ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

পাকিস্তান সরকারের বাধা দমিয়ে রাখতে পারেনি ডা. আমজাদকে

স্বপন মির্জা, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত : ১২:৩৬ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ বুধবার

অনগ্রসর বাঙালিরা যাতে ব্যবসায়িকভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে নিজেদের চাহিদা পুরণ করে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের পণ্যের প্রসার না করতে পারে পাকিস্তান সরকারের এমন বাধা দমিয়ে শিল্প কল কারখানা স্থাপনের প্রথম উদ্যোক্তা ডা. মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন। পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের এই ক্যাপ্টেন কর্মকর্তা ২ বছর পরই চাকরি ছেড়ে দিয়ে মূল লক্ষ্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করে অভূতপুর্ব সফলতা অর্জন করার পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যতম শিল্প উদ্যোক্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা বিস্তার এবং সামাজিক অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ভূমিকা রেখেছেন। কর্মগুণে নানা প্রতিভার দৃষ্টান্ত ডা. মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেও মানব হিতৈষী উদ্যোগ তাকে আজীবন বাংলার মানুষের মাঝে উজ্জল করে রাখবে।

১৯ শতকের প্রথম দিকের সময়টি ব্রিটিশ শাসনে যুক্ত ছিল পুরো ভারতবর্ষ। তখন পাবনা জেলার অধীনস্ত সিরাজগঞ্জ শহর রাজনৈতিকভাবে উর্বর ভূমি হলেও গাও-গ্রাম ছিল অনেকটাই অবহেলিত ও অনুন্নত। তখন এনায়েতপুর তেমনি একটি অনগ্রসর গ্রাম ছিল। আর এখানেই ১ অক্টোবর ১৯২৫ সালে একটি সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে পিতা মুসলেম উদ্দীন এবং মাতা বেগম মেহের-উন-নেছার কোল জুড়ে জন্মগ্রহণ করেন ডা. মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন।

পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, ডা. মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেনের পূর্ব পুরুষ ছিলেন বাংলার নবার মীর কাসিমের সেরেস্তাদার। বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমের পরাজয় হলে তারা আত্মরক্ষায় পূর্ব বাংলায় এসে বসবাস শুরু করেন। সে সময় এনায়েতপুর ছিল যমুনা তীরে ঝোপ-ঝাড়, গাছ-গাছালি ঘেরা প্রায় জনশূন্য একটি অঞ্চল। মাত্র কয়েক ঘর হিন্দু কৃষি ও জেলা পরিবারের বসবাস ছিল। পরে ডা. আমজাদ হোসেনের মত আরও কিছু মুসলিম পরিবার এখানে এসে বসতি গড়ে তোলেন। এরপর ধীরে-ধীরে গড়ে ওঠে তাঁত শিল্প। যা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। তখন ডা. আমজাদের নানা আকবার আলী ছিলেন পাবনা জেলার একজন প্রখ্যাত ধনাঢ্য তাঁতী। ঠাকুরগাঁওয়ে ছিল তার বড় শাড়ী-লুঙ্গীর দোকান। কিন্তু পরবর্তীকালে তার বংশধরেরা অর্থ কষ্টে পড়েন। মূলত, এনায়েতপুরে সৃষ্ট দাবানলে অধিকাংশ ঘরবাড়ি ভষ্মিভূত হওয়ায় সবাই সর্বস্বান্ত হন। ডা. আমজাদ হোসেনের পরিবারও এর আওতাভুক্ত ছিলেন। পিতার দূরদৃষ্টি ও সব পরিস্থিতিতে মাতার ধৈয্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট তার জীবনে প্রভাব ফেলেছে। তাদের সহজাত গুণাবলি তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। পরবর্তীকালে যা তার ব্যবসা প্রসারে সহায়তা করেছে। এমনকি তিনি পারিবারিক ব্যবসাকে পূর্ণতা দিতেও সক্ষম হয়েছেন। এ কারণে গোটা পরিবার সিরাজগঞ্জ জেলা জুড়ে সুনামের সঙ্গে আলহাজ পরিবার নামে বিখ্যাত। 

