ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

সৌদি আরবে রহস্যময় সভ্যতার সন্ধান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:১৮ এএম, ৪ অক্টোবর ২০১৯ শুক্রবার

সৌদি আরবের আল উলার শিলাকীর্ণ মরুভূমির কুচকুচে কালো আকাশের জন্য পরিচিত। কারণ এখানে স্টারগেজার বা তারা দেখতে আসা মানুষেরা কোনও ধরণের আলোক দূষণ ছাড়াই মহাজাগতিক বস্তু পর্যবেক্ষণ করতে পারে। কিন্তু এগুলো ছাড়াও ধীরে ধীরে এই এলাকাটি প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।

বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া একটি সভ্যতার বাস ছিল এই অঞ্চলে যা পরিচিত ছিল নবতায়িয়ান সভ্যতা নামে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০ বর্ষ থেকে শুরু করে পরবর্তী ২০০ বছর টিকেছিল এই সভ্যতা।

নবতায়িয়ান সংস্কৃতি নামে পরিচিত সেই সভ্যতার অত্যন্ত জটিল ও উন্নত কিছু পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ সেই সময়ে সাক্ষ্য দিলেও এখনও অনেকগুলো সাইট অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। তাই প্রথমবারের মতো গভীর প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ শুরু করেছে এক দল গবেষক। উদ্দেশ্য একসময় সেই অঞ্চলে বসবাসকারী ওই রহস্যময় সভ্যতার বিষয়ে আলোকপাত করা।

নবতায়িয়ান শাসকরা তাদের সাম্রাজ্য শাসন করতেন মনোমুগ্ধকর শহর পেত্রা থেকে যা জর্ডানে অবস্থিত। আল উলা’য় তারা তাদের দ্বিতীয় রাজধানী হেগ্রা (আধুনিক নাম মাদা ইন সালেহ) স্থাপন করেছিল।

বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ওই এলাকায় একটি বিস্তীর্ণ ভূমি যা প্রায় বেলজিয়ামের সমান, সেখানে বিশদভাবে জরিপ চালানোর পরিকল্পনা করছেন।

সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ৩ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় দুই বছরব্যাপী একটি জরিপ প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ৬০ জন বিশেষজ্ঞের একটি আন্তর্জাতিক দল কাজ শুরু করেছে।

এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো এত বড় এলাকায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রক্রিয়াগতভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সৌদির প্রত্নত্ত্বাতিকদের নেতৃত্বে মাদা’ইন সালেহ-এর আশেপাশে এবং উল্লেখযোগ্য নবতায়িয়ান সাইটগুলোতে খনন কাজ চালানো হয়েছে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রিয়াদের বাদশাহ সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আবদুলরাহমান আলসুহাইবানি।

তিনি বলেন, আমি পূর্বের দেদানাইত এবং লিহিয়ানাইত সভ্যতার উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এখন আল উলা’র প্রকল্পে রয়্যাল কমিশন সংশ্লিষ্ট থাকায়, প্রাথমিক সমাজ ব্যবস্থা কিভাবে বিকশিত হয়েছিল তা আরও গভীরভাবে বোঝার বড় ধরণের সুযোগ তৈরি হবে।

রয়্যাল কমিশন জড়িত থাকার মানে হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিকদের সহায়তায় সর্বশেষ এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

যেখানে গুগল আর্থ এবং অভিজ্ঞ চোখ মিলে এমনিতেই বলে দিতে পারে যে কোনটি প্রাকৃতিক আর কোনটি মানব তৈরি, সেখানে বিশেষায়িত ক্যামেরা সম্বলিত হালকা বিমান ওই এলাকার সবচেয়ে বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম। যার আওতায় রয়েছে আল উলা ওয়াদি এবং এর আশেপাশের উপত্যকা। এর মাধ্যমে এখনও পর্যন্ত অজানা প্রত্নতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য তুলে আনা সম্ভব।

আল উলার রয়্যাল কমিশনের জরিপ বিষয়ক দলের প্রধান এবং মার্কিন প্রত্নতাত্ত্বিক রেবেকা ফুটি বলেন, আগের প্রকল্পগুলোতে মূলত খনন কাজের উপর জোর দেয়া হয়েছে। কারণ এ ধরণের সুশৃঙ্খল জরিপ পরিচালনার জন্য অনেক সময় এবং অর্থের দরকার যা কেবল এখন আছে।

তিনি বিশ্বাস করেন, সৌদি আরবের এই উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত দেশটিকে প্রাচীন ইতিহাসের মানচিত্রে জায়গা করে দেবে।

