ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্মৃতিতে

ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

প্রকাশিত : ০৩:৫৭ পিএম, ৫ আগস্ট ২০১৯ সোমবার

১৯৭৫-এর পনেরই আগস্টের মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কোনো জাতির জীবনে বেশি ঘটে না। এই হত্যাকাণ্ড বিশ্বাসঘাতকতার ও রাষ্ট্রদোহিতার একটি চরম দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না, ছিলেন জাতির জনক, ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিল প্রবাসী সরকার। তিনি সেই সরকারের ঘোষিত প্রেসিডেন্ট, যদিও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তিনি প্রবলভাবে উপস্থিত ছিলেন সকল বাঙালির চেতনায় এবং অবশ্যই প্রবাসী সরকারের সকল কর্মকাণ্ডের প্রেরণা হয়ে।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তারই নামে। তার অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। ঘাতকেরা শুধু সেদিনের রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেনি, তার পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্যকে হত্যা করে। নারী, শিশু কেউ অব্যাহতি পায়নি সেই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ থেকে। বিশ্বের ইতিহাসে এই নির্মম সহিংসতার তুলনা মেলা ভার।

এই সহিংসতা ও নির্মমতা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছিল তার নিকটাত্মীয় আরও দুটি পরিবারে। আক্রমণ পরিচালিত হয়েছিল যুগপৎ তিনটি বাড়িতে। পৃথক অবস্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ মণির বাসগৃহ ও ভগ্নিপতি সেরনিয়াবাতের বাসগৃহ আক্রান্ত হয়। তিনটি পরিবারের সন্তানসহ ওই আক্রমণে সর্বমোট ৩৭ জন নিহত হন।

বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ বিমানযোগে তার পৈত্রিক বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যায় ঘাতকের লোকেরা, যারা ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য। তাকে সমাধিস্থ করা হয় চরম অবজ্ঞায়। অত্যন্ত দায়সারাভাবে তার দাফনে যেটুকু আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করা গিয়েছিল, তা সম্ভব হয়েছিল কতিপয় গ্রামবাসীর চাহিদা মোতাবেক। অন্যদের বেলায় তাও সম্ভব হয়নি। বনানী গোরস্তানে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াই সমাধিস্থ হন বঙ্গবন্ধু পরিবারের ও দুই আত্মীয় পরিবারের সদস্যরা।

এই নির্মম ঘটনা ছিল একেবারেই অচিন্তিত। বঙ্গবন্ধু কখনও তার সম্ভাব্য হত্যা বিষয়ে কোন হুঁশিয়ারি গ্রাহ্য করেননি। তিনি গণভবনের নিরাপত্তায় থাকার প্রয়োজন অনুভব করেননি। ধানমন্ডির স্বগৃহের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে যা ছিল তা একজন রাষ্ট্রপতির উপযোগী নয়। তিনি নিশ্চয়ই সে বিষয়ে অবহিত ছিলেন। কিন্তু তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কোন বাঙালি তাকে হত্যা করবে না। 

তিনি যাদের প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন, তারাও তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, এই যে তার সরল বিশ্বাস, এ বিশ্বাস তার মতো মহৎ মানুষের পক্ষেই সম্ভব। প্রাণ দিয়ে তিনি এই বিশ্বাসের মূল্য দিয়ে গেলেন, যেমন দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাকে তার সরকারি বাসভবনের শিখ দেহরক্ষীদের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল, তিনি তা গ্রাহ্য করেননি। সামনে দাঁড়ানো সশস্ত্র ঘাতকদের দেখেও বঙ্গবন্ধু বোধহয় বিশ্বাস করতে পারেননি, তারা খুন করতে এসেছে। না হলে তার মুখ দিয়ে বেরুত না, তোরা কী চাস?- এই স্বভাবসম্মত উক্তি। 

এই প্রশ্নের উত্তর তারা দিয়েছিল বন্দুকের ট্রিগার টিপে। গুলিতে গুলিতে তার দেহ ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। সেখানে থামেনি। এরপর তাদের লক্ষ্য পরিবারের অন্য সকল সদস্য। নিষ্পাপ বালক বঙ্গবন্ধুর ছোট সন্তান রাসেলও রক্ষা পেল না এই জল্লাদদের হাত থেকে।

এই অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের হোতারা কারা এবং তারা কী চেয়েছিল, এ নিয়ে আজ আর বেশি বিতর্ক বা অস্পষ্টতা নেই। তারা যদিও আপাত দৃষ্টিতে ব্যক্তি শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে, কিন্তু তাদর হত্যার পরিধি বিচার করলে এবং সেই পরিধির বিস্তার নভেম্বরের চার নেতার হত্যার কথা বিবেচনা করলে, সন্দেহ থাকে না তারা ব্যক্তিকে হত্যা করেনি, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আত্মাকে হত্যা করেছে। হত্যার দায় তারা কখনও অস্বীকার করেনি, বরং গর্বের সঙ্গে স্বীকার এবং সদর্পে বলেছে, আমি খুনি, পারলে ওরা আমার বিচার করুক।

ঘাতকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তারা চিরদিন থাকবে বিচারের ঊর্ধ্বে। এ বিশ্বাস ভিত্তিহীন ছিল না। হত্যার পরপরই যারা ক্ষমতায় এলো, তারা আইন পাস করে তাদের বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। এই ইনডেমনিটি অ্যাক্ট ছিল তাদের রক্ষাকবচ। এছাড়াও ছিল, হত্যা পরবর্তী সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা। দেশে নয়, বিদেশে সরকার তাদের দেখভাল করেছে, বিদেশের দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে, শুধু আইনের নিরাপত্তা দিয়ে সন্তুষ্ট থাকেনি, তাদের পুরস্কৃত করেছে।

