ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ধরন পাল্টাচ্ছে কিশোর অপরাধের

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৫২ পিএম, ২০ আগস্ট ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:৫৪ পিএম, ২০ আগস্ট ২০১৯ মঙ্গলবার

সারাদেশে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। তবে চুরি-ছিনতাই বা ঘর পালানোর মতো অপরাধ পেছনে ফেলে কিশোরদের খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে।

চলতি বছরের আলোচিত একটি ঘটনা হচ্ছে, বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে শাহ নেওয়াজ শরীফ রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা। গত ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে ফাতকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়। পরে ওই দিন বিকালে বরিশালের শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান শরীফ।

এ হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। হত্যাকাণ্ডের পরের দিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা সদর থানায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এ ছাড়া সন্দেহভাজন অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। মামলার এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এ ঘটনার পর জানা যায়, কয়েক বছর আগে মাদক সেবনের টাকা যোগাড় করার জন্য ছিঁচকে চুরি আর মোবাইল ছিনতাই করতেন নয়ন বন্ড। ছিঁচকে চোর থেকে এক সময় তিনি হয়ে ওঠেন পেশাদার সন্ত্রাসী। ২০১৭ সালে বরগুনায় ইয়াবা, ফেন্সিডিল, হেরোইন ও দেশীয় অস্ত্রসহ নয়নকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। সেই মামলায় দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে আসেন নয়ন বন্ড। আর জেল থেকেই বেরিয়েই এ হত্যাকাণ্ড ঘটান তিনি।

শুধা এ ঘটনাই নয়। এমন বাস্তবতায় ময়মনসিংহে মাদকাসক্তি ও তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারে কিশোররা খুন থেকে শুরু করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

গত ২৫ জুন ময়মনসিংহ মহানগরীর চরপাড়ায়, ভাড়াটিয়া এক নারীর সঙ্গে মাসুমের পরকীয়াকে কেন্দ্র করে একই এলাকার তার দুই বন্ধু শাকিল ও রিমন চাঁদা দাবি করে। প্রথমে এক লাখ পরে ২০ হাজার টাকায় রফা হয়।

এরপর চাঁদার টাকা নিয়ে দুই বন্ধুর ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে সঙ্গে থাকা ছুরি দিয়ে শাকিলের বুকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় রিমন। রক্তাক্ত শাকিলকে হাসপাতালে ভর্তির পর মারা যায় সে।

আদালতের তথ্য মতে, ময়মনসিংহে কিশোর অপরাধের মোট ৩৩২টি মামলা রয়েছে।

আর টাঙ্গাইলে কিশোরদের সুনির্দিষ্ট কোনও গ্যাং না থাকলেও সংঘবদ্ধ কিশোর অপরাধ থেমে নেই। নানা ছুতায় ‘পার্টির আয়োজন’ করা, হর্ন বাজিয়ে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো, রাস্তার মোড়ে মোড়ে নারীদের উত্ত্যক্ত করা টাঙ্গাইলে একরকম নিয়মে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অভিভাবক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতার সঙ্গে ‘বড়ভাইদের’ প্রশ্রয়ে এরা দিন দিন হয়ে পড়ছে নিয়ন্ত্রণহীন। বিশেষ করে দল বেঁধে উচ্চ-মধ্যবিত্ত ঘরের উঠতি বয়সী এই কিশোরদের মোটরসাইকেলের রেস স্থানীয়দের জন্য আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাঙ্গাইলে এরকম একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।

এরা শুধু মারামারি-কাটাকাটিতেই নয়, ধর্ষণ এবং মাদক বহন ও সেবনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। গত ১২ এপ্রিল রাতে টাঙ্গাইল নতুন বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল এক দম্পতি। এ সময় কয়েকজন বখাটে কিশোর ওই দম্পতিকে ভয়ভীতি দেখিয়ে গৃহবধূর স্বামীকে মারধর করে স্ত্রীকে উঠিয়ে নিয়ে সারা রাত ধর্ষণ করে। এছাড়া, ২০ মে দুপুরে মধুপুরে বাড়িতে একা পেয়ে শতবর্ষী এক বৃদ্ধাকে ১৫ বছরের সোহেল নামের কিশোর ধর্ষণ করে। এমন আরও অনেক ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।

সম্প্রতি সমাজে এমন কিশোর অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় চিন্তিত অভিভাবকরা। উদ্বেগ জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরাও।

সমাজবিজ্ঞানীর বলছেন, অনেক মা-বাবা আছেন, সন্তান কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে সে সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন না। তারা মনে করেন টাকা দিলেই সব দায়িত্ব শেষ। কিন্তু যারা এমন মনে করেন, তাদের সন্তানদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

টাঙ্গাইল মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম বলেন, মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদসহ পারিবারিক নানা অশান্তির কারণে তাদের সন্তানরা স্কুলে ঝরে পড়ছে। আর সেখান থেকেই তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিসহ বিভিন্ন গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে মাদকসেবন ও মাদক বহন থেকে শুরু করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর বয়সেই তারা হয়ে যাচ্ছে অপরাধী।

এমন বাস্তবাতায় শিক্ষক ও বিশিষ্টজনরা বলছেন, পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতাই পারে কিশোরদের অপরাধ জগত থেকে ফিরিয়ে আনতে।