ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

আমাজনে আগুন: নেপথ্যে কী?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:৫৮ পিএম, ২৪ আগস্ট ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ০৪:১০ পিএম, ২৪ আগস্ট ২০১৯ শনিবার

চলতি বছরেই ৭৫ হাজার বার আগুন লাগলেও গেল সপ্তাহে আমাজনে যে আগুন লেগেছে তা নিভানোই যাচ্ছে না। আগুন নেভাতে ব্রাজিলসহ আমাজনের অধিকারী দেশসমূহ কার্যকরী কোন ভূমিকাই পালন করছে না বলে বিতর্ক উঠেছে। আমাজনের এ আগুন কি প্রকৃতিকভাবে নাকি অসাবধানতার কারণে নাকি ইচ্ছাকৃতভাবেই লাগানো হয়েছে তা নিয়ে বিশ্বনেতারা তর্কে মেতেছেন। আগুন নেভানোর জন্য যেন কোন মাথা ব্যাথাই নেই। সম্প্রতি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনা মাঠে নামাতে নির্দেশ দিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট।  

অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে আগুন নিয়ে আলোচনা হলেও তা নেভানের জন্য কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। তবে এ কাজে প্রথম এগিয়ে আসে বলিভিয়া। বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি ইভো মোরালেস আগেই সাহায্যের কথা বলেছিলেন ব্রাজিলকে। কিন্তু তখনও সেভাবে টনক নড়েনি ব্রাজিল সরকারের। দাবানলের ছড়িয়ে পড়া রুখতে সুপার ট্যাঙ্কার বোয়িং বিমান ৭৪৭-৪০০ ভাড়া করার কথা ঘোষণা দিয়েছেন ইভো। গতকাল শুক্রবার থেকে আগুন আয়ত্বে আনতে আকাশ পথে ঐ ট্যাঙ্কার নিয়ে অভিযানও শুরু হয়েছে।

বলিভিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট আলভারো গার্সিয়া জানিয়েছেন, দেড় লাখ লিটার পানি বা অগ্নি নির্বাপক নিয়ে উড্ডয়নে সক্ষম এই সুপারট্যাংকার বোয়িং বিমান। এই বিমান থেকে পুড়তে থাকা আমাজনে পানি ঢালা হবে। তার আগে বিমানবাহিনীর বিমান গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে আসবে। এরপরই পানি নিয়ে উড়াল দেবে সুপার ট্যাংকার বোয়িং বিমান।

আমাজনের এ আগুনের নেপথ্যে কি রয়েছে এমনটিই এখন ভাবছে বিশ্ববাসী। ব্রাজিলের ফেডারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, শুকনো বাতাসে দাবানল জ্বলে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এক্ষেত্রে দাবানলের প্রকোপে আগুন লাগেনি বলেই মনে করছেন তারা। বিজ্ঞানীদের মতে, অনেক সময়ই চাষের জন্য জমি বা খামার তৈরি করতে ইচ্ছাকৃতভাবে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা। এ ক্ষেত্রেও এমনটা হচ্ছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

জলবায়ু বিজ্ঞানী কার্লোস নোব্রে বলেছেন, ‘গবাদিপশুর চারণভূমি হিসেবে জমি ব্যবহার করতে চাওয়া কৃষকেরা জায়গা পরিষ্কার করতে শুকনো আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় বন দাহ্য হয়ে থাকে এবং খুব সহজেই তাতে আগুন লাগে।’ 

খনিজ পদার্থের ভাণ্ডার এ আমাজন বন। খনিজ পদার্থের খোঁজে আমাজন বন লাগাতার সাফ করে খনন কাজ চালানো হয়। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি মিনিটে একটি ফুটবল মাঠের সমান জঙ্গল কাটা হয় এখানে। ফলে স্বল্প বৃষ্টিপাতও আমাজনে আগুন লাগার অন্য একটি কারণ হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীদের আর একটি অংশ। কার্বন ছাকনি হিসেবে পরিচিত চিরসবুজের এ জায়গা যে এই ঘটনার পর তার কার্যক্ষমতা হারাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত গবেষকরা। 

