ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কাশ্মীর নিয়ে ভারতের বিশিষ্টজনের অসন্তোষ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:২৮ পিএম, ২৪ আগস্ট ২০১৯ শনিবার

কাশ্মীর নিয়ে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দেশটির বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা সম্বলিত ৩৭০ ধারা তুলে দেয়ায় এ সমালোচনা করেছেন তারা। সমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, স্বনামধন্য লেখিকা মানবাধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায়, দেশটির পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সোনিয়া পুত্র সাবেক কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীসহ আরো অনেকে।

অমর্ত্য সেন: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন কাশ্মীর নিয়ে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের তীব্র সমালোচনা করে কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা সম্বলিত ৩৭০ ধারা তুলে দেয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, এটি যে শুধুমাত্র সব মানুষের অধিকার বজায় রাখার বিরোধিতা করেছে তা নয়, এই পদক্ষেপে সংখ্যাগরিষ্ঠের কথাও ভাবা হয়নি। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলে সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়ে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, গণতন্ত্র ছাড়া কোনোভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এছাড়াও, একজন ভারতীয় হিসেবে গর্বিত নন বলেও মন্তব্য করেছেন বিশ্বখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ।

অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, কাশ্মীরে যেভাবে যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের সাফল্য আসতে পারে না। গণতান্ত্রিক সরকার সবসময়ই আলোচনার মাধ্যমে এগোয়। এখন সরকার যখন বলে তারা শুধু পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা করবে তখন আমি মনে করি না যে সরকার সত্যিই গণতন্ত্রের জন্যে কোনো অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে চায়। আমি মনে করি না যে, গণতন্ত্র ছাড়া কাশ্মীর সমস্যার কোনো সমাধান হতে পারে। নিয়ে তো অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করা হচ্ছে।

সরকার বলছে তারা কাশ্মীরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্যে অভিযান চালাচ্ছে। আপনি কী মনে করেন?

অমর্ত্য সেন বলেন, এটি হচ্ছে পুরনো উপনিবেশিক মানসিকতার অজুহাতমূলক বক্তব্য। ব্রিটিশরা যখন এখানে শাসন করেছেআমি আমার শৈশবের কথা বলছি, আমি মাঝে মাঝেই আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে যেতাম। তিনি কারাবন্দি হয়েছিলেন। তখন ব্রিটিশরা বলতো তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্যে তাকে কারাগারে রেখেছে। এসব ধরপাকড়ের মাধ্যমে সেই উপনিবেশিক যুগে ফিরে যাওয়া হচ্ছে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, গোটা বিশ্বে গণতান্ত্রিক আদর্শ অর্জনের জন্য এতো কিছু করেছে ভারত। তবে এখন আর আমি একজন ভারতীয় হিসেবে এই সত্য নিয়ে গর্বিত নয় যে ভারতই গণতন্ত্রের পক্ষে প্রথম প্রাচ্যের দেশ ছিলো। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে যা করা হচ্ছে, তাতে আমরা সেই খ্যাতি হারিয়ে ফেলেছি।

অরুন্ধতী: কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ভারতের স্বনামধন্য লেখিকা মানবাধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায়। তিনি বলেন, হঠাৎ করে তাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নিয়ে লাখ লাখ সেনা মোতায়েন করে তাদের প্রতিবাদ করার অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে ভারত সরকার।

ব্যাপারে নিউইয়র্ক টাইমসে একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। তাতে কাশ্মীরের বর্তমান সেনা অভিযান নিয়ে অরুন্ধতী রায় তার উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন।

প্রভাবশালী ওই মার্কিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি লেখেন, কাশ্মীরের নিরাপত্তা বাহিনীর টহল ব্যারিকেডে ঘেরা রাস্তাগুলোতে এখন সুনসান নীরবতা, লাখ লাখ মানুষ অবরুদ্ধ অপদস্থ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। কাঁটাতারে বন্দি এসব মানুষের ওপর ড্রোন দিয়ে নজরদারি চালানো হচ্ছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে পুরোপুরি অচলাবস্থার মধ্যে বাস করতে হচ্ছে তাদের।

যদি তথ্যপ্রবাহের যুগে সরকার এত সহজে গোটা জনসংখ্যাকে বাকি দুনিয়া থেকে কয়েক দিন ধরে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারে। তবে সামনের সময়গুলো কেমন হবে তা গুরুতরভাবে ভাবনার বিষয়।

নিউইয়র্ক টাইমসে লেখা নিবন্ধে এভাবেই কাশ্মীরের সাম্প্রতিক সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন স্বনামধন্য লেখিকা মানবাধিকারকর্মী।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, সরকার যেখানে নিজেই দাবি করে যে গুটিকয়েক জঙ্গি ছাড়া বেশিরভাগ মানুষ তাদের সমর্থন করে, সেখানে কেন লাখ লাখ সেনার উপস্থিতি।

নিবন্ধে বলা হয়, গত ৩০ বছরে কাশ্মীরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যা কিছু করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। কাশ্মীর সংঘাতে বেসামরিক, সামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মিলিয়ে পর্যন্ত ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। লাখো মানুষ গুম হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে।

মমতা: সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলপদ্ধতি জম্মু-কাশ্মীরকে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও মন্তব্য না-করলেও, যে-পদ্ধতিতে এই বিল পাস করানো হয়েছে, তানিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

গত ৭ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চেন্নাই যাওয়া পথে কলকাতা বিমানবন্দরে নিজের অসন্তোষ গোপন না-করে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ওরা (কেন্দ্র) সবদলের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। প্রয়োজনে কাশ্মীরে এই বৈঠক করলে আমরা তাতেও যেতে পারতাম। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম। কাশ্মীরের মানুষের আস্থা অর্জন করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। এভাবে বিল পাস করানো একেবারেই অগণতান্ত্রিক। এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই।

কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘এমন কিছু করুন, যাতে ওরা নিজেদের ভারতীয় নাগরিক বলে মনে করেন। কাশ্মীরের মানুষ যাতে আতঙ্কিত হয়ে না-পড়েন তাদের মধ্যে সেই বিশ্বাসটা জাগিয়ে তোলা দরকার।

রাহুল: জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ নিয়ে প্রথমবার মুখ খুলেছেন রাহুল গান্ধী। এক টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বন্দি করা হচ্ছে। সংবিধান লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এই দেশ জনগণের তৈরি, দেশটা কয়েক টুকরো জমি নয়। প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করা হচ্ছে। যা দেশের নিরাপত্তায় গভীর প্রভাব ফেলছে।

প্রসঙ্গত, গত আগস্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে পার্লামেন্টে একটি বিলও পাস করা হয়। এই পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে কাশ্মীরজুড়ে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত সেনা। রাজ্য পুলিশসহ সেখানে প্রায় লাখ নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন হয়, যা উপত্যকাকে বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকীকৃত এলাকায় পরিণত করেছে।

গত আগস্ট ৩৭০ ধারা বাতিলের আগে থেকেই কাশ্মীরে ইন্টারনেট এবং ফোন পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। ছাড়া গোটা রাজ্যজুড়ে ছিল কারফিউ, স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে সেখানকার জনজীবন। জম্মু-কাশ্মীরে আধাসামরিক বাহিনীর ৩৫ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়। পরে নতুন করে সেখানে নিয়োজিত হয় আধাসামরিক বাহিনীর আরও হাজার সদস্য।

আরকে//