ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

 ‘উত্তম কুমারের মৃত্যু সংবাদে কেঁদেছিলেন মা’

শান্তা মারিয়া , কবি ও সাংবাদিক

প্রকাশিত : ১২:২৯ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ১২:৩৭ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০১৯ শনিবার

শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া

আমার বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ৩১ আগস্ট তারিখটি কখনও বিনা উদযাপনে পার হতে দিতেন না। আমার মায়ের জন্মদিনটি তিনি কখনও ভুলতেন না। আজ মায়ের জন্মদিনে সেই পুরনো গল্পগুলোই না হয় করি।

বাবা, মা, ভাই, বোন নিয়ে আমাদের ছোট্ট পরিবারে চারজনের জন্মদিনই খুব উত্সাহ নিয়ে পালন করা হতো। আম্মার জন্মদিনে আমার খালারাও আসতেন। বিশেষ করে বিউটি খালা ও সুইটি খালা। আসতেন খালাতো ভাইবোনেরা। কি সুখের দিনগুলো যে ছিল।

আমার মায়ের নাম ফয়জুননেসা খাতুন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী এবং অতি স্পষ্টবক্তা।

দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, সাহস, নৈতিকতা ও সততার জন্য চারপাশের মানুষ তাকে সম্মান করে। কবিতা ভালোবাসতেন খুব। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ। এখন অসুস্থতার জন্য সব ভুলে গেলেও কবিতা ভোলেননি।

আপন মনে বলে ওঠেন ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর’। আমার রবীন্দ্র প্রীতির পুরো দায়-দায়িত্ব মায়ের। জন্মের আগের থেকে ‘শিশু’ আর ‘সঞ্চয়িতা’র সব কবিতা আবৃত্তি শুনতে শুনতে মগজ-ধোলাই হয়ে গেছে।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। কামরুননেসা ও ইডেনের মেধাবী ছাত্রী। কিন্তু বিয়ের পর ‘আজিমপুর গার্লস স্কুলে’ কিছুদিন চাকরি করার পর ছেড়ে দেন। আমার ভাই তখন খুব ছোট। আমার বাবা তাকে চাকরি বা কোন সংগঠন করতে খুব উত্সাহ দিতেন। প্রায়ই বলতেন ‘শুধু সংসার নিয়ে পড়ে থাকলে কি লাভ? তোমার প্রতিভার অপচয় হচ্ছে।’

কিন্তু মায়ের অতিরিক্ত উদ্বেগ ছিল আমাদের জন্য। মনে করতেন তিনি চাকরি বা অন্য কিছু করলে আমাদের অযত্ন হবে। বাবার প্রতিও তার যত্নের শেষ ছিল না। বিশেষ করে জেল থেকে বাবা যে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাঁধিয়ে নিয়ে আসেন সেটার দিকে মায়ের খেয়াল ছিল পুরো মাত্রায়। আমাদের তিনজনের কারও বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলেই টেনশনে মা অসুস্থ হয়ে পড়তেন।

মায়ের এই অতিরিক্ত টেনশনের কারণেই বাবা সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। তিনি চাইতেন স্বামী ও ছেলে-মেয়েরা সারাক্ষণ কাছাকাছি থাকবে।

আমার মা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির লেশমাত্র তার মধ্যে ছিল না। কোনদিন দেখিনি পীর, ফকিরের কাছে বা মাজারে দৌড়াতে। একটা ছোট ঘটনা বলি। তাহলেই বোঝা যাবে মানুষটি কেমন ছিলেন তার যৌবনে।

কি একটা কাজে আমি আর মা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরিতে যাচ্ছিলাম। বোধহয় কোন একটা বই দেখার দরকার ছিল। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ঢুকতে হলে তখন বায়তুল মোকাররম মসজিদের একটা অংশ দিয়ে ঢুকতে হতো।

আমরা দুজন সেখানে ঢুকতে যাচ্ছি এক ভদ্রলোক (বোধহয় কেরানি গোছের কিছু হবেন) মাকে বললেন, মাথায় কাপড় দিয়ে আসুন। মা সেই লোকটির দিকে কড়াভাবে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার মাথার দিকে আপনার তাকানোর দরকার কি? আপনি চোখ নিচু করুন’। মায়ের কণ্ঠস্বর শুনেই সেই ভদ্রলোক আর দ্বিতীয় বাক্য ব্যয় করার দুঃসাহস করেননি।

