ঢাকা, শুক্রবার   ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ২২ ১৪৩১

হুমায়ূনের দাদার বাড়ি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৪০ পিএম, ১৪ জুলাই ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ১২:৪৫ পিএম, ৮ নভেম্বর ২০১৯ শুক্রবার

দাদার বাড়ির এক বিশেষ পরিচিতি ঐ অঞ্চলে ছিল এবং খুব সম্ভব এখনও আছে –‘মৌলবিবাড়ি’। এই বাড়ির নিয়মকানুন অন্য সব বাড়ি থেকে শুধু যে আলাদা তা না, ভীষণ রকম আলাদা। মৌলবিবাড়ির মেয়েদের কেউ কোনদিন দেখেনি, তাদের গলার স্বর পর্যন্ত শোনেনি। এই বাড়িতে গানবাজনা নিষিদ্ধ।

আমরা দেখেছি, ভেতরের বাড়িতেও বাড় বড় পর্দা। একই বাড়িতে পুরুষদের মেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করে চলতে হত। ভাবের আদানপ্রদান হত ইশারায় কিংবা হাততালিতে। যেমন, পর্দার এ পাশ থেকে দাদাজান একবার হাততালি দিলেন, তার মানে তিনি পানি চান। দুই বার হাততালি-পান-সুপারি। তিনবার হাততালি-মেয়েদের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে, আরও নিঃশব্দ হতে হবে।

আমাদের হল পিরবংশ। দাদার বাবা জাঙ্গির মুনশি ছিলেন এই অঞ্চলের নামি পিরসাহেব। তাঁকে নিয়ে প্রচলিত অনেক গল্পগাঁথার একটি গল্প বলিঃ জাঙ্গির মুনশি তাঁর মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। সেই আমলে যানবাহন ছিল না। দশ মাইল পথ হেঁটে যেতে হতো। দুপুরে পৌঁছলেন। মেয়ের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে ফেরার পথে বললেন, মা আমার পাঞ্জাবির একটা বোতাম খুলে গেছে। তুমি সুই-সুতা দিয়ে একটা বোতাম লাগিয়ে দাও। বোতাম ঘরে আছে তো?

মেয়ে বোতাম লাগিয়ে দিল। তিনি দশ মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে পা দেয়া মাত্র মনে হল, বিরাট ভুল হয়েছে। তাঁর কন্যা যে বোতাম লাগাল সে কি স্বামীর অনুমতি নিয়েছে? স্বামীর বিনা অনুমতিতে স্বামীর সংসারের জিনিস ব্যবহার করা তো ঠিক না। তিনি আবার রওনা হলেন, অনুমতি নিয়ে আসা যাক। আবার কুড়ি মাইল হাঁটা।

আমি নিজে অবশ্যি এই গল্প অন্যভাবে ব্যাখ্যা করি। আমার ধারণা, মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে এসে তাঁর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। আবার মেয়েকে দেখার ইচ্ছা হল। একটা অজুহাত তৈরি করে রওনা হলেন।

দাদার বাড়ির কঠিন সব অনুশাসনের নমুনা হিসেবে একটা গল্প বলি। আমার ফুফুরা খুব সন্দরী। পির পরিবারের বংশধররা সচরাচর রূপবান হয়। তাঁরাও ব্যতিক্রম নন। দুজন ফুপুই পরীর মতো। বড় ফুপুর বিয়ের বয়স হলে বাবা তাঁর জন্যে একজন ছেলে পছন্দ করলেন। ছেলে বাবার বন্ধু। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ। ছেলেও অত্যন্ত রূপবান। বাবা তাঁর বন্ধুকে সঙ্গে করে গ্রামের বাড়িতে এলেন। দাদাজানের ছেলে পছন্দ জলো। মেয়ে দেখানো হলো। কারণ ধর্মে নাকি বিধান আছে, বিয়ের আগে ছেলে মেয়েকে এবং মেয়ে ছেলেকে অন্তত একবার দেখতে পারবে। ছেলে মেয়ে দেখে মুগ্ধ। সেই রাতের কথা, বাবা তাঁর বন্ধুকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছেন। খোলা প্রান্তরে বাবার বন্ধু গান ধরল। রবীন্দ্রনাথের গান শিক্ষিত মহলে গাওয়া শুরু হয়েছে।

গানটি হলো- ১আজি এ বসন্তে….’
গান গাওয়ার খবর দাদাজানের কানে পৌঁছল। তিনি বাবাকে ডেকে নিয়ে বললেন, এই ছেলে যে গান জানে তা তো তুমি বল নাই।
বাবা বললেন, হ্যাঁ, সে গান জানে। এই খানে মেয়ে বিয়ে দিব না। তুমি জেনেশুনে গান-জানা ছেলে এ বাড়িতে আনলে কেন?

