ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ওজনে কম ও সময়ের আগে জন্ম নেয়া শিশু অন্ধ হয়ে যেতে পারে!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৩২ পিএম, ১০ জুলাই ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ১০:৫৮ পিএম, ১০ জুলাই ২০১৯ বুধবার

নবজাতক বা ছোট শিশুর চোখের সমস্যা থাকতে পারে এ কথা কেউই আমলে নেই না। একটু সুস্থ হোক বা একটু বড় হোক তারপরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব-এ রকম ভাবনা সবার ভেতরে কাজ করে। কিন্তু এই অবহেলায় ছোট বাচ্চাটি যে অন্ধ হয়ে যেতে পারে তা ভেবেছেন কি?

এ বিষয়টি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেটিনা বিশেষজ্ঞ ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, চোখের বড় ধরনের সমস্যাকে আমরা প্রথমত ছানিযুক্ত সমস্যা বা বড়দের অন্ধত্বকে বুঝি। বিশেষ করে ছোট একটি বাচ্চা অন্ধ হতে পারে বা অন্ধ হবার মত বড় কোন রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সচেতন নই।

একটি ছোট বাচ্চা হবার পরে তার চোখটি পরীক্ষা করাতে হবে। যদি কোন সাদা দেখা যায় তবে সেটি ভয়াবহ কোন রোগের লক্ষণ হতে পারে। সুতরাং চোখটি পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। যে কারণগুলোর জন্য সে চোখে নাও দেখতে পারে তার ভেতর একটি হচ্ছে রেটিনোপ্যাথি ও প্রিমেচ্যুয়েরিটি।

এই রোগটি শুধুমাত্র যে বাচ্চা দুই হাজার গ্রাম অর্থা দুই কেজির কম ওজনের অথবা ৩৫ সপ্তাহ গর্ভাবস্থায় না থেকে তার আগেই জন্মে যায় তাদের ক্ষেত্রে হবে। সুতরাং যারা ফুটকার বেবি অথবা যারা মায়ের পেটে ৪০ সপ্তাহ বা ৩৮ সপ্তাহ থেকে এসেছে তাদের ক্ষেত্রে এই রোগ  ঝুঁকিপূর্ণ নয়।

কেবলমাত্র স্বল্প ওজন এবং ৩৫ সপ্তাহের আগে জন্ম নেয়া বেবির ক্ষেত্রে এটা হতে পারে। এ দুটোতেও হতে পারে অথবা একটিতে হতে পারে। বিশেষ করে যে বাচ্চাগুলো এনআইসিউতে থাকে তারা অক্সিজেন পায়, তাদের শ্বাসের সমস্যা থাকে। জন্মের পরে তাদের কষ্টকর একটা সময় যায়। এরাই অন্ধত্বের বেশি ঝুঁকিতে থাকে।

এই রোগটা কি এবং কেন?

এ সম্পর্কে ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, ৩৫ সপ্তাহের আগে জন্ম হলেও একটি বাচ্চার চোখের গঠন তৈরি হয়ে যায় কিন্তু রেটিনার লেয়ারগুলো তৈরি হলেও যে রক্তনালিগুলো তৈরি হওয়ার কথা সে নালিগুলো পরিপূর্ণভাবে রেটিনার পুরোটাতে তৈরি হয় না। যে বাচ্চা পরিপূর্ণ সময় নিয়ে আসবে তার রেটিনা প্রায় পরিপূর্ণ বা পূর্ণ রেটিনা থাকবে। কিছুটা কম থাকলেও আস্তে আস্তে পরিপক্ক হয়ে যাবে। যে বাচ্চাটির বয়স ৬ মাস, ৭ মাস বা ৮ মাস তার রক্তনালী সব দিক থেকেই কম।

এ ক্ষেত্রে দূরবর্তী টিস্যুর কি হবে? একটি লিভিং টিস্যু অর্থাৎ যে টিস্যুটি জীবন্ত সে টিস্যুটিতে রক্ত যাবে না, তাহলে অক্সিজেন যাবে কি করে? নিউট্রেশন যাবে কি করে? অক্সিজেন ছাড়া কোন লিভিং টিস্যু বেঁচে থাকতে পারে না।

তখন এই অক্সিজেনবিহীন রেটিনা বা অ্যাবসকুলার রেটিনা যা আমরা ইস্কিমিক রেটিনা বলে থাকি, তাদের রক্ত নাই, অক্সিজেন নাই এরা তখন অক্সিজেন চায়। কিভাবে চায়? তারা তখন কেমিক্যাল রেইজ করে, কেমিক্যালগুলো গিয়ে যেটুকু রক্তনালী আছে সেটুকু ইস্টিমুলেট করে, তাকে আরও উৎসাহিত করে নতুন রক্তনালী তৈরি করতে।

