ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

হলি আর্টিজানের তিন বছর-কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

প্রকাশিত : ১২:০৪ এএম, ১ জুলাই ২০১৯ সোমবার

 

২০১৬ সালের ১লা জুলাই থেকে আজ ২০১৯ সালের ১লা জুলাই। চন্দ্র-সূর্যের পথ চলার মধ্য দিয়ে তিনটি বছর পেরিয়ে গেছে। বিভীষিকা আর বিভৎসতায় পূর্ণ অন্ধকার সেই রজনীতে ধর্মান্ধ উগ্রবাদী জঙ্গিরা কাপুরুষের মতো ২২ জন আহাররত নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। যার মধ্যে দু’জন পুলিশ সদস্যসহ তিনজন বাংলাদেশী এবং ১৭ জন ছিল বিদেশী নাগরিক, যাদের প্রায় সকলেই ছিলেন আমাদের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের সঙ্গে জড়িত। দ্রুত তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতির দুঃসহ যন্ত্রণা ও বেদনা আমাদের তাড়িয়ে ফিরছে সর্বক্ষণ। এই যন্ত্রণাময় তাড়না থেকে আদৌ কোন দিন মুক্ত হতে পারব কিনা সেই সন্দেহ প্রবলভাবে বিদ্যমান। কারণ এটিকে কোনভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার সুযোগ নেই। এর বীজ রোপিত হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। যার বাড় বাড়ন্তের যে লতাপাতা আমরা দেখছি তার শেকড় উৎপাটনের ধারে কাছেও এখন পর্যন্ত আমরা যেতে পারিনি। এটা আজ নিশ্চিত করে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং যেভাবে যাত্রা শুরু করেছিলেন তা অব্যাহত থাকলে জঙ্গি সন্ত্রাস উত্থানের কোন সুযোগ থাকতো না। অনেক আগেই বাংলাদেশ হতো একটি উন্নত সমৃদ্ধশালী অনন্য পরম সম্প্রীতির দেশ।

জার্মানীর খ্যাতিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক সিগফ্রিড উলফ ২০১৫ সালের এক গবেষণা পত্রে বলেছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের মূলহোতা দুই সামরিক শাসক, যারা সেক্যুলার রাষ্ট্রনীতির বদলে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রবর্তন এবং ধর্মের কার্ড ব্যবহার করেছেন নিজেদের বৈধতার ঘাটতি পূরণের জন্য। দুই সামরিক শাসক প্রবর্তিত ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া একদল জঙ্গি ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই ধর্মের নামে হত্যা করে ২২ জন নিরীহ মানুষকে। এমন ধর্মের নামে অপধর্মের কথা মনে এলেই একাত্তরের গণহত্যাকারী পাকিস্তানী শাসক ইয়াহিয়ার কথা মনে পড়ে, যিনি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সংলাপ চলাকালে মদের গ্লাস হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আসুন শেখ মুজিব আমরা ইসলাম রক্ষা করি (সূত্র- পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি, হুসেন হাক্কানি-পৃ. ৭০)।’ ইয়াহিয়া খানের বিকৃত হাসির দম্ভ দেখে শিল্পী কামরুল হাসান এঁকেছিলেন সেই বিখ্যাত ছবি, যার নীচে লেখা ছিল, ‘আসুন এই জানোয়ারদের আমরা হত্যা করি।’ ২০১৬ সালের পহেলা জুলাইতে হোলি আর্টিজানে আক্রমণকারী জঙ্গিরা মূলত পাকিস্তানী ওই শাসকদের বিকৃত মানসিকতার ঔরস থেকেই জন্মলাভ করেছে। এই দুর্বৃত্তদের কোন ধর্ম নেই, বিবেক মনুষ্যত্ব কিছুই নেই। এরা স্রেফ অন্ধ ও পাগল। তাদেরকে ভয়ঙ্কর পশুত্বে পেয়ে বসেছে। মা-বাবা, সন্তান-সন্তুতি কারো প্রতি এদের সামান্য মায়া-মমতা নেই। তা না হলে পবিত্র রমজান মাসে নামাজ-তারাবি বাদ দিয়ে কি করে এতগুলো নিরীহ, নিরাপরাধ মানুষকে তারা হত্যা করতে পারে।