গান গাওয়া ক্ষতি কী?
লাভ-ক্ষতির ব্যাপার না! আমরা কয়েক পুরুষ ধরে যে নিয়ম মানছি আমার জীবিত অবস্থায় তার কোন ব্যতিক্রম হবে না। তুমি যদি রাগ কর আমার কিছুই বলার নাই। রাগ করে বাড়িতে আসা বন্ধ করলেও করতে পার।
দাদাজান তাঁর মেয়েকে নিজে দেখেশুনে পৃথিবী থেকে দূরে সরে থাকা একটি পরিবারে বিয়ে দিয়ে দিলেন।

আমরা যখন দাদার বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, খবর পেয়ে বড় ফুপু আসতেন পালকি করে। পালকি অনেক দূরে অপেক্ষা করত। ফুপুর স্বামী খোঁজ নিতে আসতো-আমরা যে এসেছি আমার সঙ্গে কলের গান আছে কি না। যদি জানতেন কলের গান আছে-সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যেতেন।

ধীরে ধীরে দাদার বাড়ির মানসিকতার পরিবর্তন হয়। যে গান এই বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিল সেই গানও চালু হয়। দাদার নির্দেশেই হয়। আমার ছোট বোন শেফুর গলায়- ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ গান শোনার পর দাদাজান নির্দেশ দেন-গান চলতে পারে।

দাদার বাড়ির অদ্ভুত একটা কথা বলি। দাদার বাবা জাঙ্গির মুনশির ইচ্ছামৃত্যু হয়েছিল। দাদাজানেরও ইচ্ছামৃত্যু হয়। মৃত্যুর সাতদিন আগে সবাইকে ডেকে তিনি তাঁর মৃত্যুর সময় বলেন, কেউ মনে কোন আফসোস রাখবে না। মন শান্ত করো। আমাকে কেউ যদি বিশেষ কোন সেবাযত্ন করতে চাও করতে পার। দাদাজানের বলার সময়ই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যু হয় সজ্ঞানে। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে আমার ছোট চাচাকে ডেকে বলেন, আমি তা হলে যাই।

পৃথিবী বড়ই রহস্যময়। দাদাজানের বাড়িঘর অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম, গোছানো। মানুষগুলি হৈ চৈ করে কম, কাজ করে বেশি। দাদার বাড়িতে আমাদের অবাধ স্বাধীনতা ছিল না। দাদাজান আমাদের চোখে-চোখে রাখতেন। আদব-কায়দা, ভদ্রতা শেখাতেন। সন্ধ্যাবেলা নামাজ শেষ করেই গল্প করতে বসতেন। সবই ঈশপের গল্পের মতো। গল্পের শেষে একটা মোরাল থাকত। মোরাল আছে এমন গল্প ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু দাদাজানের গল্প ভালো লাগত। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।

নানার বাড়ি থেকে দাদার বাড়িতে এলে শুরুতে খানিকটা দমবন্ধ দমবন্ধ লাগত। তবে দাদার বাড়িরও আলাদা মজা ছিল। বাড়ির বাংলা ঘরে দুটি কাঠের আলমিরায় ছিল অসংখ্য বই। আসলে এই দুটি আলমিরা নিয়েই একটা পাবলিক লাইব্রেরি। আজিমুদ্দিন আহমেদ পাবলিক লাইব্রেরি।আজিমুদ্দিন আহমেদ আমার দাদার নাম। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁ নামে বাবা এই লাইব্রেরি করেন। লাইব্রেরির চাঁদা মাসে এক আনা। এই লাইব্রেরি থেকে কেউ কোনদিন বই নিয়েছে আমার জানা নেই। আমরা দাদার বাড়িতে উপস্থিত হলেই শুধু চাবি খুলে বই বের করা হতো। চাবি চলে আসত আমার হাতে। দাদার বাড়িতে পুকুর পাড়ে বটগাছের মতো বিশাল এক কামরাঙা গাছ ছিল। সেই কামরাঙা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বই পড়ার আনন্দের কোন তুলনা হয় না।

বাবা জায়গায় জায়গায় লোক পাঠিয়ে গ্রাম্য গায়কদের আনতেন। তাঁরা তাঁদের বাদ্যযন্ত্র-হাতে উপস্থিত হতেন-রোগাভোগা, অনাহারক্লিষ্ট মানুষ, কিন্তু তাঁদের চোখ বড়ই স্বপ্নময়। দাদার বাড়িতে গানবাজনা হবার কোন উপায় নেই। অনেকটা দূরে বাবার এক বন্ধুর বাড়ির উঠোনে গানের আসর বসত। হাত উঁচু করে যখন ঘাতক ঢেউ খেলানো সূরে, মাথার লম্বা বাবড়ি ঝাঁকিয়ে গানে টান দিতেন-
‘আমার মনে বড় দুষ্ক
বড় দুষ্ক আমার মনে গো।’

তখন তাঁর মনে ‘দুষ্ক’ ছড়িয়ে যেত শ্রোতাদের মনে। চোখ ভরে জল আসত। গান চলত গভীর রাত পর্যন্ত। রাত যত গভীর হত গানের ততই আধ্যাত্মিক ভাব প্রাধান্য পেতে থাকত। শেষের দিকে সেগুলি আর গান থাকত না। হয়ে উঠত প্রার্থনা-সংগীত। আমরা ছোটরা অবশ্যি তার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছি। আমাদের কোলে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে গান শুনতে পাচ্ছি।

(তথ্য সূত্র: লেখাটি হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার ছেলেবেলা’ থেকে নেওয়া)

এমএস/আরকে