রক্তনালী তৈরি হয়েও থাকে কিন্তু এভাবে আর্টিফিসিয়াল রক্তনালী স্বাভাবিক রক্তনালীর মতো নয়। তারা অক্সিজেন বা পুষ্টির যোগান দেয় না, উল্টো রক্তক্ষরণ ঘটায়। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, যেটুকু রেটিনা তৈরি হয়েছিল একটা সময় গিয়ে সেই রেটিনাকে ছিড়ে সে তুলে ফেলে। অর্থাৎ তখন বাচ্চাটা অন্ধ হয়ে যায়।

আমি স্পষ্ট করে বলছি, এই অন্ধত্বের সার্জারি করতে পারলেও সার্জারির রেজাল্ট ভালো হয় না। অর্থাৎ এই বাচ্চা স্বাভাবিক চোখের দৃষ্টি পাবে না।

অবস্থায় করণীয় কি?

ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, আমাদের করণীয় হচ্ছে যে, ব্যধিটি হয়েছে এবং রেটিনা ছিঁড়ে গেলো এর মাঝখানে একটি গোল্ডেন পিরিয়ট বা স্বল্প সময় থাকে। এর মধ্যে বাচ্চাকে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে আনতে হবে। যদি আমরা দেখি ডেঞ্জেরাস নতুন ভেসেলগুলো তৈরি হয়েছে তখন ওই জায়গায় লেজার করে দিতে হবে অথবা একটা ইঞ্জেকশন আছে ইন্ডিভিটেভ তা পুশ করতে হবে।

যে বাচ্চার ওজন ২ হাজার গ্রামের মধ্যে এবং ৩৫ সপ্তাহের আগে জন্মেছে তাদেরকে  ৩০ দিনের মধ্যে রুটিন স্ক্রিনিং করতে হবে। আর একটি কথা হচ্ছে যারা ১২শ’ গ্রামের মধ্যে বা ২৮ সপ্তাহের আগে জন্মেছে তাদেরকে কিন্তু ৩০ দিনের মধ্যে আনলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। এদেরকে আনতে হবে ২০ দিনের মধ্যে।

তিনি আরও বলেন, মায়েরা আসতে চান না অসুস্থতার কারণে। দাদি-নানীরা দিতে চান না কিংবা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে তারা বেড়ুতেই চান না। ভেতরে ভেতরে কিন্তু বাচ্চাটা অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হচ্ছে, এই বাচ্চাটার স্বাভাবিক জীবন ও স্বাভাবিক দৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল। ২০ দিনে বা ৩০ দিনে আসলো না বলে তারা অন্ধ হয়ে যায়। কি আফসোসের কথা!

সুতরাং মনে রাখতে হবে নবজাতক যারা আগে হয়েছে এবং কম ওজনের তাদেরকে একবার চোখের ডাক্তার দেখাতে হবে এবং শুধু চোখের ডাক্তার নয় বিশেষজ্ঞ যারা রেটিনা স্পেশালিস্ট তাদের মধ্যে যারা আরওপি বিশেষজ্ঞ তাদের কাছে নিয়ে আসলে খুবই ভালো হবে।

চার মাস বা পাঁচ মাস পর মায়েরা যখন সাদা চোখ দেখেন তখন নিয়ে আসেন। তখন কিন্তু করার কিছুই থাকে না। সুতরাং বাচ্চাগুলোর চিকিৎসা করাতে হলে ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে নবজাতককে অবশ্যই রেটিনা স্পেশালিস্টদের কাছে নিয়ে আসতে হবে।

আপনাদেরকে আমরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই যে, বাংলাদেশে এখন সফলভাবে আরওপির সমস্ত স্টেইজে, সমস্ত কন্ডিশনে এমনকি যখন রেটিনা ছিড়ে যাচ্ছে তারও চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল ভাল হবে যত আগে আসবেন, যত সময়মত আসবেন তার উপর।

অর্থাৎ ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে বাচ্চাকে আনলে এই রোগের লক্ষণ যদি দেখতে পাই, তখন থেকেই যদি চিকিৎসা শুরু করতে পারি, তাহলে বাচ্চাগুলো অন্ধ তো হবেই না বরং তারা স্বাভাবিক দৃষ্টি পাবে, স্কুলে যাবে, স্বাভাবিক জীবন পাবে।

সুতরাং এক্ষেত্রে সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। তেমনি প্রসূতি বিদ্যার ডাক্তার এবং যারা শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ বিশেষ করে যারা নবজাতকের চিকিৎসা করেন তাদেরও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। তারা যদি এই রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে অভিভাবকদের জানান এবং যাদের বাচ্চা ওজনে কম ও আগে হয়ে গেছে তাদেরকে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার নির্দেশ দেন, তাহলেই নবজাতকের অন্ধত্বের বড় কারণ আমরা মুছে ফেলতে সক্ষম হবো।

এএইচ/কেআই