ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সৈয়দ শামসুল হকের অপ্রকাশিত কথা (ভিডিও)

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:০১ পিএম, ১২ জুলাই ২০১৯ শুক্রবার

বাংলা ভাষার বরেণ্য কবি ও কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক। কবিতা উপন্যাস নাটক ছোটগল্প তথা সাহিত্যের সব শাখায় স্বতঃস্ফূর্ত পদচারণার জন্যে সব্যসাচী লেখক হিসেবে সুপরিচিত। মাত্র ২৯ বছর বয়সে এ যাবৎকালের সর্বকনিষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ সবোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকসহ তিনি লাভ করেছেন স্বাধীনতা পদক, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, পদাবলি কবিতা পুরস্কার, নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদকসহ আরো বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। বরেণ্য এই গুণীজনের নামেই কোয়ান্টামমের মুক্তমঞ্চ ‘ঐকতান’ এর নামকরণ হয় ‘সৈয়দ হক’ মঞ্চ।

কোয়ান্টাম মেথড কোর্সের ৪০০তম ব্যাচের প্রত্যয়ন অনুষ্ঠানে তিনি কোর্স ও ফাউন্ডেশন নিয়ে তার উপলব্ধি আর অভিজ্ঞতার কথা বলেন।

তার সেই বক্তব্যের অনুলিখন-

আমি সৈয়দ শামসুল হক। বাংলা ভাষায় লেখার চেষ্টা করে আসছি ষাট দশকের উপরে। আপনাদের সবার ওপরে শান্তি বর্ষিত হোক।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, গানে আছে, বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি। হাফিজের কবিতাতেও আছে, শান্তির বারি এই হৃদয়ে বর্ষিত হোক।

সবার কল্যাণ হোক। আর আমি অভিবাদন করি, যাকে গুরুজী নামে আমরা ডাকছি। যিনি মহাজাতক, তিনি শহীদ আল বোখারী এবং আমার অনেক দিনের বন্ধু। তিনি অগণিত মানুষের, মানব সংগঠনে যে মহাশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছেন, এইজন্যে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।

এখানে আপনাদের অংশগ্রহণকারীদের মুখে বক্তব্য শুনে আমার মনে হচ্ছিল, ছোটবেলায় শবেকদরের রাতে সৃষ্টির সমস্ত কিছু নাকি সেজদা যায়, এক পলকের জন্যে। এটি বাবার কাছে, চাচার কাছে, বড় বাবার কাছে শুনেছি। তো অপেক্ষা করেছি সাতাশে রমজান তারিখে। রাতের পর রাত। দেখার জন্যে। আর সৌভাগ্যক্রমে আমার জন্মও কিন্তু সাতাশে রমজান তারিখে। তো একটু স্বাধীনতা পেতাম জন্মদিনে। ইসলামী মতে, সাতাশে রমজানের জাতক আমি। কিন্তু দেখার সৌভাগ্য হয়নি।

আজকে আপনাদের মুখে যে সফলতার কথা শুনলাম, তাতে মনে হলো, যে বিস্ময় আমি দেখি নি, তার চেয়েও বড় না হোক, তার কাছাকাছি বিস্ময় এখানে দেখ্লাম। যা আপনারা আপনাদের মনের শক্তিকে বাড়িয়ে, সবদিক থেকে, জীবনে আমাদের যত অভাব রয়েছে,  যত ব্যর্থতা রয়েছে, সেগুলোকে উত্তরণের যে ইতিহাস, যে ঘটনাগুলো আপনারা বললেন, আমি হতবাক হয়ে গেছি। এবং আমার মনে হলো, আমি সেই বিস্ময় প্রত্যক্ষ করছি, যে বিস্ময় আমি সেই শিশুকাল থেকে অপেক্ষা করেছি দেখবার জন্যে।

সক্রেটিস বলেছেন, know thyself. নিজেকে জানো। নিজেকে জানো মানে কি? নিজের মনের শক্তি অনুভব করো।

আমাদের ভক্তজনের গানে পাই, মন তুমি কৃষিকাজ জানো না। যদি জানতে, তাহলে ফলতো সোনা। তার মানে কি, মন ব্যবহার করতে পারি নি।

লালন কি বলেছেন তার গানে, বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা,  আর এক কানা মন আমার, এসব দেখি কানার হাট-বাজার। তার মানে কেউ আমরা মনকে ব্যবহার করতে পারি নি। মনের শক্তিকে অনুভব করতে পারি নি। কাজেই এটা কানার হাট-বাজার। আমার খুব প্রিয় গান । আমি মাঝেমাঝেই রাতে এটা শুনি।

এই মনের শক্তি অনুভব করেছি আমার ব্যক্তিগত জীবনে। ১৮ বৎসর বয়সে আমার বাবা ইন্তেকাল করলেন। তিনি গ্রামের ডাক্তার ছিলেন। সামান্য মানুষ। সাত সাতটা ভাইবোন রেখে তিনি চলে গেলেন সকাল ৯ টায়, বিকেল চারটায় তাকে দাফন করে বাড়িতে এসে, সারাদিনের প্রথম একগ্লাস চা হাতে নিয়েছি, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, সামনে  আমার সাতটা ভাই বোন, আমার ছোট, তারা পাখির মতো বসে আছে। আমার মা মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছে। আমি বললাম যে, এসবের দায়িত্ব এখন আমার!

