ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জাবিতে হল নির্মাণে কাটা পড়ছে সহস্রাধিক গাছ

জাবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৮:৪৬ পিএম, ১১ জুলাই ২০১৯ বৃহস্পতিবার

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় পাঁচটি হল নির্মাণে কাটা পড়তে যাচ্ছে সহস্রাধিক গাছ। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

জানা যায়, ছেলেদের জন্য ৩টি ও মেয়েদের ২টিসহ মোট পাঁচটি হল নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকৃত জায়গায় রয়েছে বটগাছ, একাশীয়া, শালবৃক্ষ, বিভিন্ন ফলজ গাছসহ প্রায় ১১৩২টি গাছ। হল নির্মাণে কাটা পড়বে এই সহস্রাধিক গাছ।

এদিকে জীববৈচিত্র রক্ষায় সম্প্রতি ‘অপরিকল্পিতভাবে’ শিক্ষার্থীদের হল নির্মাণের জন্য যে স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে তা পুনঃনির্ধারণের দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ ভবনের শিক্ষক লাউঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ এবং প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস না করে কার্যকর উন্নয়নের দাবি জানিয়েছে ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্যমঞ্চ’।

এছাড়া গত সোমবার একই ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল করে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাত করে এবং ৭ দফা দাবিতে স্মারকলিপি দেয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্যমঞ্চ। একইদিনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা অপরিকল্পিতভাবে হল নির্মাণের প্রতিবাদে উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করে স্মারকলিপি প্রদান করে।

প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, গত ৩০জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪৪৫ কোটি টাকার ২৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১০তলা বিশিষ্ট পাঁচটি হল নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়। ছাত্রদের তিনটি হল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে নির্মাণের জন্য জায়গা নির্ধারণ করে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের দক্ষিণ পার্শ্বে (টারজান পয়েন্ট) ছাত্রীদের জন্য দুটি হল নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, এ হলগুলো নির্মাণ করতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের উত্তরে (শান্তিনিকেতন) ৫৩৯টি গাছ কাটা পড়বে। যেখানে ফলজ গাছের মধ্যে ৬৩টি গোলাপজাম, ১৭টি অমলকি, ২৩টি কামরাঙা, ১২টি চালতা গাছ ছাড়াও রয়েছে প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির বিভিন্ন গাছ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পূর্বে নির্ধারিত জায়গায় হল নির্মাণের জন্য কেটে ফেলতে হবে ৩৫৮টি গাছ। যেখানে কিছু সংখ্যক কাঠগাছ ছাড়া রয়েছে মেহগনি ও বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পূর্বে পার্শ্বের খেলার মাঠেও হতে যাচ্ছে আরেকটি হল। মাঠের মধ্যে হল নির্মাণের ফলে মাঠের পাশে ২৮টি গাছ কাটা পড়ছে। আবার হলের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য জায়গা হিসেবে থাকছেনা কোনো খেলার মাঠ।

এদিকে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের দক্ষিণ পার্শ্বে (টারজান পয়েন্ট) ছাত্রীদের জন্য দুটি হল নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে একটি বটগাছ, ১৭৮টি কাঠাল গাছসহ রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২০৭টি গাছ।

ফলে পাঁচটি হল নির্মাণের কারণে সর্বমোট এক হাজার ১শত ৩২টি গাছ কাটা পড়বে। গাছ কেটে হল নির্মাণের সিদ্ধান্তকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বার্থ পরিপন্থী’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী অলিউর রহমান সান বলেন, উন্নয়ন মানে আজকাল শুধুই বহুতল অবকাঠামো নির্মাণ হয়ে দাড়িয়েছে। প্রাণ-প্রকৃতির উন্নয়নের বদলে যত্রতত্র দালান নির্মাণ করে উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের অবকাঠামো প্রয়োজন কিন্তু হাজারো গাছের প্রাণের বিনিময়ে, ছোট ছোট জীবের আবাস ধ্বংস করে নয়।

