ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বিশ্বনেতা ও গণমাধ্যমের চোখে বঙ্গবন্ধু

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০২:০০ পিএম, ১৫ আগস্ট ২০১৯ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৩:২১ পিএম, ১৫ আগস্ট ২০১৯ বৃহস্পতিবার

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি তিনি। নিজের পুরো জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে। যৌবন কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। পরিবারকে সময় দিতে পারেননি। শোষিত এই বাংলার মানুষকে দিতে হবে মুক্তির স্বাদ- শুধু এই চিন্তাতেই দিন কাটত তার। সারাজীবন ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংগ্রামী জীবনের এই মানুষটি বাংলার অহংকার, প্রাণের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের আরেক নাম।

উনিশ'শ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটিয়ে বাংলার মানুষকে পুরো বিশ্বের কাছে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এর তকমা জুটিয়ে নিয়েছে কিছু মানুষরূপী হায়েনা। পাকিস্তান কখনও যা করতে সাহস করেনি, স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে সেটাই করে দেখিয়েছে এদেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক।

এই বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকদের চক্রান্ত এবং সেনাবাহিনীর একদল উচ্ছৃঙ্খল উচ্চাভিলাষী সদস্যের নির্মম বুলেটের আঘাত ওইদিন শুধু বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করেনি, আঘাত করেছে পুরো বাংলাদেশের মানুষকে। শোকে বিধ্বস্ত, হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো পুরো দেশ। আর বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে বলেছে, এও কি সম্ভব! একটি দেশ তার স্থপতি, মহান নেতাকে কিভাবে হত্যা করে? এই প্রশ্ন আর হতাশা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে দেশের মানুষ।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিনী আরজু মনি ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন।

সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। যা উঠে আসে বিশ্ব গণমাধ্যমের পাতায় পাতায়।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তৎকালীন বিশ্ব গণমাধ্যমের কাছেও চরম আরাধ্য এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। অধিকাংশ গণমাধ্যম এবং ব্যক্তিত্বের চোখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ঐতিহাসিক ক্ষণজন্মা এক মহান পুরুষ। তাই তাকে স্বাধীনতার প্রতীক বা রাজনীতির কবি খেতাব ছাড়াও নানাভাবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন অনেকে। বিদেশি ভক্ত, কট্টর সমালোচক, এমনকি শত্রুরাও উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ববোধ ও নেতৃত্বের।

১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি, আরেক ভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’

ওই ভাষণের পর কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ যে ভাষণ দিলে, এখন থেকে সাবধানে থেক। আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে।’ ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সেদিনের কথাটিই সত্য হয়ে যায় ঠিক দুই বছরের মাথায়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আর এই খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে বিশ্বসম্প্রদায়।

স্তম্ভিত বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধু হত্যায় তাদের প্রতিক্রিয়ায় দীর্ঘশ্বাসের পাশাপাশি হৃদয় নিংড়ানো মন্তব্য করেছেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’

ব্রিটিশ এমপি জেমসলামন্ড বলেছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’

ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।’

জাপানি নাগরিক মুক্তি ফুকিউরা বাঙালি দেখলে বলতেন, ‘তুমি বাংলার লোক? আমি কিন্তু তোমাদের জয় বাংলা দেখেছি। শেখ মুজিব দেখেছি। জানো এশিয়ায় তোমাদের শেখ মুজিবের মতো সিংহ হৃদয়বান নেতার জন্ম হবে না বহুকাল।’

বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো সেদিন বলেছিলেন- ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’

ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’

জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথা কাউণ্ডা বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’

ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শোকে পাথর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে আসার জন্য জার্মানির একটি এয়ারপোর্টে তার পাসপোর্টটি ইমিগ্রেশন অফিসারকে দেখালে সেই অফিসার পাসপোর্টটি দেখেই শেখ হাসিনাকে বললেন ‘ছিঃ তোমরা বাংলাদেশিরা খুব জঘন্য একটি জাতি, যেই মানুষটি তোমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন তাকেই তোমরা হত্যা করে ফেললে?’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনির কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’

এছাড়া, শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার খবরটি প্রায় সব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।’

‘দ্য টাইমস অব লন্ডন’ এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ বলা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই।’

একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’

বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর পাওয়ার পর পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তিনি জনগণের কাছে এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন, আমিই রাষ্ট্র।’

১৫ আগস্ট ওই ঘটনার পর বিবিসি প্রকাশ করে, ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে।’

ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লাখ লাখ লোক ক্রস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছেন। মূলত এক দিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’

একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’

নিউজ উইক-এ বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।

দ্য গার্ডিয়ানে লেখা হয়-‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস্ উল্লেখ করে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।’

১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় তখন তিনজনের একটা আন্তর্জাতিক সাংবাদিকের টিম বাংলাদেশে এসেছিলেন। যাদের তিন দিন শেরাটনে আটকে রেখে তৎকালীন সরকার সরাসরি বিমানবন্দর দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। তাদেরই একজন ব্রায়ান ব্যারন। 

১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে লিখিত তার সংবাদ বিবরণীতে বলা হয়, ‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক-চিহ্ন এবং তার কবরস্থান পুণ্য তীর্থে পরিণত হবে’। (দি লিসনার, লন্ডন, ২৮ আগস্ট, ১৯৭৫)।’ 

মরহুম মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বলেছিলেন- ‘টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের কবর এক দিন সমাধিস্থলে রূপান্তরিত হবে এবং বাঙালির তীর্থস্থানের মতো রূপ লাভ করবে।’

বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী টাইম ম্যাগাজিন ১৯৮২ সালের ৫ এপ্রিল তাদের একটি সংখ্যায় উল্লেখ করে, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশ বছরের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের আমল ছিল সর্বপ্রথম এবং দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আমল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ও প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে হত্যার পর হঠাৎ গণতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে।’

এনএস/এমবি