ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

দিন-রাত কেন হয়, রাতে কেন ঘুম হয়? কি বলে বিজ্ঞান ও ধর্ম?  

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:০৫ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার

কখনও কি ভেবে দেখেছেন, দিনের পরে রাত এবং রাতের পরে দিন কিভাবে হচ্ছে? কেন এমনটা হয়? মজার বিষয় হচ্ছে, যদি পৃথিবীতে আহ্নিক গতি না থাকতো তাহলে দিনের পরে রাত আসতো না বা রাতের পরে দিন হত না। এখন নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, আহ্নিক গতিটা আবার কি? আসুন, এবার জেনে নেই আহ্নিক গতি সম্পর্কে, তাহলেই জানতে পারবো দিন-রাত হওয়ার মূল কারণ।

আমরা সবাই জানি, পৃথিবী গতিশীল। পৃথিবী তার নিজ অক্ষে একবার পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করতে সময় নেয় ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড বা ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ একদিন। পৃথিবীর এই আবর্তন গতিকে আহ্নিক গতি (Diurnal Motion) বলে।

পৃথিবীর আহ্নিক গতি একেক জায়গায় একেক রকম। পৃথিবী নামক আমাদের এই গ্রহটি পুরোপুরি গোল না হওয়ায় এর পৃষ্ঠ সর্বত্র সমান নয়। তাই সে কারণে পৃথিবীপৃষ্ঠের সকল স্থানের আবর্তন বেগও সমান নয়। দিন-রাত্রি সংঘটিত হওয়া পৃথিবীর আহ্নিক গতির একটি ফল। 

অন্যদিকে, পৃথিবীর নিজস্ব কোনও আলো নেই। সূর্যের আলোতেই পৃথিবী আলোকিত হয়। আবর্তন গতির জন্য পৃথিবীর যেদিক সূর্যের সামনে আসে সেদিক সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়। তখন ওই আলোকিত স্থানসমূহে দিন থাকে। 

আর আলোকিত স্থানের উল্টো দিকে অর্থাৎ পৃথিবীর যে দিকটা সূর্যের বিপরীত দিকে থাকে, সে দিকটা অন্ধকার থাকে। সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছে না। এসব অন্ধকার স্থানে তখন রাত্রি থাকে। পৃথিবীর পর্যায়ক্রমিক আবর্তনের ফলে আলোকিত দিকটা অন্ধকারে ও অন্ধকারের দিকটা সূর্যের দিকে চলে আসে। এর ফলে দিন-রাত্রি পাল্টে যায়।

অন্ধকার স্থানগুলো আলোকিত হওয়ার ফলে এসব স্থানে দিন হয় এবং আলোকিত স্থান অন্ধকার হয়ে যায় বলে ওইসব স্থানে রাত হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে দিনরাত্রি সংঘটিত হচ্ছে পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলেই।

আহ্নিক গতি না থাকলে পৃথিবীর একদিক চিরকাল অন্ধকারে থাকতো ও অপরদিক আলোকিত হয়ে থাকতো। কেননা, সূর্য চিরকাল এক জায়গাতেই অবস্থান করে ঘুরতে থাকে। 

রাতে কেন ঘুম হয়- 
পর্যায়ক্রমে দিনরাত্রি সংঘটিত হওয়ার ফলে আমরা দিনের বেলায় কাজ করি, আর রাতে বিশ্রাম নেই অর্থাৎ ঘুমাই। নিশাচর প্রাণী ছাড়া প্রায় সব প্রাণীই এ রুটিন মেনে চলে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার ৮০ শতাংশ ঘুম আমরা রাতেই কেন ঘুমাই? ভেবে দেখেছেন কখনও? 

আসলে, রাতে ঘুমানোর সঙ্গে আমাদের দৈহিক তিনটি প্রক্রিয়া জড়িত। প্রথমত, বায়োলজিক্যাল ক্লক। আমাদের দেহঘড়ি ২৪-২৫ ঘণ্টার একটি রুটিন মেনে চলে। এই সময়টা আলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটাই আমাদের সংকেত দেয় রাত, দিন, অন্ধকার ও আলো সম্পর্কে। দেহঘড়ি অনুযায়ী আমাদের মস্তিষ্ক ঘুম আর জেগে ওঠার সময় নির্ধারণ করে নেয়।

দ্বিতীয় প্রক্রিয়া হয় চোখের মাধ্যমে। আমাদের চোখ দিন রাতের তফাত টের পায় ও পরিবেশ রপ্ত করে নেয়।  

এবার আসা যাক আসল কথায়। মানুষের ঘুম ও জেগে ওঠার ব্যাপারটা মূলত নিয়ন্ত্রণ করে মেলাটোনিন নামের একটি হরমোন। যার নিঃসরণ আলোর উপস্থিতিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। আলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে সূর্য। এ আলোয় মেলাটোনিন সঠিকভাবে নিঃসৃত হতে পারে না। ফলে আলোর তীব্রতা যখন থাকে না বা আলোর অনুপস্থিতিতে এ হরমোন পর্যাপ্ত পরিমাণে নিঃস‍ৃত হতে পারে। এতে ওই সময় আমাদের বডি রিল্যাক্স মোডে অবস্থান করে এবং ঘুম পায়। 

অনেকেই বলতে পারেন, দিনেও তো অনেকে খুব ঘুমায়। সেটা কী করে? বিজ্ঞান বলছে, দেহঘড়ির সময় সংকেত চাইলে বদলে নেয়া যায়। যদিও এটি সময় সাপেক্ষ। সহজে বলতে গেলে, একটু খেয়াল করলে দেখবেন, যেসব ঘরে সূর্যের আলো পৌঁছে না সেখানে বাতি নেভানো অবস্থায় পুরোপুরি অন্ধকার অনুভূত হয়। তখন চোখ ও হরমোন তাদের কাজ শুরু করে দেয়। 