এই নির্মমতার তিন বছরের মাথায় এসে বাংলাদেশে এই জঙ্গি উত্থানের প্রেক্ষাপট এবং তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিত। এতদিনে দেশী-বিদেশী গবেষক, লেখক, পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের বিচার-বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনীতির ভেতরেই জঙ্গিদের শেকড় নিহিত রয়েছে। এই জঙ্গিদের বহু দল, সংগঠন, নেতা থাকলেও মূল শেকড় গিয়ে মিলিত হয়েছে এক জায়াগায়, এরা বাংলাদেশকে তাদের ব্যাখ্যা মতো ইসলামিস্ট একক ধর্মের রাষ্ট্র বানাতে চায়। যার কৌশল হিসেবে তারা যেমন প্রকাশ্য রাজনীতিতে আছে, তেমনি বহু নামের সশস্ত্র সংগঠনও তৈরি করেছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারী ইসলামিস্ট দলগুলো ১৯৭৫ সালের পরে যখন পুনরুত্থানের সুযোগ পেল তখনই তারা বুঝেছিল একদিন তাদের অস্তিত্ব ভীষণ রকম সংকটে পড়বে। সুতরাং সুদূরপ্রসারি কৌশল হিসেবে তারা গোপনে সশস্ত্র সংগঠন তৈরি করে এবং প্রকাশ্যে পঁচাত্তরের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে তৈরি হওয়া মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী রাজনীতির বড় পক্ষের সঙ্গে শক্ত মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় ২০০১-২০০৬ মেয়াদে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিকে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে বিদায় জানানোর পথ বেছে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বহনকারী প্রধান দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ সকল নেতাকে একযোগে হত্যা করার জন্যে তারা ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে প্রকাশ্য দিবালোকে ভয়াবহ গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। সেদিন জঙ্গিদের লক্ষ্য অর্জিত হলে বাংলাদেশকে তারা এতদিনে আরেকটি আফগানিস্তান, আর নয়তো পাকিস্তান বানিয়ে ফেলতে পারতো। ২০ দলীয় রাজনৈতিক জোটের সঙ্গী ইসলামী ঐক্যজোটের শীর্ষ নেতারা তখন প্রকাশ্যে স্লোগান দিত- ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ বিশ্বের বিবেকবান মানুষ বাংলাদেশকে নিয়ে তখন শঙ্কা প্রকাশ করতে থাকে, যার প্রতিফলন দেখা যায় বিশ্বের নামকরা সব মিডিয়াতে। ২০০২ সালের ২ এপ্রিল ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে হেডলাইন হয়- In Bangladesh as in Pakistan, a warrisome rise of Islamic Terrorism. দুই দিন পর ৪ এপ্রিল বার্টিন লিন্টনার ফার ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউতে প্রকাশ করেন প্রতিবেদন- Be aware of Bangladesh a cocoon of Terror, অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে সাবধান, সেটা জঙ্গি আস্তানায় পূর্ণ।

বাংলাদেশকে নিয়ে Deadly Cargo শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয় টাইম ম্যাগিজনে ২০০২ সালের ১৪ অক্টোবর, সেটি লেখেন আলেক্স বেরী। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর দ্য ইকোনোমিস্ট বিশাল প্রতিবেদন ছাপায়, যার হেডলাইন ছিল- In Bangladesh religious minorities are safe only in the departure Lounge. ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জঙ্গি বাড়-বাড়ান্ত এবং পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা দেখে মনে হয়েছিল, পুরো সরকারের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী দুই মন্ত্রী নিজামী ও মুজাহিদের ওপর দিয়ে কথা বলার কেউ নেই। রাষ্ট্র জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল, যাদের গর্ভ থেকেই জন্ম হয়েছে জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিদের। এই পুরনো কথাগুলো হলি আর্টিজান ঘটনার তিন বছরের মাথায় আবার বলতে হচ্ছে এই কারণে, ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা গোষ্ঠী আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য বহু রকম ছদ্মবেশে জনগণের কাছে মায়াকান্না করে যাচ্ছে। তাই জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত হতে চাইলে আমাদের ২০০১-২০০৬ মেয়াদের কথা মনে রাখতে হবে। বিরাজমান বাস্তবতায় বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের একটা প্রভাব থাকলেও বাংলাদেশের জঙ্গিদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও তৎপরতার মধ্যে একেবারে ভিন্ন রকমের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান পর্যন্ত একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে যেসব ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করা হয়েছে সেটি এবং ওই সময়টার দিকে তাকিয়ে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় ওইসব হত্যাকাণ্ডের অন্যতম লক্ষ্য ছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ঠেকানো এবং মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজকে বাধাগ্রস্ত করা।

