ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ডেঙ্গু নিয়ে নতুন আতঙ্ক!

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ১২:১৬ পিএম, ২৬ জুলাই ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০৬:৩৩ পিএম, ১৯ আগস্ট ২০১৯ সোমবার

ডা. তানিয়া সুলতানা সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪৭তম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন। তিনি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় থাকতেন। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর গত বুধবার প্রথমে ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই দিনই তাকে স্থানান্তর করা হয় আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে। 

গতকাল শুক্রবার রাত ১০টার দিকে  এই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। শুধু এই ডাক্তার নয়। শাহিন আহামেদ, একজন বেসরকারি কর্মকর্তা। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর গত ২১ জুলাই ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একদিন পরই তার মৃত্যু হয়। ২৬ বছর বয়সী সেঁজুতি নামে এক নারী ১২ জুলাই জ্বর নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি হন। তিন দিন পর মৃত্যু হয় তার। দিনে দিনে মুত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ বা ধরণ পরিববর্তন হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে এই বিষয়ে কোনো কিছু জানা  যাচ্ছে না। তবে এর আগে তাদের কারও শরীরের কোনো র‌্যাশ ছিল না। এমন কি ব্যাথাও ততটা প্রকট ছিল না। যে কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি কিংবা তাদের স্বজনরা ডেঙ্গুর বিষয় সচেতন ছিল বেশি।  ডেঙ্গু রোগের যে লক্ষণ এবার তার প্রকাশ পাচ্ছে না।

রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিনই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর ভিড়। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা না থাকায় রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের বাইরে বিকল্প ব্যবস্থায় রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। ডেঙ্গু রোগী সামলাতে হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে। সব মিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। 

সরকারি হিসাবেও গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি বলে জানানো হয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিল ৯৪৬ জন। এবার চলতি মাসে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৭ হাজার ১১২ জন আক্রান্ত হয়েছে। গতবার জুন মাসে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ২৯৫। কিন্তু এবার জুন মাসে এক হাজার ৮২৯ জন আক্রান্ত হয়েছে।

আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস ভয় জাগাচ্ছে। সামনের এই দুই মাস ভরা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। ডেঙ্গুতে চলতি বছর এ পর্যন্ত ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, মৃতের সংখ্যা ৯। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এবার ডেঙ্গু ধরন পাল্টেছে। আগে ডেঙ্গু জ্বরের অন্যতম লক্ষণ ছিল শরীরে র্যাশ থাকা। কিন্তু চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে  র‌্যাশ দেখা যাচ্ছে না। জ্বর হওয়ার পরও চিকিৎসকরা বুঝতে পারছেন না। হেমোরেজিক ডেঙ্গু এবার বেশি হচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। রক্তপাতের ঝুঁকি বেশি থাকায় বেশি মৃত্যু হচ্ছে।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগীদের শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অঙ্গ যেমন কিডনি, লিভার, ফুসফুস ও হার্ট আক্রান্ত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অকার্যকরও হয়ে পড়ছে। ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশা শরীরে কামড় দেওয়ার পর রক্তের মনোসাইটে অনিয়ন্ত্রিতভাবে জীবাণু বংশবিস্তার করে। প্রবহমান রক্তের মাধ্যমে জীবাণু হার্ট, লাং, লিভার ও কিডনিতে প্রবেশ করে অধিক হারে বংশবিস্তার করে এসব গুরুত্বপূর্ণ কোষের কার্যকারিতা নষ্ট করে। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোষঝিল্লিতে আক্রমণ করে প্রদাহের সৃষ্টি করে। কিডনির মূত্র উৎপাদনের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং লিভার অকার্যকর হয়। 

ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ আরও বলেন, ডেঙ্গু হার্টের মাংসপেশির বলয় ভেঙে সেখানে আক্রমণ করে কার্যকারিতা হ্রাস করে। এছাড়া সেরোটাইপ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিস্কে তীব্র প্রদাহের সৃষ্টি করে। এসব রোগী যথাসময়ে চিকিৎসা না পেলে তাদের মৃত্যু হতে পারে। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়ছে। আগামী দুই মাস তা আরও বাড়তে পারে। তাই শরীরে কোনো ধরনের জ্বর অনুভব করলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ সেবন করতে হবে। 

টিআর/