ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভিসি-প্রক্টরদের কারণেই জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি(ভিডিও)

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৭:৪০ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০১৯ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৮:০২ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০১৯ বৃহস্পতিবার

আমাদের সমাজে কারও বাড়িতে যখন কোনও সমস্যা দেখা দেয়, তখন সেই সমস্যার সমাধানে বাড়ির প্রধান ব্যক্তি, হয় বাবা না হয় মা, সবার আগে তৎপর হন। তেমনিভাবে এতদিন জেনে এসেছি যে, শিক্ষক হলেন পিতার সমান। যিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামক পরিবারের যে কোনও সমস্যায় দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। অথচ বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় জানা এই কথাটিই কেন যেন অজানা ঠেকছে।

অভিভাবকরা স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে পড়াশুনার জন্য পাঠানোর আগেই ভরসা করেন প্রতিষ্ঠান প্রধানের ওপর। তিনি হতে পারেন প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ অথবা উপাচার্য। তাদের ওপর ভরসা করেই তো তারা ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান। কিন্তু বর্তমানে তাদের কারও কারও ভূমিকা এতটাই রহস্যজনক হয়ে উঠেছে যে, সম্মানিত শিক্ষকদের প্রতি ছাত্র-ছাত্রী এমনকি অভিভাবকদেরও আস্থা কমে যাচ্ছে।

সম্প্রতি বুয়েটের নিরীহ মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শুধু দেশে নয়, বিভিন্ন দেশেও ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৌশল শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে পড়াশুনা-গবেষণা নিয়েই ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যস্ত থাকার কথা। সেখানেই কিনা ঘটে গেল ইতিহাসের নির্দয় ও নিষ্ঠুরতম একটি হত্যাকাণ্ড। আবরার নামে একজন নিরীহ মেধাবী ছাত্রকে একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। এহেন ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্যেরই তো সর্বাগ্রে এগিয়ে আসার কথা। 

অথচ অবাক করা বিষয় হলো- আবরার হত্যাকাণ্ডের দিন বুয়েটের গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শান্ত করা তো দূরের কথা, আবরারের লাশটি পর্যন্ত দেখতেও আসেননি বুয়েটের ভিসি ড. সাইফুল ইসলাম। এমনকি আবরারের জানাজাতেও উপস্থিত হননি তিনি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার বিকাল ৫টার মধ্যে তাকে সশরীরে হাজির হয়ে জবাবদিহি করতে আলটিমেটাম দেয়।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বেঁধে দেয়া সময় শেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির হন বুয়েট ভিসি। ছাত্রছাত্রীদের মূল অভিভাবক হিসেবে বুয়েট উপাচার্যের ভূমিকা ও আচরণ অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। 

ভিসির এমন ভূমিকা নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক থেকে শুরু করে সারা দেশবাসীর ন্যায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘উনি কেমন ভিসি? একটা ছাত্র মারা গেল আর এতটা সময় তিনি ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলেন?’

এ বিষয়ে বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র বিশিষ্ট অভিনেতা আবুল হায়াত শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘একটা সময় আমরাও বুয়েটের ছাত্র ছিলাম। আমাদের সঙ্গে তখনকার ভিসির ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। আমাদের যে কোন সমস্যায় সদা তৎপর থাকতেন তিনি। কোন দাবিতে আন্দোলন করলেও তিনি আমাদের সামনে বসে হাসতেন, কথা বলতেন, দাবি মেনে নিতেন।’

এসময় ভিসির ভূমিকায় প্রশ্ন তুলে আবুল হায়াত আরও বলেন, ‘কিন্তু আপনি কেমন ভিসি? আপনার ছাত্র, আপনার সন্তান ক্যাম্পাসে মারা গেল, তাকে হত্যা করা হলো, আর আপনি ঘরে বসে থাকলেন? কেমন ভিসি আপনি?’

