নিঃসঙ্গ অসহায় এরশাদ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:৫০ পিএম, ১ জুলাই ২০১৯ সোমবার

রাজনৈতিক, কবি, প্রেমিক, রাষ্ট্রনায়ক, সৈনিক এসব পরিচয়ে পরিচিত হতেই পছন্দ করেন তিনি। কখনও নিজে আত্মহত্যা করবেন বলে মিডিয়ার কর্মীদের ডেকে আয়োজনের কথা বলেছেন আবার কখনও প্রিয় মানুষ বা দলের নেতাকর্মীদের সাথে আড়ি পেতে বন্ধ করেছেন কথা।
তিনি বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্তমান বিরোধী দলের নেতা এবং জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
সেই এরশাদ এখন হাসপাতালের বেডে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। শুয়ে শুয়ে যেন মৃত্যুদূতের সাক্ষাতে অপেক্ষা করছেন। এক সময়ের প্রতাপশালী, প্রতিপত্তি, ক্ষমতার অধিকারী আর রোমান্টিক এরশাদ আজ যেন অসহায়, নিঃসঙ্গ। তিনি কারও সাথে কথা বলছেন না, কারও কথা শুনছেন না, একাই যেন ছুটে চলছেন সেই অন্তিম গন্তব্যে। যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে তিনি চরম মৃত্যু ভয়ে ছিলেন। শরীরের এ অবস্থায় তিনি নিজেই নিজের জন্য কবর দেখতে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন।
জানা গেছে, রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় কবর খোঁজার জন্য ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে পরামর্শ দিয়েছেন এরশাদ। এ নিয়ে তারা কবরের জন্য একাধিক সম্ভাব্য স্থান সরেজমিনে দেখেছেন।
কবরের সন্ধানে যাওয়া কয়েকজন জানান, এরশাদের ইচ্ছা মৃত্যুর পর যেন ঢাকায় তাকে সমাহিত করা হয়। সেক্ষেত্রে কবরের কাছে যেন মসজিদ, মাদ্রাসা থাকে। এ রকম উপযুক্ত স্থান পাওয়া না গেলে রংপুরে সমাহিত করার কথা জানিয়ে রেখেছেন তিনি।
জানা যায়, এরশাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ইতিমধ্যে বনানী কবরস্থানে স্থায়ী জায়গা কেনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বিকল্প হিসেবে রাজধানীর বারিধারায় আমেরিকান সেন্টারের কয়েকশ গজ উত্তরে একটি মাদ্রাসা ও এতিম খানার কাছে জায়গা দেখা হয়েছে। এছাড়া পূর্বাচলের কাছেও একটি জায়গা দেখে এসেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কোনোটিই এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
সদা পরিপাটি ও প্রেমিক মনের সেই এরশাদের অবস্থা এখন চরমভাবে সংকটাপন্ন। চলতি বছরটা তার শুরুই হয়েছে চরম অসুস্থতা নিয়ে। অসুস্থতার কারণে গেল বছরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের প্রচারণায় অংশ নিতেও পারেননি তিনি। তবে গত ২৬ জুন তার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হওয়া ঢাকা সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অক্সিজেনের সাহায্যে নিশ্বাস নিচ্ছেন। অবচেতন এবং নিথর দেহ তার।
গত বুধবার সকালে হাসপাতালে ভর্তির পর অবস্থার দৃশ্যমান কিছুটা উন্নতি মনে হলেও গতকাল রোববার ভোর থেকে তার অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে। তার ফুসফুসে ইনফেকশন ধরা পড়েছে। ফুসফুসে পানি জমেছে, ফলে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। চিকিত্সকরা কৃত্রিম উপায়ে তাকে অক্সিজেন দিয়ে রেখেছেন।
জানা যায়, চিকিত্সকরা দুই দফায় বোর্ড বসিয়েছেন। চিকিত্সার জন্য অর্থের কোনো সংকট হবে না। তিনি বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক সেনাপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাবেন বলে জানান তার দলের জ্যেষ্ঠ এক নেতা।
সেনাবাহিনীকে করায়ত্ত করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন একনায়ক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বয়স এখন নব্বইয়ের কোঠা পার করে গুরুতর অসুস্থ। কথা প্রায় বন্ধ।
তার শাসনামলে রাজপথে ছাত্র আন্দোলন রুখতে নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। রক্তাক্ত হয়েছিল রাজধানী। আশির দশকের সেই ঘটনার পরেই গণতন্ত্র রক্ষার দাবিতে উত্তাল হয়েছিল বাংলাদেশ। আন্দোলনই তাঁকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে এনেছিল।
এরশাদের অসুস্থতা বয়স জনিত কারণেই। তবে কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থাকা ৯১ বছরের সাবেক জেনারেল এরশাদ গত জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েও ভোটের আগেই অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুর চলে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তাঁর দল জাতীয় পার্টি (জাপা)-কে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী পক্ষ হিসেবে সহমতি দেন।
১৯৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সাবেক এ সেনা প্রধান রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এরশাদ।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। ঐ দিন তিনি দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ.এফ.এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে নিজের অধিকারে নেন। এরশাদ দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন এবং ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই দলের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৮৬ সালে বিতর্কিত এক নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতি ৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে এই সংসদ বাতিল করেন। ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচন সকল দল বয়কট করে। এরশাদের স্বৈরাচারের বিরূদ্ধে দেশের জনগণকে সাথে নিয়ে সকল বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এরশাদ গ্রেফতার হন এবং ১৯৯৬ তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত কারারূদ্ধ থাকেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি কারাগার থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। তৎকালীন সরকারী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তার বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে কয়েকটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন।
১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ছয় বছর আবরুদ্ধ থাকার পর ৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার মধ্যে মূল ধারার তিনি চেয়ারম্যান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তার দল এবং স্ত্রী রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হন।
এমএস/