকে। স্ত্রীর সামনে দিনের আলোয় উপর্যুপরি কুপিয়ে গুরুতর আহত করার ভিডিও চোখে দেখেছে দেশবাসী। মধ্যযুগীয় বর্বর ও অবিশ্বাস্য এমন হামলা দেশবাসীর হৃদয় কাঁপিয়ে দিয়েছে।

গত বুধবারে এমন ঘটনার পর প্রায় তিন দিন হয়ে গেলেও এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন এ হত্যাকাণ্ডের মূল আসামীরা। ইতোমধ্যেই কয়েকজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলেও গ্রেফতার করা যায়নি মূল হোতাদের। স্থানীয়া বলছেন, মূল অপরাধীদের পেছনে শক্তিশালী রাজনৈতিক আশ্রয় থাকায় মূল তিন অপরাধী পূর্বে বিভিন্ন অপরাধ করেও পার পেয়ে গেছেন।

অন্যদিকে পুলিশ বলছে, তারা সর্বশক্তি দিয়েই রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে হত্যাকাণ্ডের তিন দিনেও মূল তিন আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন, রিফাত ফরাজী ও তাঁর ভাই রিশান ফরাজীকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

জানা যায়, নিহত রিফাতের সঙ্গে নয়নের ব্যক্তিগত বিরোধকে কেন্দ্র করেই এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাকে আগে থেকেই উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন। প্রায় দুই মাস পূর্বে রিফাতের সঙ্গে আয়েশার বিয়ে হয়। এরপরই নয়ন দাবি করেন আয়েশার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। রিফাতের সঙ্গে আয়েশার বিয়ে হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে নিয়ে প্রতিবাদ করেন রিফাত। এ নিয়েই মূলত দ্বন্দ্ব শুরু হয় নয়নের সঙ্গে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রিফাতের উপর প্রতিশোধ নিতেই নয়ন তার বন্ধু ও সহযোগীদের সাহায্য নিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। এ হত্যার পূর্বে পরিকল্পনা করার জন্য তারা গড়ে তোলে ‘বন্ড ০০৭’ নামের একটি ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ। এ হত্যাকান্ডে জিরো জিরো সেভেন (০০৭) ফেসবুক গ্রুপের বেশ কয়েকজন সদস্যও ওই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজে এদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাও বলেছেন, ভিডিওতে থাকা ওই তরুণেরাই তাঁদের প্রথমে আটকে তাঁর স্বামীকে মারধর শুরু করেন।

উল্লেখ্য, গত বুধবার সকালে বরগুনা শহরের কলেজ রোড এলাকায় প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় আয়শা হামলাকারীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় পরদিন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম মামলা করেন।

মামলায় সাব্বির, রিফাত, রিশানসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার পুলিশ এজাহারভুক্ত দুই আসামি চন্দন ও হাসানকে সাত দিন করে এবং সন্দেহভাজন আসামি নাজমুলকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক মো. রাসেল এই আদেশ দেন।

রিফাতের উপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলার ভিডিও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছে দেশবাসী। এতে দেখা যায়, নিহত রিফাতকে লম্বা দা দিয়ে উপর্যুপরি কোপাচ্ছিলেন দুজন। তাঁদের একজন সাদা জামা পরা সাব্বির। অন্যজন কালো জামা, কালো সানগ্লাস পরা রিফাত ফরাজী। রিফাত ফরাজীর ভাই রিশান ফরাজী ও তাঁর সহযোগীরাই কলেজমাঠ থেকে মারতে মারতে রিফাত শরীফকে কলেজের বাইরের রাস্তায় নিয়ে এসেছিলেন। এ সময় কলেজের সামনের রাস্তার উত্তর ও পূর্ব পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রিশানের সেই সহযোগীরা।

পুলিশ জানিয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কলেজ রোডের বাসিন্দা টিকটক হৃদয়, ডিকেপি রোডের রায়হান, কলেজিয়েট স্কুল রোডের মুহাইমিনুল ইনলাম ওরফে সিফাত, ধানসিঁড়ি সড়কের বাসিন্দা তানভীর হোসেন এবং সোনালীপাড়া এলাকার রিফাত। তাঁরা সবাই রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আসামি। পুলিশ জানিয়েছে, এই পাঁচজনের সবাই ছাত্র। তাঁরা বিভিন্ন কলেজে পড়েন, কেউ এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন।

এ হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত দুই আসামি এবং ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরে আরেকজনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন।

নয়ন এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে এর পূর্বেও মাদকসহ নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু পুলিশ এত দিন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু কেনো তা জানতে চাইলে জেলার পুলিশ সুপার মারুফ গণমাধ্যমকে জানান, সাব্বির ওরফে নয়নের বিরুদ্ধে দুটি মাদক, একটি অস্ত্রসহ আটটি মামলা রয়েছে। আটটি মামলাতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, পরে তিনি আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। সবকটি মামলাতেই পুলিশ তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল। আর রিফাত ফরাজীর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা ছিল। তিনটিতেই তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন। এ মামলাগুলোর তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ।

আসামীদের গ্রেফতারে বরিশাল বিভাগ এবং পাশ্ববর্তী সকল জেলা ও উপজেলায় নজরদাড়ির ব্যবস্থা জোরদাড় করা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ ও সাদাপোশাকধারী পুলিশের নজরদাড়িও বাড়ানো হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাব্য সকল স্থানেই তল্লাশি চালানো হচ্ছে।

পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক সফিকুল ইসলাম বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারে শুধু বরিশাল বিভাগে নয়, সারা দেশে তৎপরতা চলছে। তারা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে, সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এমএস/