ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

শুকরিয়া’য় জীবন হয়ে উঠে আনন্দময়

মাসুদ আলম

প্রকাশিত : ১১:৫৫ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ১১:৫৬ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০১৯ সোমবার

জীবন আনন্দ বেদনা, সুখ দুঃখ, সাফল্য ব্যর্থতার এক অধ্যায়। কখনো আনন্দের প্লাবন এসে জীবনকে করে তোলে উপভোগ্য। কখনো দুঃখ এসে জীবনকে করে তোলে ভারাক্রান্ত। তেমনি সাফল্যে আমরা উদ্বেলিত হই এবং ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়ি। জীবনে যতই ঝড়ঝঞ্জা আসুক না কেন এসব মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।

জীবন বারবার শুরু করার আরেক নাম। কখনো, কোন অবস্থাতেই হালছাড়া যাবে না, থামা যাবে না। সাফল্য না আসা পর্যন্ত অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সাফল্যের পথে প্রথম পদক্ষেপ  হলো শুকরিয়া বা (কৃতজ্ঞচিত্ততা)। শোকর আলহামদুলিল্লাহ, থ্যাংকস গড, প্রভু তোমাকে ধন্যবাদ। ছোট্ট এ বাক্যটি বলার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় সঠিক জীবনদৃষ্টি। অর্থাৎ আপনি প্রথম পা ফেলতে শুরু করলেন সাফল্যের পথে। শুকরিয়া মনকে প্রশান্ত করে। মুহুর্তে ব্যক্তির চিন্তার জগতকে বদলে দেয়। ব্যাক্তি সচেতন হয়ে উঠে বর্তমান উপকরণ সর্ম্পকে, ভাবতে পারে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে।

একটি শিশু জন্মের পর প্রথমে চিত হয়ে শুয়ে শুধু হাত পা নাড়ে। একসময় সে কাত হয়, পরে উপুড় হয়। তারপর শুরু হয় হামাগুড়ি দিয়ে হাতে-পায়ে হাঁটা। এরপর সে উঠে দাঁড়ায়, হাঁটি হাঁটি পা পা করে। হাঁটতে গিয়ে সে বারবার পড়ে। আবার উঠে দাঁড়ায়, আবার হাঁটতে শুরু করে। একসময় কারো সাহায্য ছাড়াই সে হাঁটে দৌড়ায়। ঠিক একইভাবে ক্রমাগত লেগে থাকতে হয়। জীবনের চিত্রটাও ঠিক এরকম।

জন্ম থেকে একটি শিশু মা-বাবার পরম মমতা ও আদর যত্নে বড় হতে থাকে। এক সময় মা-বাবা’র অবর্তমানে একাই পথ চলতে হয়। জীবন চলার পথের চ্যালেঞ্জটা শুরু হয় তখনি। মা-বাবা কত কষ্ট করে শৈশব কৈশরে লালন পালন করেন। শিক্ষিত করে মানুষ করেন। সম্পত্তির উত্তরাধিকার করেন। বিনিময়ে কী দিতে পারি জনমদুঃখী মা-বাবাকে? বৃদ্ধ বয়সে একটুখানি সহানুভূতি, মমতা, সদাচরণ ছাড়া আর কী-ইবা প্রত্যাশা ? অথচ ক’জন’ই বা মা-বাবা’র এ ছোট্ট প্রত্যাশাকে পুরণ করতে পারি।

অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ আদেশ করেছেন যে, “তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করবে না। বাবা-মা’র সাথে ভালো ব্যাবহার করবে। তোমার জীবদ্দশায় তাঁদের একজন বা উভয়েই যদি বার্ধক্য উপনীত হয়, তবুও তাঁদের ব্যাপারে ‘উহ-আহ’ শব্দ পর্যন্ত কোরো না। তাঁদের ধমক দিও না বা অবজ্ঞা কোরো না, তাঁদের সাথে আদবের সাথে কথা বলো। শ্রদ্ধাভরা দৃষ্টিতে মমতার ডানা মেলে ছায়ার মতো আগলে রাখো এবং সবসময় তাঁদের জন্যে দোয়া করো” 
‘হে আমার প্রতিপালক! আমার মা-বাবা শৈশবে যে মমতায় আমাকে লালন করেছেন, তুমিও তাঁদের উপর সে-রূপ করুণাবর্ষণ করো।’(সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-২৩,২৪)