কিন্তু একই সঙ্গে আমার মন বলল, আমি পারব। আমি পারব, পারব, এটা আমার মন বলল। বিশ্বাস করুন, এক মূহূর্তের জন্যেও  আমার মনে হয়নি যে আমি পারব না। আজকে এত বছর পরে ১৯৫৪ সালের কথা বলছি, আজকে যা দেখছেন আমাকে বা আমার ভাইবোনদের, তারা কেউ চোর নয়, বাটপার নয়, সমাজের ক্ষতিকর মানুষ নয়। প্রত্যেকে শিক্ষিত, ভদ্র, এবং বৈধ উপার্জন করছে। এবং প্রত্যেকের নিজের বাড়ি রয়েছে ঢাকা শহরে। এতিম সাতটা ভাইবোন। আমি পারব পারব পারব বলেছিলাম, আমি পেরেছি।

আমি লেখক হতে চেয়েছিলাম, আমার বাবা চেয়েছিলেন আমাকে ডাক্তার করতে। আমি বলেছি না, আমি লেখক হবো। বাবা আমাকে বহুরকম চাপ দিয়েছেন। বলেছেন তুমি বিজ্ঞান পড়তে ভয় পাও বলে তুমি ডাক্তারি পড়তে চাচ্ছ না। আমি বিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে, ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় জগন্নাথ কলেজে ১৯৫১ সালে ১১০০ ছাত্রের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বাবাকে দেখিয়ে আমি বললাম, বাবা আপনি দেখুন, আমি বিজ্ঞানেও ১১০০ জনের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছি, কিন্তু আমি লেখক হব। বাবা বললেন না তুমি বিজ্ঞান কন্টিনিউ করো । আমি বাড়ী পালিয়ে গেলাম। দেড় বছর পরে, বাড়ীতে যখন ফিরে এলাম, বাবা বললেন, আচ্ছা যেহেতু তুমি লেখক হতে চাও, ঠিক আছে তুমি আর্টস পড়ো, তুমি লেখ, কিন্তু একটা শর্ত, কি শর্ত? তুমি মানুষের কথা লিখবে, আর লিখবে সবচেয়ে ভালো কলমে, সবচেয়ে ভালো কাগজে। অর্থাৎ তিনি আমার ভিতরে  একটা আত্মমর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

আপনারা অনেকেই বলেছেন কিভাবে এই কোর্সে এলেন, আমার আসাটা বলেই আমার বক্তব্য শেষ করব। সেটা হচ্ছে, মহাজাতকের সঙ্গে আমার একটা মেন্টাল টেলিপ্যাথি হয়েছে। যার জন্যে আমি এসেছি।

কি রকমভাবে? চল্লিশ বছর আগে আমার সঙ্গে ওনার পরিচয়। তখন উনি কালো জামা কালো পাজামা পড়তেন। কালো হচ্ছে সমস্ত রংয়ের অনুপস্থিতি। তারপর ওকে দেখেলাম সাদা জামা সাদা পাজামায়। সাদা হচ্ছে সমস্ত রংয়ের উপস্থিতি। যার মধ্যে সব রং রয়েছে। এই পোশাক উনি ধারণ করেছেন। ওনার সব খবর দূর থেকে আমি পেতাম, উনি আমার সব খবর পেতেন। এভাবেই চলেছে।

তারপর কি হলো হঠাৎ একদিন, এই মানুষটা যার সাথে চল্লিশ বছর আগে আমার পরিচয়, যার সাথে চল্লিশ বছর থেকে আমার আত্মিক একটা সম্পর্ক, তিনি বোধ হয় আমাকে ডাকছেন। একটা মানসিক বার্তা পেলাম।

মনের এটাও একটা অসীম ক্ষমতা।  মানসিক বার্তা পাঠানো যায়, পাঠানো সম্ভব, এবং পাওয়া সম্ভব। এই বার্তা আমি ওকে কতটা পাঠিয়েছি জানি না, কিন্তু উনি নিশ্চয়ই পাঠিয়েছেন।

আমি ওনার প্রতিষ্ঠানে যখন যাই, তখন ব্লাড ব্যাংকের সাথে পরিচিত হয়ে, আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। এতো বড় একটি কাজ করছেন।  একটা অসাধারণ কাজ করেছেন, আমি এর নজির দেখিনি বাংলাদেশে।

দ্বিতীয় কথা, ওনার আমন্ত্রণে আমি লামা কোয়ান্টামমে গিয়েছি, কোয়ান্টামমে গিয়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে, শিশুদের শিক্ষার জন্যে উনি যা করছেন, এ এক অতুলনীয় উদাহরণ।

ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনাদের সাক্ষাতে ওর প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। লামার কোয়ান্টামমে, উন্মুক্ত যে মঞ্চ সেটি উনি দয়া করে, অনুগ্রহ করে আমার নামে স্থাপন করেছেন। এই সম্মানও কিন্তু বিরল। আপনাদের সাক্ষাতে এই কৃতজ্ঞতা জানাতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে।

আমার পরিবার হচ্ছে সুফী পীর পরিবার। আমি ত্রয়োদশ পুরুষ। বাবা হযরত শাহ সৈয়দ  আলী মাহমুদের আধ্যাত্মিক রক্ত আমার শরীরে নিশ্চয়ই প্রবাহিত আছে।

আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করি, সৃষ্টির শক্তিতে বিশ্বাস করি। সর্বোপরি বিশ্বাস করি সকল ধর্মের সকল মানুষের ভেতরে সত্য বিরাজ করে। সেই সত্যকে যেন আমরা অনুভব করতে পারি। এবং সেই সত্যকে অনুভব করবার একটি পথ হচ্ছে মনকে বিকশিত করা। মনকে শক্তিশালী করা, মানুষকে সংগঠন করা। এবং সেই কাজটিই মহাজাতক, শহীদ আল বোখারী, গুরুজী করছেন। এবং এত ব্যাপক একটি জনসংখ্যার ভিতরে কাজ করছেন।

তার উপরে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। এই প্রার্থনা করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। ধন্যবাদ গুরুজী, আপনি দীর্ঘজীবী হন।

এসএ/