এদিকে এ ঘটনায় একজন সম্মানিত উপাচার্যের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পরায়ণতা নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে ব্যাপক প্রশ্ন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুয়েট ভিসি ড. সাইফুল ইসলামের ব্যাপারে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেকেই। 

বিশিষ্ট নাট্যকার মাসুম রেজা তার ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, “বুয়েটের ভিসির বুয়েটে থাকার কোনও অধিকার নাই। তার এক সন্তান মারা গেছে, সন্তানের জানাজাতেও তিনি আসেননি। ভীরু, কাপুরুষ, দলবাজ একজন শিক্ষক সকলের অভিভাবক হতে পারেন না। তীব্র ঘৃণা তার প্রতি।”

জনসংযোগ ব্যক্তিত্ব মির্জা তারেকুল কাদের তার ফেসবুকে লিখেছেন, “বুয়েটের ভিসি ড. সাইফুল ইসলাম, আপনি কেমন ভিসি? আপনি বুয়েটের অভিভাবক, ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক। ওরা আপনার সন্তানতূল্য। আপনার ছাত্র আবরারকে নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলল আপনার ভার্সিটির ছাত্রলীগের কিছু পাষন্ড। আর আপনি বসে আছেন বাসায়? আপনি দেখি দায়িত্ব জ্ঞানহীন-দয়ামায়াহীন আরেক পাষন্ড। ভিসি পদে থাকার যোগ্যতা আপনার আছে কী?”

বুয়েট ভিসি ড. সাইফুল ইসলামকে ঘিরে এ ধরনের অভিযোগের ভিত্তি আছে বলেই মনে করি। তারই প্রতিষ্ঠানে একজন নিরীহ ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। অথচ তিনি হতভাগ্য ছাত্রের লাশটিও একবার দেখতে আসেননি। কিন্তু কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যের কাছ থেকে এটা কি আশা করা যায়?

শুধু ভিসিই নন, এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন প্রক্টর, শেরে বাংলা হলের প্রভোস্ট, ছাত্রকল্যাণ পরিচালকসহ আরও অনেকেই। এদের প্রত্যেকেরই বিস্ময়কর ভূমিকায় দেশ, দেশের মানুষ সবাই হতবাক। যদিও এমন প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা পালনের অভিযোগ স্বীকার করে এর নেপথ্য কাহিনীও ইতোমধ্যে ফাঁস করে দিয়েছেন তারা। যা এখন সবার কাছেই পরিষ্কার। চাপে পড়েই নাকি এমনটা করেছেন তারা।

এইতো কিছুদিন আগে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগের দাবিতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা ক্যাম্পাসে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ভিসির পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীরা ঝাড়ু মিছিল পর্যন্ত বের করে। গোটা ক্যাম্পাস কার্যত অচল হয়ে পড়লেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের দাবির প্রতি মোটেও কর্ণপাত করেননি। 

বরং উল্টো তিনি ক্যাম্পাসে তার বাসভবনে বসে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে মেতেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরী কমিশনের একটি প্রতিনিধি দল ক্যাম্পাসে গিয়ে সরেজমিনে ঘটনার তদন্ত শেষে ভিসির অপসারণের ব্যাপারে প্রস্তাব তুললে ভিসি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ততদিনে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকান্ড সহ শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। 

প্রশ্ন উঠেছে, একজন ভিসিকে ঘিরে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের এত মারমুখি আন্দোলন হবেই বা কেন? তার অর্থ তিনি নিশ্চয়ই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবনের ব্যাপারে সঠিক দায়িত্ব পালন করছিলেন না। চূড়ান্ত বিক্ষোভের মুখেও তিনি তার পদ আঁকড়ে পড়ে থাকাকেই পছন্দনীয় মনে করেছিলেন।
 
আরও প্রশ্ন উঠেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও। ক্যাম্পাসে ভবন নির্মাণ বাবদ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করায় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদককে তার পদ হারাতে হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ভিসির বাসভবনেই নাকি চাঁদার টাকা ভাগাভাগি হয়েছে। যদি সেটাই সত্যি হয়, তাহলে এই ভিসিরও তো পদত্যাগ করা উচিত।