এদিকে আমাজনে ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জেইর বোলসোনারোর নীতিকে কাঠগড়ায় তুলেছেন পরিবেশবিদরা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না করেই আমাজন অঞ্চলকে চাষ ও খনিজ উত্তোলনের কাজে ব্যবহারের কথা বলেছিলেন তিনি। তার এ উদ্যোগের ফলে বন উজাড় হয়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক মহলের এমন উদ্বেগ দিনের পর দিন উপেক্ষা করে গেছেন বোলসোনারো। ফলস্বরূপ আমাজনে অন্তত ৭২ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু হয়েছে অনেক পশুপাখিরও।

ব্রাজিল সরকারের নিষ্ক্রিয় আইন ও দুর্বল প্রয়োগ, আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া মূল্যের গুঞ্জনে পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজনে এখন অবৈধ উপায়ে নজিরবিহীনভাবে সোনার খনির খোঁজ করছেন স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ।
হাজার হাজার অবৈধ খনির সন্ধানকারীরা সোনার খোঁজে খনন কাজ পরিচালনা করছেন। এ জন্য তারা আমাজনের গাছ কাটছেন ও নদী দূষণ এবং আদিবাসীদের জমি দখল করছেন। 

আমাজনের ভূতত্ত্ব ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করে দেশটির সংস্থা আমাজন জিও রেফারেন্সড সোসিও-এনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক। সংস্থাটি বলছে, ব্রাজিল ভূখণ্ডে থাকা চিরহরিৎ এই বনাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে সাড়ে চারশ’র বেশি অবৈধ খনি খনন স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র আদিবাসীদের ভূমিতেই রয়েছে কয়েক ডজন।

দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদের পাশে প্রায় ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে সুবিশাল রেইন ফরেস্ট আমাজন। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের ২০ শতাংশেরই উৎপত্তি আমাজনে। গবেষকদের মতে এই বন প্রতিবছর ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। সে কারণে একে ডাকা হয়ে থাকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে। কিন্তু ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ খ্যাত এ আমাজন আজ বিপন্ন প্রায়। আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমশ গ্রাস করছে ওই চিরহরিৎ বনভূমিকে। গত তিন সপ্তাহ ধরে জঙ্গলটিতে জ্বলতে থাকা আগুনে এরই মধ্যেই পুড়ে গেছে ৭ হাজার ৭৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা।

পৃথিবীর সবচেয়ে জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর এই অরণ্যে ২৫ লাখের বেশি পতঙ্গের প্রজাতি, ৪০ হাজারের বেশি গাছের প্রজাতি, দু’হাজার পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রজাতি এবং ২ হাজার ২০০ প্রজাতির মাছের বাস। বিভিন্ন নাম না জানা মানব গোষ্ঠীর বাসস্থান। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে তারাও।

ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্স (ইনপে) ২০১৩ সাল থেকে আমাজন জঙ্গলে আগুন লাগা নিয়ে গবেষণা করছে। চলতি বছর আমাজন রেইন ফরেস্টে ৭২ হাজার ৮৪৩টি দাবানলের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় যা ৮৩ শতাংশ বেশি এবং ২০১৩ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। এই প্রকোপ আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে বলে দাবি ইনপে-র। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে রেকর্ড হারে পুড়ছে অ্যামাজন জঙ্গল। এরইমধ্যে ব্রাজিলের রোন্ডানিয়া, অ্যামাজোনাস, পারা, মাতো গ্রোসো অঞ্চলের কিছু অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।

আগুনের কারণে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছে সূর্যের মুখ। এমনকি দুই হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্রাজিলের সাও পাওলোর দুপুরের আকাশ যেন ‘রাতের চেয়েও অন্ধকার’ হয়ে উঠেছে আগুনের ধোঁয়ায়। ব্রাজিলের রোরাইমা প্রদেশ থেকে পেরুর আকাশেও হানা দিয়েছে ধোঁয়া।

মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার উপগ্রহ চিত্রেও ধরা পড়েছে আমাজনে ঘটতে থাকা ৯ হাজার ৫০৭টি নতুন দাবানলের চিত্র। আমাজনের আগুনের ওপর নজর রাখছে নাসা। আগুনের তীব্রতার ছবিও পাঠাচ্ছে নাসার একাধিক স্যাটেলাইট। তবে আগুনের থেকেও বিজ্ঞানীদের বেশি ভাবাচ্ছে আগুন থেকে সৃষ্টি হওয়া ধোঁয়া।

এমএস/