ডা. মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেনের শৈশব ও কৈশর কেটেছে যমুনা নদীর তীরবর্তী এনায়েতপুরের শ্যামল প্রান্তরে। ১০ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছেলে বেলায় ছিলেন অত্যান্ত দুরন্ত ও প্রাণচঞ্চল। আসর মাতিয়ে দিতে পারতেন অনায়াসে। নদীতে সাঁতার ও খেলাধুলায় ছিলেন পারদর্শী। ফুটবল খেলা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। ছিলেন খাদ্য রসিকও। বিভিন্ন খাবার খেয়ে ছিলেন পটু। কিন্তু পারিবারিক অনটনের কারণে ভাল খাবার খাওয়া সম্ভব ছিল না। বরাবরই ছিলেন মিতাহারী। আর এ কারণে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে সুদীর্ঘ ৮৭ বছর বয়স পর্যন্ত সুস্থাবস্থায় বেঁচে ছিলেন। এ সবই সম্ভব হয়েছিল তার সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন ও খাদ্যাভ্যাসের কঠোর নিয়ন্ত্রণের জন্য। এজন্য তার পীর ও শ্বশুর খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (র.) স্বল্প আহার তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। পাশাপাশি তার নসিহত মেনে স্বল্প নিদ্রাও অনুসরণ করেছেন।

ডা. মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেনের জীবনী নিয়ে শ্রদ্ধা স্মারক বইটিতে লেখা থেকে জানা যায়, বাংলা ১৩৩০ সনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এনায়েতপুর গ্রামের প্রায় সব পরিবারই নিঃস্ব হয়ে যায়। অন্যদের মত তাদের পরিবারও বিপর্যস্ত হয়। তার বাবার উপার্জন হিসেবে সামান্য জমি আবাদ ও ছোট ব্যবসা পরিচালনা করে ১০ ভাই-বোনের বড় পরিবারের সংসার চলতো কোন রকমে। তাই মেধাবী বালক আমজাদের লেখাপড়া চলতো অনেক কষ্টে। মুলতঃ তার লেখা-পড়ার হাতেখড়ি খাজা পীর শাহ সুফী ইউনুস আলী এনায়েতপুরী (র.) কাছ থেকে। আমজাদ হোসেনের বাবা মুসলেম উদ্দীন ছিলেন তার একনিষ্ঠ মুরিদ। বাবার সঙ্গে হুজুরের খানকায় এসে আরবি, ফারসি ও উর্দু শিখেছেন। অত্যান্ত মেধাবী ও স্মৃতি শক্তি প্রখর থাকায় হুজুর তাকে খুবই পছন্দ করতেন।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় চৌহালীর মালিপাড়ায় অবস্থিত স্থল পাকড়াশী হাই স্কুলে। এনায়েতপুর থেকে ৫ মাইল দুরে অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠানে শুকনা মৌসুমে পায়ে হেটে ও বর্ষায় নৌকা বেয়ে যাতায়াত করতেন। এ কারণেই সাঁতারে ছিলেন তিনি বেশ পারদর্শী। নানা দুর্ভোগ ও অর্থ কষ্ট থাকলেও লেখাপড়ায় অদম্য আগ্রহ তাকে নিয়ে গিয়েছিল কাঙ্খিত লক্ষে। এখান থেকে ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে বিজ্ঞানে আইএসসি পাশ করেন। তারপর ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বাবা-মায়ের উৎসাহে গিয়ে ঐতিহ্যবাহী কলকাতা মেডিকেল কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। নানা চড়াই উৎড়াইয়ের মধ্যে লেখাপড়া ভাল করায় বৃত্তি পেতেন এবং অন্যান্য খরচ গোছাতে ছোট ব্যবসাও করতেন।

এরপর তিনি ১৯৪৮ সালে যোগ্যতার সঙ্গে এমবিবিএস পাশ করে ১৯৫০ সালে খাজা এনায়েতপুরীর (র.) তৃতীয় কন্যা খাজা তাজ মহলের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবব্ধ হন। ১৯৫২ সালে পাকিস্থান আর্মির মেডিকেল কোরে বাধ্যতামূলকভাবে তাকে যোগদান করানো হয়। বিয়ের ১ বছরের মধ্যে তাকে যেতে হয় সৈনিক হিসেবে কাশ্মীর যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে অবস্থান কালে হারান শ্রদ্ধেয় পীর ও শ্বশুর খাজা এনায়েতপুরীকে (র.)। এরপর লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডিতে কাজ শেষে ক্যাপ্টেন পদন্নতি দিয়ে তাকে বদলি করা হয় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে। তখন চট্টগ্রামের উত্তর নালাপাড়ায় সপরিবারে থাকতেন তারা। সে সময় একজন ক্যাপ্টেনের জীবন ছিল প্রাচুর্যে ভরা। বেতনের টাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে চলেও উদ্বৃত্ত থেকে যেত। কিন্তু চাকরি তাকে আকর্ষণ না করায় স্বপ্ন ছিল ব্যবসায়িকভাবে প্রচুর উপার্জন করতে। তখন হঠাৎ করে সুযোগটাও এসে যায় তার। সে সময় কন্টোলার অব ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট দফতরের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডা. এম এম আমজাদ হোসেনের পরিচয় হয়। এই সুবাদে তিনি রং ও কেমিক্যাল আমদানিতে আগ্রহী হন। ১৯৫৩ সালে সংগ্রহ করেন ওজিএল লাইসেন্স। এর ফলে তিনি পেয়ে যান প্রভুত উপার্জনের সুযোগ।