মায়ের ছিল গল্পের বইয়ের নেশা। শরত্চন্দ্রের উপন্যাসগুলো মোটামুটি মুখস্ত ছিল। বিমল মিত্র, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন বই বাজারে এলেই কিনে ফেলতেন। কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম, আসামী হাজির, কত অজানারে, চৌরঙ্গী ছিল নিত্যসঙ্গী। উত্তম কুমারের বাঁধানো ছবি ছিল বাড়িতে। মনে আছে উত্তম কুমারের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সেকি কান্না।

আশির দশকের মাঝমাঝি যখন বাড়িতে ভিসিআর এলো তখন উত্তম-সুচিত্রার বেশ কয়েকটি ছবির ক্যাসেট বাবা তাকে উপহার দিয়েছিলেন। বাবা নিজে সিনেমা দেখতেন না একদমই। কিন্তু মায়ের এই উত্তম প্রীতিতে খুব মজা পেতেন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দারুণ ভক্ত আমার মা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন ঢাকায় আসেন তখন মা তার সঙ্গে দেখা করে ছিলেন। এখনও সারা দিন তার গান শোনেন।

উলের সেলাই ছিল মায়ের আরেকটি শখ। আমাদের সকলের জন্য কত যে সোয়েটার বানিয়েছেন। বাবা জ্যাম, জেলি খেতে ভালোবাসতেন বলে পেয়ারার মৌসুমে বয়াম ভরে ভরে জেলি বানাতেন।

আত্মীয় স্বজন কাউকে দিতে বাকি রাখতেন না। আর বাবা যে তাকে কতটা ভালোবাসতেন সেটা অনুভব করি যখন পুরনো ছবির অ্যালবামগুলো দেখি। দুতিনটে অ্যালবাম তো শুধু মায়ের ছবিতেই ভরা। আমৃত্যু তাকে ছেড়ে থাকতে পারেননি।

আমি এবং আমার ভাই- এই দুজনের মধ্যে কাকে তিনি বেশি ভালোবাসেন? এই প্রশ্ন যখন অনেক আগে করেছি তিনি সব সময়ই বলেছেন ‘সমান। কোন পার্থক্য নেই।’ কোন বৈষম্য তিনি কোনদিন করেননি। বাবা-মা দুজনেই আমাদের বেলায় কোন বৈষম্য করেননি একথা ঠিক। ভাই বড় বলে তার উপর নির্ভরতা একটু বেশি ছিল আর আমি ছোট বলে আগলে রাখার প্রবণতা।

তবে আমাদের দুজনের চেয়েও বোধহয় আমার ছেলেকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। আমার ছেলেকে জন্মের পর থেকে তিনিই লালন-পালন করেছেন বলা চলে। আমি নিশ্চিন্তে চাকরি করতে পেরেছি এ কারণেই।

আমার মায়ের যত গুণ ছিল তার এক শতাংশও আমার নেই। কিন্তু মায়ের প্রতি আমার অভিযোগ রয়েছে। সেটা হলো তিনি নিজের প্রতি একটুও সুবিচার করেননি। আমাদের জন্য, সংসারের জন্য শুধু খেটেই গেলেন। এত মেধা, এত প্রতিভা দিয়ে কী লাভ হলো?

তিনি কেন নিতান্ত সাধারণ গৃহিণীর ও মায়ের জীবন আতিবাহিত করলেন? কেন চাকরি করলেন না, লেখালেখি করলেন না বা কোন সংগঠনেও জড়িত হলেন না?

আজকেও যখন তার সঙ্গে ফোনে কথা বলছি, নিজের অসুস্থতা নিয়ে তার কোন অভিযোগ বা কথা নেই। শুধু জিজ্ঞাসা করেন আমি কেমন আছি, অর্ণ কেমন আছে। আমরা ভালো থাকলেই যেন তার ভালো থাকা।

এত স্নেহ, এত মমতা ভালো নয়, একটুও ভালো নয়। জন্মদিনে তার সুস্থতার জন্য, আয়ু বৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করি। আর শুধু ভাবি আহা, তিনি যদি আমার মতো একটু স্বার্থপর হতেন তাহলে অনেক সুখে থাকতে পারতেন।

এমএইচ/