সুতরাং রাত বা আলোহীন পরিবেশেই আমাদের ঘুম হয়। তবে, একই বয়সের লোকের মধ্যেও ঘুমের তারতম্য হয়। বেশিরভাগ মানুষের সাত বা আট ঘন্টা ঘুম হয়। অন্যদিকে অল্পসংখ্যক মানুষের শুধুমাত্র তিন ঘন্টা ঘুমই যথেষ্ট। 

চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, নিয়মিত সাত-আট ঘন্টার বেশি রাতে ঘুমানো ভালো নয়। ঘুমের মধ্যে অল্প যে সময় আমরা জেগে থাকি, সেই সময়টাকে অনেকটা দীর্ঘ মনে হয়। কাজেই আমাদের মনে হয় যে আমাদের যথেষ্ট ঘুম হয় নি।

আর ঘুম না হলে দুশ্চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। এক-আধ রাত না ঘুমালে পরদিন ক্লান্ত লাগবে। কিন্তু এতে আপনার শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হবে না। কিন্তু বেশ কয়েক রাত ঘুম না হলে, আপনি দেখবেন-

  • সবসময় ক্লান্ত লাগছে,
  • দিনের বেলা চোখ ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে,
  • মনঃসংযোগ করতে অসুবিধা হচ্ছে,
  • সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হচ্ছে,
  • মন খারাপ লাগছে

গাড়ী চালালে বা মেশিন চালালে এতে অসুবিধা হতে পারে। প্রতি বছর বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটে মানুষ গাড়ী চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়ার ফলে। অন্যদিকে, ঘুমের অভাবের দরুন আমাদের ব্লাড প্রেসার বাড়া, ওজন বাড়া এবং ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ঘুমের ধর্মীয় বিধান
রসুল (সা.) এশার নামাজের পর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতেন এবং রাতের শেষভাগে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা)-বলেন, 'রসুল (সা.) এশার নামাজের পর ঘুমাতে পছন্দ করতেন। তিনি এশার পর কথা বলা পছন্দ করতেন না।' 

কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের লোকেরা গভীর রাত পর্যন্ত টিভি দেখে ঘুমাতে যায়। তাদের অনেকেই সূর্য ওঠার আগে ফজরের নামাজই পড়তে পারে না। এশার নামাজ জামাতে পড়ার পর ফজরের নামাজও জামাতে পড়া হলে সারা রাতই নামাজে কেটেছে ধরে নেয়া হয়। 

এদিকে রসুল (সা.) সূর্য ওঠার পর ঘুমানোকে রিজিকের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করতেন। দিন কাজের জন্য আর রাত বিশ্রাম বা আরামের জন্য। রাত নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য। সময় থাকা সাপেক্ষে দিনের বেলায় দুপুরের আহারের পর একটু বিশ্রাম (কায়লুলাহ) করে নেয়া যায়। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এর ফলে রাতের বেলায় আল্লাহর ইবাদতে যে কষ্ট হয় তা লাঘব হয়। এর জন্য গভীর ঘুমের প্রয়োজন হয় না। শুধু বিছানায় শুয়ে একটু বিশ্রাম নিলেই চলে। 

সাহাবি সাহল ইবন সা'দ (রা) বলেন, 'আমরা কায়লুলাহ করতাম আর জুমার নামাজের পর আহার করতাম।' 

আসলে যারা রাতে ঘুমায় না তারা অজ্ঞ ছাড়া কিছুই নয়। রসুল (সা.) ঘুমাতে যাওয়ার আগে দোয়া করতেন, 'হে আল্লাহ! আমাকে তোমার শাস্তি হতে রক্ষা কর। যেদিন তুমি তোমার বান্দাদের একসাথ করবে বা তোমার বান্দাদের জীবিত করে উঠাবে।' 

অন্যদিকে, রসুল (সা.) সব সময় ডান পাশ হয়ে ডান হাতের তালুর ওপর মুখমণ্ডলের অংশ বিশেষ (গাল) রেখে কিবলামুখী হয়ে শয়ন করতেন। এর কারণ অজানা নয়। বুকের বাম পাশে হৃৎপিণ্ডের অবস্থান। চিকিৎসকরা সব সময় হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ প্রয়োগে নিষেধ করেছেন। সুতরাং কেউ বাম পাশ হয়ে শয়ন করলে স্বাভাবিকভাবেই তার হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ পড়বে। 

রসুল (সা.) ঘুমানোর আগে এক খণ্ড বস্ত্র দিয়ে তিনবার তার বিছানা পরিষ্কার করে নিতেন যাতে কোনও বিষাক্ত পোকামাকড় তাকে কামড়ানোর সুযোগ না পায়। 

আজ আমাদের ভাবতে অবাক লাগে, সেই ১৪০০ বছর আগে যখন আধুনিক কোনও চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না, তখনকার সময়ে উম্মি (প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন) নবী (সা.) আমাদের ঘুমানোর আদর্শ পদ্ধতি বাতলে গেছেন। তাঁর উপদেশ ছিল প্রজ্ঞাময় ও রহমতস্বরূপ। তাই আসুন, আমরা ইসলামী বিধানের আলোকে ঘুমানোর অভ্যাস করি, আদর্শ জীবন গড়ি।

এনএস/