তদানীন্তন পুর্ব পাকিস্তানের বাঙালী হিসেবে প্রথম ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে সুতার রং আমদানি করার জন্য এলসি খোলেন। যা দেশের তাঁত শিল্প সমৃদ্ধে বিরাট ভূমিকা পালন করে। তবে তিনি অনুধাবন করেছিলেন চাকরি করে পুরোপুরি ব্যবসায় মনোনিবেশ সম্ভব নয়। অতএব ১৯৫৫ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি ব্যবসায় নিয়োজিত হন। তার পরিকল্পনা সফল হয়। এরপর পাটের ব্যবসা ও তা বিদেশ রফতানি, তাঁত কারখানা, ঢেউটিন, ওষুধের কাচামাল, কোরোসিন তেল আমদানি ব্যবসায় দক্ষতা ও দুরদর্শিতায় তার সফলতার ব্যাপক প্রসার ঘটে। ব্যবসার কাজে করাচিতে অবস্থান কালে ১১ দিন বয়সের তার ৪র্থ সন্তান মারা যায়। কর্মই ধর্ম, এই ছিল তার ব্রত। আর ছিল অসীম সহ্য শক্তি। ফলে সব যন্ত্রণা কষ্ট তিনি নিরবে সয়ে যেতেন।

এরপর শিল্পে দক্ষতায় সমৃদ্ধ করতে পুর্ব পাকিস্তানে দেশে প্রথম বারের মত ১৯৫৮ সালে টেক্সটাইল মিল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে করাচিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। কিন্তু অনুমতি না দিয়ে বাঙালিদের দ্বারা ব্যবসা হবে না বলে ডা. এম এম আমজাদ হোসেনকে ছাফ জানিয়ে দেয়া হয়। তখন হতাশ হয়ে ফিরলেও তিনি দমে জাননি। পরে পুর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর মোনেম খান ও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারর্দীর সঙ্গে দেখা করে অনুমতি আদায় করে নেন।

তবে পাক শিল্প মন্ত্রনালয় শর্ত জুড়ে দেন ঢাকায় না করে ৭৫ ভাগ বিহারী অধ্যুষিত পাবনার ঈশ্বরদীতে করার জন্য। নাছরবান্দা আমজাদ হোসেন এ শর্ত মেনে বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানীদের মনোভাব ভুল প্রমাণ করে অনুন্নত ঈশ্বরদীতে নানা প্রতিকূলতা মেনে জাপান থেকে মেশিনারিজ এনে চালু করেন আলহাজ টেক্সটাইল মিল। ১২ হাজার স্পনডলের এ মিলে ৫ শতাধিক মানুষের তখন কাজের সুযোগ হয়। এখান থেকে দেশের তাঁত শিল্পে সুতার চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হতো। শুরু হয় কাপড় উৎপাদনও। এই সাফল্য পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাঙালিদের প্রতি তাদের কুদৃষ্টির মনোভাব কতটা ভুল। এরপর চট্টগ্রামের ক্যাপোক মিল, ১৯৬৭ সালে জামালপুরের সরিসাবাড়িতে আলহাজ জুট মিল, ১৯৮২ সালে ড্রাগ ইন্টা. লিমিটেড ওষুধ কোম্পানি, ১৯৯৪ সালে সফ্টওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান এটিআই, এটিআই সিরামিকসহ বিভিন্ন ভারি শিল্প কারখানা গড়ে তোলেন। পরে ভারতের শিলিগুড়ি ও কুচবিহারে চা শিল্প সফল হলে এপারেও সম্ভব, এমন ধারণা নিয়ে পঞ্চগড়ে এমএম টি এস্টেট লিমিটেড সুবিশাল চায়ের বাগান গড়ে তোলেন। তিনি টানা ৩ বার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। রাষ্টয়াত্ব অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেন। দেশের সেরা শ্রেষ্ঠ করদাতা এবং ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি সিআইপি মনোনিত হয়েছেন। মানুষের দৌড় গোড়ায় বিশ্বের আধুনিক চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষার বিস্তার কল্পে খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরীকে (র.) উৎস্বর্গ করে ২০০৩ সালে নিজ গ্রাম সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে দেড়শ একর জায়গায় ৫৮৬ বেডের দেশের বৃহৎ বিশ্বমানের অলাভজনক খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল, খাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয়, খাজা ইউনুছ আলী নার্সিং কলেজসহ বেশ কয়েকটি সেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। যা দেশ ও জনগনের জন্য সেবামূলক অলাভজনক ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান। যেখানে দেশ-বিদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা লেখা-পড়ার সুযোগের পাশাপাশি প্রতিদিন হাজারো সব ধরনের রোগীদের সুলভে চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে।