পিতামাতা মহান স্রষ্টার নেয়ামত। পিতামাতা সবসময় সন্তানের উপর ছায়া হয়ে থাকে। তাঁদের দোয়া ও আর্শিবাদ সবসময় সন্তানের জন্য পাথেয়। যার পিতামাতা দুনিয়াতে নেই তাঁর দোয়া ও আর্শিবাদ করার কেউ থাকে না। তাই পিতৃমাতৃহীন সন্তানকে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হয় নিজের সৎকর্ম দিয়ে। সর্বদা সৎকর্ম, সদাচার, ধর্মচর্চা, দান, আর্তমানবতার সেবা করে যেতে পারলে ইহকালীন কল্যাণের পাশাপাশি মিলবে পরকালীন মুক্তি। সেই সাথে পিতামাতার জন্য সন্তানকে সবসময় দয়াময় প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতে হবে এই বলে- ‘রাব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়ানী সাগীরা’। জীবনে সর্বাবস্থায় শোকরগুজার থাকতে হবে। কী পেলাম কী পেলাম না এ হিসেব না করে, কী দিতে পারলাম পরিবার সমাজ তথা দেশকে এটাই জীবনের ব্রত হওয়া উচিত।

শোকরগুজার মন প্রশান্ত মন। প্রশান্ত মন সুস্পষ্ট বুঝতে পারে করণীয়-বর্জনীয় সর্ম্পকে, সহজেই সংযুক্ত হয়ে যায় শক্তির মূল উৎসের সাথে, যেখান থেকে উৎসারিত হয় সাফল্যের ফল্গুধারা। 
পৃথিবীর সকল ধর্মেই স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘‘হে মানুষ! আমি পৃথিবীতে তোমাদের (প্রাচুর্য, সম্পত্তি ও ক্ষমতায়) প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং দিয়েছি জীবনের সকল উপকরণ। হায়! তারপরও তোমরা কত কম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো’’।

‘‘হে নবী! ওদের বলো, আল্লাহই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনি তোমাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি দান করেছেন। সেইসাথে দিয়েছেন বিচারবুদ্ধি, অন্তকরণ। অথচ তোমাদের শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতার প্রকাশ খুবই কম’’। 

কৃতজ্ঞতা ও ধৈর্য একই সূত্রে গাঁথা। ধৈর্যশীল ব্যক্তি সহজে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে । ধৈর্য সর্ম্পকে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘‘হে বিশ্বাসীগণ তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন’’। 

‘‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের অনেককে ভয়, ক্ষুধা, জানমাল ও শ্রমের ফল বিনষ্ট করে অর্থাৎ বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করব। তবে এ বিপদের মধ্যে যারা ধৈর্যধারণ করে তাদের সুসংবাদ দাও। ধৈর্যশীলরা বিপদে পড়লে বলে আমরা আল্লাহর। তাঁর কাছ থেকে এসেছি। তাঁর কাছেই ফিরে যাব’’।

তাই জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় সৃষ্টিকর্তার কাছে বলুন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ/ প্রভুকে ধন্যবাদ/ থ্যাংকস গড ইত্যাদি কৃতজ্ঞতাসূচক বাক্য। সবসময় শোকরগুজার মানুষদের সংস্পর্শে থাকুন, সৎ সঙ্গে থাকুন। যা আপনাকে সবসময় প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত রাখবে এবং জীবনে আসবে ইতিবাচক পরিবর্তন।