তিনি বলেন, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দ সম্পর্কে বিস্তারিত অনেক তথ্য জানা গেছে এবং আমরা সবাই প্রাচীন মিশর এবং মেসোপটেমিয়া সম্পর্কে জানি। এখন পর্যন্ত প্রাচীন সময়ের আরব উপত্যকা সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে তেমন কিছুই জানা যায়নি। আমাদের পাওয়া তথ্য প্রাচীন ইতিহাস বুঝতে কিভাবে সহায়তা করবে সে সম্পর্কেও এখনও আমরা কিছু জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে যে, প্রাথমিক যুগ সম্পর্কে বৈশ্বিক মত পাল্টে দিতে পারে এটি।

জর্ডানে অবস্থিত প্রাচীন শহর পেত্রায় বহু বছর ধরে কাজ করছেন ফুটি। এই শহরটিতেই নবতায়িয়ান সভ্যতার সবচেয়ে আলোচিত স্মৃতিস্তম্ভগুলো রয়েছে। তিনি বলেন, আকাশ পথে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো হবে মূল চাবিকাঠি যার সাহায্যে ওই সভ্যতার সমাধিস্তম্ভের স্থাপত্য, দাঁড়িয়ে থাকা পাথর এবং আরও অন্যান্য অপ্রচলিত সাইট নিয়ে অনুসন্ধান চালানো সহজ হবে। আর তা না হলে বছরের পর বছর কেটে যাবে এগুলো খুঁজে বের করতে হলে।

‘এখন প্রযুক্তি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য এবং বিস্তারিত ধারণা দেবে,’ তিনি বলেন। ‘এর আগে এত বড় ধরণের কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।’

এর আগে ফরাসিদের নেতৃত্বে একদল খননকারী একটি ধূপ বাণিজ্যের নেটওয়ার্ককে ধরে ফেলে যারা আরবের পশ্চিমাঞ্চলের সক্রিয় ছিল এবং আল উলা হয়ে যাতায়াত ছিল তাদের। রেবেকা ফুটি এই তথ্যের উপর ভর করে আরও এগিয়ে যেতে চান এবং তিনি বুঝতে চান যে, ওই এলাকার উন্নয়নে পানি কিভাবে প্রভাব ফেলেছিল সে সম্পর্কে আরও জানতে চান তিনি।

তিনি মন্তব্য করেন, আমরা ধারণা করতে পারি যে তাদের একটি সফল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ছিল, কিন্তু তখন কি ধূপের উপর কোন ধরণের কর ছিল? তারা কিভাবে পানির চাহিদা পূরণ করত?

হাইড্রোলজি বা পানি সম্বন্ধীয় গবেষণা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। আর এতে করে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে, বিমান নিয়ে কাজ করা প্রত্নতত্ত্ববিদ দলটিকে ধন্যবাদ, তাদের সাহায্য ছাড়া নির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে জানা যেত না।

দুই কিংবা তিন হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ে, অক্সফোর্ডের প্রত্নতত্ত্বের জেমি কুয়ারটারমাইনের নেতৃত্বে থাকা জরিপ দলটি এরইমধ্যে প্রত্যাশিত সাড়ে এগারো হাজার সাইটের মধ্যে অর্ধেকেরই অবস্থান খুঁজে পেয়েছে। প্রতিরোধমূলক জরিপ নামে পরিচিত এই জরিপের মানে হচ্ছে, এসব প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায় ভবিষ্যতে কোন ধরণের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ পরিচালনা করা হবে না।

‘আমরা অন্য দেশের ভুল দেখে শিক্ষালাভ করেছি এবং আমরা যে কোনও ধরণের ক্ষতি রুখতে বেশ সময় নিয়ে কাজ করছি,’ তিনি বলেন। ‘সাধারণ মানুষের কাছে উন্মুক্ত হলেও, যা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে, তা আসলে সবার জন্য ছেড়ে দেয়া হবে না।’

এই জরিপ অন্য বিশেষজ্ঞদের যেমন পাথর শিল্প সম্পর্কিত প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারবে।

‘এমনকি ৫ বছর আগেও জিপিএস ব্যবস্থা এতোটা নির্ভুল ছিল না,’ জেমি কুয়ারটারমাইনি বর্ণনা করেন। ‘আজ আমরা ফটোগ্রাফির বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করছি যেমন ড্রোন, হালকা বিমানে সংযুক্ত ক্যামেরা এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিমান অরফো-ফটোগ্রাফি।’

প্রতি দুই থেকে তিন সেকেন্ডে নতুন একটি করে ছবি দেয়ার মাধ্যমে, হাজার হাজার ছবি বিশ্লেষণ করে সত্যিকার দূরত্ব পরিমাপ করা যায়। বিশেষায়িত সফটওয়্যার এসব কিছুকে একটি উচ্চ রেজ্যুলিউশন সম্পন্ন এবং বিস্তারিত বর্ণনা সম্বলিত একটি ভূমিরূপ পাওয়া যাবে।