এতে শিশু, প্রসূতি মা, ডেন্টাল রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা এবং ৫ শতাংশ বেডে সব দরিদ্র রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানের এমন সেবা কার্যক্রম দেশ-বিদেশে প্রসংশিত। এজন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারের কর্তা ব্যক্তি, বিদেশের রাষ্ট্রদূত এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি অত্যান্ত সহজ-সরল ও সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তার নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একেবারে উচ্চ মানের। যার প্রমাণ খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (কেওয়াইএএমসিএইচ) ক্যাম্পাস। এর অনন্য সুন্দর স্থাপত্য শৈলী আর অনুপম ল্যান্ডস্কেপ সাড়া দেশ তথা বিশ্বের যে কোনও প্রান্ত হতে আসা মানুষদের মুগ্ধ ও বিষ্মিত করছে।

৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অসহায় হিন্দুসহ অন্যান্যদের আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের আহারে ও নানাভাবে সহায়তা করেছেন আমজাদ হোসেন। তিনি সময় পেলেই ররীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত আর আধুনিক গান শুনতেন। নজরুলের রেকর্ড করা আবৃতিও শুনতেন। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে তিনি উপভোগ করতেন মানসিক আনন্দ। তিনি স্বজনদের বলতেন বই পড়া তার প্রথম শখ। তিনি বলতেন, বই হলো এমন এক বন্ধু যে কখনও বিশ্বাস ঘাতকতা করে না, কখনও তোমার সঙ্গ ছাড়বে না। 

হাসপাতালের বিছানা, কাজের ফাকে আর বিকালের অবসরে যেখানেই হোক না কেন বই ও পত্রিকা পড়া তার লাগবেই। বাদশাহ নামদার বইটি ছিল তার প্রিয়। যা তাকে উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করেছে জীবন জুড়ে।

তার স্ত্রীর বড় ভাই ও এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফের বর্তমান সাজ্জাদনশীন পীর খাজা কামাল উদ্দিন নুহু মিয়া বন্ধু ডা. এম এম আমজাদ হোসেন সম্পর্কে বলেন, তিনি ছিলেন অত্যান্ত বন্ধুবৎসল, প্রতিভাধর, অধ্যবসায়ী ও উচ্চাকাঙ্খী। কলকাতা গেলে রফি আহমেদ কিদওয়াই স্ট্রিটে নিজেদের বাড়িতে না থেকে আমজাদ হোসেন লেখা পড়া কালে কলেজ স্ট্রিটের সিল ম্যানসনে তার হোস্টেলে গিয়েই উঠতাম। তার আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করতো বলে কষ্ট করে হলেও ডাবলিং করে থাকতাম।

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত এই ব্যক্তি ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছেন। তবে মানবিক কল্যাণে নিবেদিত তার প্রতিষ্ঠিত স্থাপনাগুলোর জন্য তিনি বেঁচে থাকবেন চির অম্লান হয়ে। বেঁচে থাকাকালীন ডা. আমজাদ হোসেন প্রায়সই বলতেন আমি পরাজিত সৈনিক। তার মেয়ে ডা. রুবাইয়াত ফারজানা হোসেন এ নিয়ে ব্যাখ্যা চাইলে মুচকি হাসতেন। কিন্তু কোনও জবাব দিতেন না। তবে এ নিয়ে ডা. রুবাইয়াত ফারজানা হোসেন জানান, তার মন ছিল চির তরুণ, উদ্যোমী, ছিল অসাধারণ কর্মস্পৃহা। কিন্তু বয়স নামক ব্যাধি তার শরীরকে তরুণ রাখতে দেয়নি। তাই তরুণ মন আর প্রৌঢ় শরীরের মাঝে চলতো টানাপোড়েন। হয়তো তার আরও অনেক কিছু প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু করে উঠতে পারেননি। যতটা করেছেন তাও কম নয় বটে। তবু হয়তো তার মন উঠতো না। কোথাও যেন অপূর্ণতা বোধ তাকে বিচলিত করতো।

