ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ঈদ যাত্রায় বিরল অভিজ্ঞতা!

মিজানুর রহমান সোহেল 

প্রকাশিত : ০৯:২৪ এএম, ৯ আগস্ট ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ১০:১৪ এএম, ৯ আগস্ট ২০১৯ শুক্রবার

ঈদ যাত্রা মানেই যুদ্ধ। এবারো সে যুদ্ধে অংশ নিলাম অন্যভাবে। আমি সাধারণত ট্রেনে উঠি না। তবে ঈদুল আজহাতে সড়কপথে মাত্রাতিরিক্ত জ্যাম থাকার কারণে ট্রেনেই ভরসা করেছিলাম। চাহিদা বেশি থাকায় পাবনার টিকিট পাইনি; তবে রাজশাহীর ৩টা টিকিট পেয়েছিলাম। আজ রাত ১১টায় আমাদের ট্রেন ছাড়ার কথা। নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘন্টা পর ট্রেন এলো। কিন্তু ট্রেনে ওঠার মতো কোনো স্কোপ পেলাম না। নারী ও শিশুদের জন্য এ যাত্রা ভীষণ বিপদজনক।

এর মধ্যে কোনো কোনো নারী জানালা দিয়ে উঠলেন। কেউবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উঠছেন ছাদে। কোথাও দেখা গেল স্বামী উঠেছেন কিন্তু স্ত্রী উঠতে পারেননি। আবার জানালা দিয়ে স্ত্রীকে উঠিয়ে দিলেও বেচারা স্বামী লাগেজ নিয়ে বাইরে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। আমার সাথে ছিলেন ভাবী ও তার মেয়ে। যেখানে আমিই উঠতে পারছি না সেখানে তাদের ওঠা অসম্ভব ব্যাপার। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে চিন্তা করলাম দরজার উল্টা দিক দিয়ে ওঠা যায় কিনা। দৌড়ে আমার বগির পেছন দিকে গেলাম। কোনো মতো দরজায় ঝুলে ওঠা যায় কিন্তু স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। দরজায় থাকা পুলিশ ঝুলে না গিয়ে ট্রেনের ছাদে যাওয়ার অনুরোধ করলেন।

কখনই ছাদে যাইনি বলে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। পুলিশ নিজেই আমার ব্যাগ ধরে উপরে উঠতে বললেন। কিন্তু উপরের কেউ আমাকে ধরতে বা সাহায্য করতে আগ্রহ দেখালো না। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুই ধরা যাচ্ছে না, পিচ্ছিল। কয়েকজনকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলাম। একজন হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে তুললেন। পুলিশ ব্যাগ উচিয়ে দিলেন। কিন্তু ছাদেও বসার জায়গা নেই। কোনোভাবে এক জাগায় বসলাম কিন্তু স্থির হয়ে বসা যাচ্ছে না। এক আংগুল দিয়ে একটা রড ধরতে পারলাম। বৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এক মুহুর্তে মনে হলো- আমি তো চরম ভুল করছি। যে কোনো সময় এখানে বড় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই নেমে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। 

এতসব ঘটনা খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ঘটেছে। নামার পর দুজন কুলি বললেন টিকিট দেখালে তারা টাকার বিনিময়ে ঢুকতে ব্যবস্থা করবেন। টিকিট দেখে আমার সিট গুনে বের করলেন। যারা আমাদের সিটে বসেছেন তাদের জানালা দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানালা বন্ধ করে দিল!! অনেক অনুরোধ করার পরেও খোলেনি। এর মধ্যে ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে যাত্রা শুরু করলো। আমরা টিকিট হাতে নিয়ে ট্রেন চলে যেতে দেখলাম। আমাদের মতো অন্তত শতাধিক মানুষকে পেলাম যারা যুদ্ধে হেরে লাগেজ নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। 

কমলাপুর রেলস্টেশনে মিজানুর রহমান সোহেল

বিশেষ করে যাদের সাথে নারী ও শিশু ছিল। আমিও অকল্পনীয় এই যুদ্ধে হেরে দেখি আমার শরীর ঘেমে একাকার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এর মধ্যে মনে হলো টেকনিক্যাল বাসট্যাণ্ডে চলে যাই। এরপর সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে লোকাল বাসে রওনা হবো। উবার নিয়ে জ্যাম ঠেলে টেকনিক্যাল এসে গলাকাটা দামে একটা ননএসি বাস পেলাম। তবে সেটা ইঞ্জিন কাভারে। কিন্তু এটাও তো বিশাল বড় প্রাপ্তি। রাত ১২টার এই গাড়িটি রাত সাড়ে ৩টার পরে ছেড়েছে। তবে মনে হচ্ছে, ট্রেনের ছাদ থেকে নেমে আসার সিদ্ধান্তটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত ছিল। এত যুদ্ধের পরেও প্রিয়জনের দেখা পেলে এসব কষ্ট হয়তো মুছে যাবে। 

কিন্তু এসব অনিয়মের বিষয়ে সরকার কেন ব্যবস্থা নেয় না? টিকেট ছাড়া মানুষ কেন ট্রেনে ওঠে, টিকেট থাকার পরেও কেন আমাদের নির্বিঘ্নে ট্রেনে ওঠার সুযোগ হয় না, এত যাত্রী থাকার পরেও কেন ট্রেন লোকশানে থাকে এমন হাজারও কেন-এর উত্তর জানতে মন চাই। কিন্তু আমাদের দেশে এসব আশা করাও বোকামি বৈ কিছু নয়। তাই নীরবে অনিয়মগুলো মাথা পেতে নিচ্ছি। কথিত সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা ইউরোপের মত আমাদের দেশ এখন উন্নত বলা হলেও নাগরিক সুবিধা নামের যে একটা জিনিস আছে সেটা আমাদের নগরকর্তারা বেমালুম ভুলেই থাকেন। তাই আমরা ঝোলানো মূলা দেখে মিছে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি।

মিজানুর রহমান সোহেলের  ফেইসবুক থেকে নেওয়া