ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

শামুকের খোড়লে শব্দের কবি রবীন সমদ্দারের জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি

হেনরি স্বপন

প্রকাশিত : ০১:১৩ পিএম, ১০ জুলাই ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ০১:১৬ পিএম, ১০ জুলাই ২০১৯ বুধবার

গান্ধিজীর অহিংস আধ্যাত্মবাদী ও আজীবন শ্রেণী সমন্বয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা তখনকার মহান বিপ্লবী কেদারনাথ সমদ্দারের জেষ্ঠপুত্র কবি রবীন সমদ্দার। মাতা রেনুকণা সমদ্দারের এই প্রথম সন্তান ১৯৪৫-সালের ১৪-অক্টোবর বরিশালের নারায়নপুর গ্রামে জন্মেছিলেন।

পিতার শিক্ষাকতা পেশাকে অনুসরণ করে কবি নিজেও বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষাকতা পেশাকেই। ১৯৭০-এ পাতারহাট আরসি কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্ম জীবনের শুরু। ১৯৬১-তে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি আরম্ভ করেন। তখন জেলা পরিষদের পাক্ষিক পত্রিকা ‘বরিশাল দর্পনে’ নিয়মিত তার লেখা ছাপা হত।

রণেশ দাশগুপ্ত সম্পাদনার সময় সংবাদ সাময়িকীতেও নিয়মিত লিখতেন। ১৯৬৮-সালে সমির দত্ত সম্পাদিত ‘উত্তরা’ পত্রিকায় প্রথম গল্প ছাপা হয়। এছাড়াও সওগত, মাহেনাও, পূর্বানী, চিত্রালী, বিচিত্রা, রোববার এবং অন্যধারার কাগজ সমকাল, কণ্ঠস্বর, পূর্বাচল, জনান্তিক, সময়, কালস্রোত, কালপুরুষ, বিকাল, ধারাপাত, সুনীল করতল, কিছুধ্বনি, মিজানুর রহমান ত্রৈমাসিক, সাহিত্যপত্র, জীবনানন্দ, আরণ্যক ও আরও অনেক ছোট কাগজে লিখেছেন একাধিক গল্প-উপন্যাস-কবিতা ও প্রবন্ধ।

কবি রবীন সমদ্দার ষাটের অন্যান্য কবিদের থেকে ভিন্নমাত্রার কাব্যধারায় কবিতা লিখেছেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অন্বেষণের মাধ্যমে নিজের যে একক কাব্যধারা র্সৃষ্টি করেছিলেন, তা কেবল উপমাবহুল চিত্রকল্প রূপক এবং আঙ্গিকের ক্ষেত্রেই নয়--কবিতার শরীরে (কমা দাড়ি সেমিকোলন ) অর্থাৎ বিরামচিহ্নের কোনো ব্যবহারই ছিলো না তার অজস্র কবিতায়।

একক কাব্যশৈলির সাবলিলতায় ঋদ্ধ সমগ্রীক এই কবি যেনো মেধাবী নির্মাণের গভীরতম অস্তিত্বের ক্ষত থেকে উৎসারিত ছিলেন সর্বদাই। তাই, উপনিবেশিক নির্যাতন, ক্ষুধা-যন্ত্রণাপিড়িত দেশকাল, প্রেম, প্রকৃতির গভীর আনুধাবন, ভয়াবহ ক্ষোভ ও স্বাধীনতার প্রতি তীব্র পক্ষপাত এবং শত্রুর প্রতি প্রবল ঘৃণার বহি:প্রকাশ এমন সব কিছুই তার কবিতার বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

অপ্রচলিত দেশী ও বিদেশী ভাষা ব্যবহারের ফলে তার কবিতার সমস্ত ডিকশন হয়তো কিছুটা দুরূহ। ফলে কবির অধিকাংশ কবিতাই কাব্যশিল্পের স্বল্পসংখ্যক পাঠকের জন্য বরাবরই তৃপ্তিকর। কেননা, রবিন সমদ্দারের সাহিত্যের প্রধান রশদ হচ্ছে, ক্লাসিক পরিপাট্যতা। প্রথাগত যে কোনও আঙ্গিকের গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে বরং প্রথা ভাঙার সমস্ত কৌশল সচেতনভবেই তিনি টেক্সট-স্টাইল ও মেটাফরের মাধ্যমে ব্যবহার করেছেন।

কবি নিজে ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন বলেই পাশ্চাত্য আধুনিকতার ডিকশনগুলো আত্মস্থর পাশাপাশি আমাদের যাবতীয় বাংলাসাহিত্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে সর্বদাই সচেতন ছিল তার কাব্য চিন্তন। ফলে পাশ্চাত্য ও স্বদেশী এই দ্বি-মিশ্রিত জ্ঞানের পরিধিই ছিল তার নিজস্ব কব্যবৈশিষ্ট নির্মানের প্রধান হাতিয়ার। তবে, সর্বপরি এও বলা যায়, কবি রবীন সমদ্দার খ্যাতি-অখ্যাতির প্রলোভনে কবিতার নিজস্ব বন্ধন অনুভূতিকে কখনোই প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়যোগ্য পণ্য করে তোলেননি।

এ পর্যন্ত কবির প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র পাঁচটি : ‘শূন্যতায় গাথা ভালবাসার কবিতা’ (১৯৯১), ‘স্বপ্নের আলিন্দ’ (১৯৯৪), ‘হে সময়গ্রন্থি’ (১৯৯৭), একটিমাত্র উপন্যাস ‘অতলান্ত’ (১৯৬৮)। তবে, প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলির একত্রীকরণ একটি ‘কবিতা সমগ্র’ (২০০৪) প্রকাশিত হলেও কবির আধিকাংশ সৃষ্টিই আজও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে।

প্রিয় এই মানুষটি আমাদের মাঝে নেই কিন্তু রয়ে গেছে তার অজস্র সৃস্টি। ২০০৪-সালের ১০-জুলাই উজ্জ্বল দুপুরের পবিত্র আলোয় কবির শেষ নি:শ্বাস আমাদের হৃদয়ে উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়ে তিনি চলে গেছেন অনন্যালোকে...!

এমএইচ/