বৈশ্বিক অঙ্গনে আইএস (ইসলামিক স্টেট) ও আল কায়েদার উত্থান ও বিস্তারে উগ্র ধর্মান্ধতা সামনে থাকলেও এর পেছনে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির বড় খেলোয়াড়দের শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত জঙ্গি তৎপরতাকে ঘিরেও সেরকম দৌড়ঝাপ আমরা দেখেছি। সে সময়ের প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের জের ধরে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে জোরালোভাবে বলা শুরু হয় বাংলাদেশে আইএস এসে গেছে এবং আকারে ইঙ্গিতে এটা বলা যে, আইএস দমনের জন্য বাংলাদেশের উচিত বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রের সহায়তা নেওয়া। বাংলাদেশের মানুষ এখন আর অত বোকা নয়। আইএস আছে কি নেই, এই বিতর্ক তোলাই আসলে দূরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর বেশির ভাগ সিনিয়র নেতারা আশির দশকে আফগানিস্তানের জিহাদে অংশ নেয়। তারপর যেহেতু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তাই বৈশ্বিক জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের একটা যোগাযোগ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অনেক তথ্য-উপাত্ত এবং বিচার-বিশ্লেষণে দেখা গেছে আইএস ও আল কায়েদার কোন উপস্থিতি বাংলাদেশে নেই।

কলামের স্পেস সীমাবদ্ধতার কারণে ওই আলোচনায় আজ আর যাচ্ছি না। দেখা যাক হলি আর্টিজানের তিন বছরের মাথায় জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি তৎপরতা দমনে বাংলাদেশ এখন কোথায় আছে। নিঃসন্দেহে বলতে হবে জঙ্গিদের সক্রিয় বা সশস্ত্র অ্যাকশন দমনে বাংলাদেশ গত তিন বছরে উদাহরণ সৃষ্টিকারি সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে আবার একথাও বলতে হবে জঙ্গি উত্থান ও তার হুমকি থেকে বাংলাদেশ এখনও মুক্ত নয়। কারণ, জঙ্গিদের সক্রিয় অ্যাকশন ঠেকাতে আমরা যতখানি সফল হয়েছি, জঙ্গিবাদ বিস্তার রোধে তার ধারে কাছেও আমরা যেতে পারিনি। আগেই বলেছি জঙ্গিবাদের মূল শেকড় ধর্মীয় রাজনীতি, যা এখনও বহাল তবিয়তে আছে এবং এর থেকে আদৌ আমরা মুক্ত হতে পারবো কি না তা কেউই বলতে পারছে না। জঙ্গিবাদের বিস্তার ঠেকাতে রাষ্ট্র ও সমাজের সকল ফ্রন্ট থেকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাসহ যেভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার সেটি অনুপস্থিত। জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর প্রোপাগান্ডা অপপ্রচার যত পরিমাণ হচ্ছে তার বিপরীতে রাষ্ট্রের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও প্রশাসনিক ফ্রন্ট থেকে কাউন্টার আদর্শভিত্তিক কোনো ক্যাম্পেইন নেই। ফলে জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো একচ্ছত্র অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এই অপপ্রচারের শিকার হয়ে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, বলা যায় অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে। তবে আমাদের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন মোটামুটি আমরা একটা স্বস্তিকর জায়গায় আছি।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

sikder52@gmail.com