ক্যামেরাগুলো ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঠিক করা হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত একটি সমাধিক্ষেত্র, ব্রোঞ্জ যুগের সমাধিক্ষেত্রের ভূমিরূপ এবং সমাধির গঠন। এছাড়াও, একই অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরা সম্বলিত ড্রোনও রাখা হয়েছে।

‘এটি আমাদেরকে শুধু অনুভূমিক চিত্রই তুলে ধরে না বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে উল্লম্ব চিত্রও চোখে পড়ে,’ তিনি বলেন।

‘আমাদেরকে আগেই সতর্ক করা হয়েছে যে কিছু কিছু জায়গায় পাথরে শিল্পকর্ম মিলতে পারে।’

জরিপের সর্বশেষ ধাপে, বিশেষায়িত দলের সদস্যদের পাঠানো হবে, যেমন পাথরে শিল্পকর্মের বিশেষজ্ঞ মারিয়া গুয়াগনিন, যিনি খালি পায়েই মাঠে ঘুরে বেড়ান। আরবের উত্তরাঞ্চলে ৫ বছর কাটানোর পর, মারিয়া শেষ পর্যন্ত অভিভূত হয়েছে এটা দেখে যে, সব যুগের তথ্য সম্বলিত বিশালাকার তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়েছে।

‘প্রথমবারের মতো, প্রত্নতত্ত্বের সব দিক খতিয়ে দেখার সুযোগ পাচ্ছি আমরা,’ তিনি নির্দিষ্ট করে বলেন।

‘প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও অনেকটা খননকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক এবং মহাসাগরীয় স্থানগুলোর অবস্থানের উপর নির্ভরশীল।’

‘ধারণা করা হয় যে, আরবিয় উপত্যকা থেকে অনেক এরইমধ্যে অনেক প্রজাতি বিলোপ হয়েছে, কিন্তু সেগুলো শিলা চিত্রের প্যানেলে এখনও টিকে আছে।’

আল উলাতে পূর্বে অঘোষিত স্তন্যপায়ী প্রজাতির উপস্থিতি তাদের অবস্থান, বাসস্থান এবং খাদ্যাভ্যাস যা সেই সময়ে প্রাগৈতিহাসিক প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলোতে রয়েছে সে সম্পর্কিত নতুন তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে।

এছাড়া কোন সময়ে কোন পশু ছিল সেটি সনাক্ত করতেও এসব চিত্রের সহায়তা নেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ঘোড়া কিংবা উট খ্রিস্টপূর্ব ১২ অব্দের আগে থেকে ছিল।

গৃহপালিত পশু, ভেড়া এবং ছাগল আরবিয় উপত্যকায় আনা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৬৮শ বা ৬২শ এর মাঝামাঝি অব্দে। এগুলো ভূ-মধ্যসাগরের পূর্বাংশে গৃহপালিত করে সৌদি আরবে আনা হয়। বিভিন্ন শিলা চিত্র থেকে এই সময় গুলো জানা যায়, কারণ ওই সময়ের আগে ওই এলাকায় গৃহপালিত কোন পশু ছিল না বলে অনুমান করা হয়।

আল উলা আন্তর্জাতিক দলের সংগ্রহ করা এসব তথ্যে উল্লেখিত স্থানগুলো পেত্রার বিভিন্ন অংশ বলে ধারণা করা হচ্ছে এছাড়া পেত্রা এবং মাদা’ইন সালেহর মধ্যকার রাস্তাও আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে।

আবদুলরাহমান আলসুহাইবানি কয়েক বছর ধরে দেদান এলাকায় খনন চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি হচ্ছে এমন একটি সাইট যেখানে নবতায়িয়ানদের আগেরও সভ্যতার তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি বলেন যে, এমনটাও হতে পারে যে, এসব বিষয়ে জানতে কয়েক প্রজন্ম দরকার হতে পারে। ‘বিশ্বের দরবারে এই কাজগুলোকে যা অনেক বেশি মূল্যবান করে তুলেছে তা হল, মাদা’ইন সালেহ এবং পেত্রাই নয় বরং এর আগের সভ্যতা যা আমাদের কাছে অজানা তারও ইঙ্গিত রয়েছে।’

আবদুলরাহমানের একটি দায়িত্ব হচ্ছে, বাদশাহ সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়া যারা আল উলায় একটি আউটপোস্টে কাজ করছে।

‘তারা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপক একটি জরিপের অংশ হিসেবে শিখছে এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত খনন সম্পর্কে জানছে,’ তিনি বলেন। ‘আজকের শিক্ষার্থীরাই হয়ত এমন আবিষ্কার করবে যা আমরা ভাবতে পর্যন্ত পারি না।’

সূত্র: বিবিসি