মানুষের সহজাত অভ্যাস হলো মানুষ নিজের দিকে না তাকিয়ে অন্যের দিকে তাকায়। অন্যের কী আছে, অন্যে কী বলল, কী ভাবলো, কী করল এ নিয়েই বেশি ভাবে। অন্যের মতামতকে বেশী প্রাধান্য দেয়, অন্যের জিনিসটা বেশি দামী মনে হয়, অন্যের হাসি দেখলে বেশী সুখী মনে হয় ইত্যাদি। অন্যের দিকে তাকাতে গিয়ে মানুষ আসলে নিজের কী আছে তা-ই ভুলে যায়। অন্যের দিকে তাকিয়ে কোন লাভ নেই। আমাদের তাকাতে হবে নিজের দিকে। যত নিজের দিকে অন্তরদৃষ্টি দিয়ে তাকাবেন ততই বিস্মিত হবেন। যাদের সাফল্য আমাদের ক্ষণিকের জন্য ঈর্ষান্বিত করে তোলে তাদের প্রাপ্তির পেছনের সকল উপকরণ সব মানুষের মধ্যে বিদ্যমান, যা দিয়ে সে অনায়াসে নতুন উদ্যমে শুরু করতে পারে।

আজ যে আমরা সুস্থ্যদেহে ঘুম থেকে উঠতে পেরেছি এজন্য স্রস্টার কাছে শুকরিয়া আদায় করা প্রয়োজন। গতকাল কয়েক লক্ষ মানুষ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন, বহু মানুষ অসুস্থ্য হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। আপনি বেঁচে আছেন, কাজ করার, জীবনকে উপভোগ করার আরও একটি দিন পেয়েছেন, আপনার শোকরগোজার হওয়ার জন্যে এটাই যথেষ্ট। 

আমরা যে এখনও বেঁচে আছি দম নিতে পারছি এটিই হতে পারে শুকরিয়া আদায়ের একটি প্রধান কারণ। হাসপাতালের বেডে শায়িত রোগীর কথা ভাবুন , যিনি দমও নিতে পারছেন না, যাকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। মানবদেহের কথাই ভাবুন। এতে রয়েছে পাঁচ শতাধিক মাংশপেশী, দুই শতাধিক হাড়, ৭০ থেকে ১০০ ট্রিলিয়ন দেহকোষের সমন্বয়ে গঠিত শরীরের প্রতিটি কোষে খাবার ও অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে, শিরা ও ধমনীর ৬০ হাজার মাইল দীর্ঘ পাইপলাইন দিয়ে। রয়েছে ফুসফুসের মত রক্ত শোধনাগার। হার্ট কোনরকম ক্লান্তি ছাড়াই প্রতিদিন প্রায় লক্ষবার স্পন্দনের মাধ্যমে ১৬ শত গ্যালনেরও বেশী রক্ত পাম্প করে দেহকে সচল রাখছে। রয়েছে লেন্সের মতো একজোড়া ছোট চোখ, যা দিয়ে বিশাল পৃথিবীর সৌন্দর্য্য অবলোকন করা যায়। রয়েছে মানুষের মনোদৈহিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী মস্তিস্করূপী জৈব কম্পিউটার যা যেকোন কম্পিউটারের চেয়েও কমপক্ষে দশ লক্ষ গুণ বেশী শক্তিশালী। কম্পিউটারের দামের অনুপাতে প্রতিটি মানুষের মস্তিস্কের মূল্য কমপক্ষে পাঁচহাজার কোটি টাকা।

বিশ্বের সাড়ে ছয় শত কোটি মানুষের মধ্যে প্রতিটি মানুষ অনন্য। একজনের মত হুবহু কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেককে অনন্য করে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আপনাকে এমন কিছু মেধা ও যোগ্যতা দিয়েছেন যা আর কাউকে দেননি। যত নিজের দিকে তাকাবেন তত দেখবেন, সাফল্যের জন্য যে উপকরণ প্রয়োজন তার সবই আপনার রয়েছে। এ উপকরণগুলো ব্যবহার করে একজন মানুষ নির্মাণ করতে পারে নিজের ভবিষ্যত। 

এজন্য প্রথমে এক এক করে তালিকাভুক্ত করতে হবে কী কী আছে আপনার। কোন কোন জিনিসের জন্য আপনি শোকরগুজার হবেন। আপনি কী কী পারেন, আপনার বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্টগুলো কী? দেখবেন নিজের ভেতরের গুণ বা যোগ্যতাগুলো মনে আসলে নিজেই বিস্মিত হবেন।

এসি