আগেই বলেছি, একটি পরিবারের ভাবমূতি নির্ভর করে পরিবার প্রধানের ওপর। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ও এক-একটি পরিবার। ভিসি বা উপাচার্য হলেন এই পরিবারেরই প্রধান। কাজেই পরিবারের প্রধান হিসেবে তার উচিৎ দল মত নির্বিশেষে প্রতিটি ছাত্র ছাত্রীর প্রতি সমান দৃষ্টি দেওয়া। যারা এই কাজটি করছেন না তারা অবশ্যই ভুল করছেন। 

কথায় আছে, একটা মিথ্যাকে ঢাকতে হলে অসংখ্য মিথ্যা বলতে হয়। তেমনি একটি ভুল সংশোধনের জন্য আরও অনেক ভুল করার প্রয়োজন পড়ে। আমরা কি এ ধরনের ভুলের মধ্যেই থাকবো, ভুল করতেই থাকব?

ছাত্রছাত্রীদের মূল অভিভাবক হিসেবে বুয়েট উপাচার্যের ভূমিকা ও আচরণকে যদি তেমনই ভুল ভাবা হয়, তা হবে নিতান্তই অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। তিনি কি ভেবেছিলেন, ছাত্রহত্যার ঘটনায় সহানুভূতি ও ‘যথাযথ’ দায়িত্ব পালনের অপরাধে সরকার তাকে পদচ্যুত করতে পারে? আর এজন্যই তিনি অন্তরাল বেছে নিয়েছিলেন! পদ-পদবির লোভে কিংবা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, সন্তানতুল্য একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু সংবাদ শোনার পরও যে নির্লিপ্ততা তিনি দেখিয়েছেন তা ন্যক্কারজনক। আমরা তার এ ধরনের আচরণ ও মানসিকতাকে ধিক্কার জানাই।

একটা সময় দেশের প্রাচীনতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশেষ সুনাম ও মর্যাদা ছিল, যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। দুঃখজনক হল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অতীত গৌরব ও ঐতিহ্যের কোনওকিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। 

এর কারণ সম্ভবত, ছাত্র রাজনীতির দৌরাত্ম্য ও ঢালাওভাবে সবকিছুতেই দলীয়করণ। বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থেকে শুরু করে শিক্ষকসহ অন্যান্য নিয়োগ প্রক্রিয়ার অধিকাংশই সম্পন্ন হয় দলীয় বিবেচনায়। দলের প্রয়োজনে নিয়োগপ্রাপ্তরা লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াসহ অন্যান্য অনৈতিক কাজকর্মে জড়াতেও দ্বিধা করেন না।

অন্যদিকে অলাভজনক ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম পরিচালনার কথা থাকলেও অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অবাধ দুর্নীতি, অনিয়ম, ভর্তি ও সনদবাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। 

দেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এরকম নৈরাজ্য চলার সংবাদে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে অরাজকতার অবসান ঘটবে বলে আমরা মনে করি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরসহ দেশের উচ্চশিক্ষার স্তরটিতেও বিরাজ করছে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থা-অসঙ্গতি। দুঃখজনক হল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধু ভিসিই নন; বর্তমানে প্রোভিসি, ডিন, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর-রেক্টর বলতে গেলে প্রায় সবারই নীতি-নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। 

এ নিয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মাঝে বিরাজ করছে চরম অসন্তোষ-ক্ষোভ-হতাশা। পরিস্থিতি হয়ে যাচ্ছে আরও জটিলের দিকে। যার অবসান হওয়া অতীব জরুরী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলনিরপেক্ষ, শিক্ষানুরাগী, প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, উন্নত রুচি ও মনমানসিকতার অধিকারী সুপণ্ডিত এবং শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক-উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারে সরকার মনোযোগী হবে, এটাই প্রত্যাশা।

এনএস/