এ বিষয়ে জাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. সোহেল রানা বলেন, মহাপরিকল্পনা উন্মুক্ত থাকলে সবাই মতামত দিতে পারতো। উপাচার্য বলেছেন- সবাইকে নিয়েই উন্নয়নের কাজ শুরু করবে। কিন্তু আমরা সেরকম দৃষ্টান্ত পাইনি। ঘুরেফিরে কিছু লোকজনই এই কার্যক্রম ও কাজগুলো পরিচালনা করে। এখানে শিক্ষক সমিতি, অফিসার সমিতি, কর্মচারী সমিতি, সিনেট সদস্যরা থাকতে পারতো। তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তো এবং স্বচ্ছতাও থাকত।

তিনি আরো বলেন, আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, ভূ-প্রকৃতি ও সৌন্দর্য যেন কোনোভাবে বিঘ্নিত না হয়। অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটাকে আমরা কখনোই সমর্থন করিনা। শিগগিরই আমরা শিক্ষক সমিতি এটা নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা করব।

এদিকে নাম প্রকাশ না করে ভিসিপন্থি এক শিক্ষক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে হল নির্মাণের জন্য অনেক ফাঁকা জায়গা রয়েছে। কিন্তু প্রশাসন ওই সকল জায়গা বিবেচনায় না নিয়ে গাদাগাদি করে হল নির্মাণ করছে। যা অদূর ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ হবে। হলগুলো একই মুখী ও কাছাকাছি হওয়ায় ছাত্রদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অপরিকল্পিত কাজ অদূরদর্শী প্রসূত। কেননা মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন অনুযায়ী পুনঃনিরীক্ষণ হবে এটাই নিয়ম। পৃথিবীতে যেকোনো স্থাপনার পরিকল্পনা করা হলে এর পরিবেশ এবং এর ইকোসিস্টেমকে প্রাধান্য দিয়েই করা হয়। পরিকল্পনা করার সময় পরিবেশের অবস্থা পর্যালোচনা করে সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে। তা সমাধানের মাধ্যমে স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে। প্রশাসন এই অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ বন্ধ করে মহাপরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে বলে দাবি করেন তিনি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনা প্রকাশ করেনি বিষয়টি সত্য নয়। তবে প্রশাসন যা ভাল মনে করেন তাই করছেন বলে জানান তিনি।

যোগাযোগ করা হলে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, মহাপরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়নি বিষয়টি সত্য নয়। গত সাড়ে তিনবছর ধরে সিনেটসভা সহ বিভিন্ন মাধ্যমে উন্নয়নের পরিকল্পনার বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে এবং গত ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে কনসার্ট অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘থ্রি-ডি মাস্টার প্ল্যান’ সকলকে দেখানো হয়েছে। কিন্তু তখন কোনো ধরণের সহযোগীতা বা পরামর্শ আমরা পাইনি। এখন কেন বলছেন ত্রুটি আছে? তাহলে কি আপনারা বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করছেন? চূড়ান্ত হয়ে একনেকে পাশ হওয়া পরিকল্পনা পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে জানান উপাচার্য।

গাছ কেটে হল নির্মাণের বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু গাছ কাটা যাবে তার মধ্যে একাশীয়া, কামরাঙ্গা বা জামরুল গাছ রয়েছে। যেসব গাছ পরিকল্পিতভাবে রোপনের তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ফলন দিবে। তবে যেখানে বৃক্ষ আছে সেখানে আমরা চিন্তাভাবনা করে পরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ করছি।

উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতিপূর্বে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) ও ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইআইটি) জন্য ২০১৭ সালের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে দুটি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। তখন বরাদ্দ পেয়ে ৩৫-৪০টি গাছ কেটে ফেলে আইবিএ। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের থ্রি-ডি মহাপরিকল্পনায় আইবিএ’র জন্য নির্ধারিত জায়গাটি সবুজ অভয়ারণ্য হিসেবে নির্ধারণ করায় স্থান পরিবর্তন করে প্রশাসন।

এছাড়া আইআইটি’র জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় একটি জলাশয়ের ওপর। তার ওপর ভবন নির্মাণ করা হলে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ বাধার সম্মুখীন হবে এবং পাখিরা আবাস হারাবে -এমন আশঙ্কা করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বাতিলের দাবি জানালে স্থানটি পরিবর্তন করা হয়।

এনএস/এসি