ব্যবসা জীবনে শতভাগ সফল ডা. আমজাদ হোসেন ৮৭ বছরের দীর্ঘ জীবনে ৫০ বছরই ভুগেছেন ডায়াবেটিসে। ফলে তিনি নিয়ম মেনে ঘুম থেকে ফজরের নামাজের আগে উঠে ইবাদত শেষে বিবিসি বাংলা সংবাদ শুনে হাটতে বের হতেন। ফিরে হালকা নাস্তা করে শুরু করতেন দিনের কাজ। এ রুটিন তার বলবৎ ছিল আজীবন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এক ওয়াক্ত নামাজ কাযা করেননি ও একটি রোজাও ভাঙ্গেননি। অত্যান্ত মিতব্যয়ী এই মানুষটি সম্পর্কে তার বড় ছেলে খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালনা পরিষদের পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছেদ বা কোনও কিছুতেই বাহুল্য ছিল তার অপছন্দ। শার্ট-প্যান্ট ছিল তার মাত্র ২ সেট। দেশের শীর্ষ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের একজন হলেও এসি-এয়ারকুলার ব্যবহার করেননি অফিস কিংবা বাসায়। ভাত, মাছ, সবজি ও টমেটোর ডাল ছিল তার প্রিয় খাবার।

তিনি আরও বলেন, বাবা সাদামাটা পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রটোকল সম্পর্কে পুরোপুরি সজাগ ছিলেন। বিদেশি কোনও অতিথি বা দেশের কোনও উচ্চপদস্থ কারো সঙ্গে দেখা করতে গেলে বা তার কাছে এলে দামি সুট পড়তেন। তবে তা একটির বেশি দুটি ছিল না। হয়তো তার আকর্ষক ব্যক্তিত্বের কারণেই সুটটি অসাধারণ হয়ে উঠতো। তিনি সব দিক থেকে আমার কাছে একজন আদর্শ মানুষ। তিনি আমার কাছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। 

এদিকে খাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসার ডা. হোসেন রেজা বললেন, ডা. আমজাদ হোসেন সমারোহ, বিলাস-বাসনাকে পছন্দ করতেন না। তিনি মানবতা আর মানুষকে নিয়ে ভাবতেন। এতো বিত্ত-বৈভরের মালিক হয়েও তিনি খুবই সাদা-সিদে দিন যাবন করতেন।

তিনি আরও জানান, পৃথিবীর প্রধান ধনী মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস্ ডা. আমজাদ হোসেন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরম সৌভাগ্য ডা. মীর আমজাদ হোসেন এ দেশে জন্মেছেন। এ দেশ চরম দুর্ভাগ্য, এ দেশ তাকে চিনতে পারেনি’।

ডা. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সম্পর্কে সাবেক মন্ত্রী সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিশ্বাস ও বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সহ-সভাপতি এফ.আর সরকার জানান, তিনি অজো পাড়াগায়ে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান করে আমাদের এলাকাকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়েছেন। অজোপাড়া গায়ে দেশের প্রথম শিল্প কারখানা ও আধুনিক শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে মানুষকে সেবা দিয়েছেন। দুঃখী দরিদ্রদের দিয়েছেন নানাভাবে সহযোগিতা। এজন্য মানবতার এই বীরকে দেশবাসী চিরদিন স্মরণ রাখবে।

মানব হিতৈষী ডা. মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেনের আজ ১১ সেপ্টেম্বর ৭ম মৃত্যু বার্ষিকী। এ উপলক্ষে তার আত্মার মাগফিরাত কামনায় খাজা ইউনুস আলী (র.) মাজার শরিফ এবং তার প্রতিষ্ঠিত সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের অলাভজনক ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। বুধবার বাদ আছর হাসপাতালে অনুষ্ঠিত এই দোয়া মাহফিলে সব শুভাকাঙ্খীদের উপস্থিত থাকার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালনা পরিষদের পরিচালক ডা. আমজাদ হোসেনের বড় ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ আহ্বান জানিয়েছেন।