একই সঙ্গে তারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বাতিল করে নতুন বাংলাদেশ গঠনে মনোযোগী হয়েছে। এই নতুন বাংলাদেশ হবে বাংলাদেশের পাকিস্তানি সংস্করণ। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা শুরুতেই পরিত্যাজ্য। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মের যে মর্যাদার জায়গা ছিল পাকিস্তান, সেটা সাড়ম্বরে ফিরিয়ে আনা হলো। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, যা নিষিদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধানে, তাদের প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করা হলো।

সংবিধানের সংশোধন যা করা হলো, সবগুলোর উদ্দেশ্য এক : সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে দিয়ে, সংবিধানকে নতুন বাংলাদেশের উপযোগী করে পুননির্মাণ। এতেও সন্তুষ্ট হলেন না, জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি তিনি অষ্টম সংশোধনীর মারফত ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করলেন। সেকুলারিজমের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিলেন তিনি।

নতুন বাংলাদেশের সকল সরকার ’৭৫-এর পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গির ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। এই হত্যাকে তারা অপরাধ বিবেচনা করেনি। এই হত্যার বিচারের কোন উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেনি। সে উদ্যোগ নিতে হয়েছে ’৯৬-এর নির্বাচনে জয়ী শেখ হাসিনার সরকারকে। সরকারের প্রথম পাঁচ বছরের মেয়াদে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, দেশের সাধারণ আইনে, তবে বিচারের পরিণতি দেখে যেতে পারেনি সরকার।

পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি, ক্ষমতায় এসেছে যে জোট সরকার, সে সরকারের অংশীদার ছিল জামায়াতে ইসলামি। সুতরাং প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আরম্ভ কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার তার পরিণতি লাভ করে হত্যার ৩৪ বছর পর ২০০৯ সালে। হত্যা অপরাধে যারা অপরাধী হিসেবে দণ্ডিত হয় তাদের প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়, অংশত। পলাতক অপরাধীরা আজ পর্যন্ত আইনের নাগালের বাইরে রয়ে গিয়েছে।

একদিক দিয়ে, ’৭৫-পরবর্তী হতাশা ও অপেক্ষার দীর্ঘদিনের অবসান হয়েছে বর্তমান সরকারের অধীন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। আমাদের প্রায় ৪০ বছরের ইতিহাসে এ এক বড় প্রাপ্তি। কে ক্ষমতায় এলো, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন স্থায়ী হয়েছিল বিশ বছরের অধিক। এর অবধারিত ফল হয়েছিল, বিচার বিভাগের পঙ্গুত্ব। ঘৃণ্যতম অপরাধের বিচার করা সম্ভব হয়নি সেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত বিচার ব্যবস্থায়। আজ সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন হচ্ছে সেই বিচার বিভাগকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার লক্ষণসমূহ।

২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের বিজয়, জনগণের একটি দাবির বিজয় বলে গণ্য হবে। সে দাবি, ১৯৭২-এর সংবিধানের পুনরুজ্জীবন ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। দুটি দাবি পূরণের লক্ষ্যেই অগ্রসর হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা আসছে শুধু বাহির থেকে নয়, ভেতর থেকেও। ভুলে গেলে চলবে না, ’৭২-এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা একটি অখণ্ড ধারণা। এক্ষেত্রে কোনো আপসের অবকাশ নেই।

পঁচাত্তরের আগস্টে ও নভেম্বরে যা ঘটেছিল, তা বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে কক্ষচ্যুত করেছিল। সেই কক্ষচ্যুতি নিদারুণ ক্ষতচিহ্ন রেখে গিয়েছে আমাদের জাতীয় জীবনে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার বিস্তার ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রীকে প্রায় প্রত্যহ হুঁশিয়ার করতে হচ্ছে তার নিকটজনকে, যেন কোনো দুর্নীতির পথে তারা পা না বাড়ান। দুর্নীতির জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা যেমন দেখা যায়, সে জালের আলিঙ্গন যে কত গভীর, তাও আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। 

’৭৫-এর আগস্টের মারাত্মক আঘাতের পর কেন দেশ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, কেন আমাদের এত দীর্ঘকাল দুঃশাসন ও অপশাসনের পরাজয় ও অপমান স্বীকার করতে হলো, এর কোন সদুত্তর আমরা এখনও পাইনি। আমাদের রাজনৈতিক চেতনা কি এখনও দৃঢ়মূল নয়? আমাদের রাজনৈতিক সংগঠন কি এখনও দুর্বল? কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল দেখে কে বলবে যে, বাংলাদেশের ভোটার ভোট প্রদানে বড় রকমের ভুল করেছে?

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের এই জনগণের ওপরই আস্থা রেখেছিলেন। জনগণই ছিল তাঁর শক্তির উৎস। তার মধ্যেই বাংলার জনগণ তাদের অবিসংবাদী নেতার সন্ধান পেয়েছিল। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি চেয়েছিল, বাংলার মানুষ তাকে ভুলে যাক। বাংলার মানুষ তাকে ভোলেনি। বাংলার মানুষের শ্রদ্ধায় অভিষিক্ত আছেন তিনি, তাদের ভালোবাসায় সিক্ত আছেন আজও। জাতির জনক, ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে যারা হত্যা করেছিল, সেই কলঙ্কের অপলোচন হয়েছে তাদের বিচারের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর আসন স্থায়ী হয়ে বাঙালির হৃদয়ে।

(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেয়া)

এএইচ/