ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

ওমর ফারুককে চাচ্ছেন না কেউ!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:৩০ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ০৪:০৪ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০১৯ শনিবার

বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। দেশের প্রথম যুব সংগঠন। বহুল প্রচলিত সংক্ষিপ্ত নাম ‘যুবলীগ’। নামেই বোঝা যায় যুবকদের শক্তিশালি হাতে নিয়ন্ত্রিত একটি সংগঠন এটি। তরুণ, টকবগে যুবকরাই পারে দেশেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আর সে জন্যই এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অন্যতম শক্তি এই ‘যুবলীগ’। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। বঙ্গবন্ধু পুত্র যে স্বপ্ন নিয়ে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা লক্ষ্যচ্যুত হচ্ছে কিছু অসৎ নেতাদের কারণে। বিতর্ক দেখা দিয়েছে সংগঠনটির নেতৃত্ব নিয়ে। যে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না সংগঠনের বর্তমান চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকেও।

যুবলীগের এ চেয়ারম্যানের বয়স এখন ৭১ বছর। এমনই ভাগ্য ওমর ফারুকের যে, ৬৪ বছর বয়সে হয়েছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান। অথচ যুবলীগের ইতিহাসে এর আগে ৫০ বছরের বেশি বয়সী কেউ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হননি। ১৯৭২ সালের ​নভেম্বরে শেখ ফজুলল হক মণি যখন যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তার বয়স ছিল ৩২ বছর।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর কমিটি করার কথা। অথচ ওমর ফারুক সাত বছর ধরে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। যদিও শুধু তিনি নন, যুবলীগের নেতাদের আরও অনেকের বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত নূর হোসেনরা যেখানে যুবলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সেখানে সম্রাট, আনিসুররা অর্থের পাহাড় গড়তে এ সংগঠনটিকে ব্যবহার করছে। আর এজন্যই দলীয় প্রধান শুদ্ধি অভিযানে নেমেছেন। যে অভিযানে আটকে গেছেন অনেক নেতা। এবার সেই হট তালিকায় উঠে এসেছে ওমর ফারুক চৌধুরীর নাম।

বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের অধিকারি এই নেতাকে কেন্দ্রীয় যুবলীগের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানিয়েছেন শীর্ষ নেতারা।

ইতিমধ্যে ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলব ও অনুমতি ছাড়া বিদেশে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে তিনি প্রকাশ্যে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রমেও যোগ দিচ্ছেন ওমর ফারুক।

দীর্ঘদিন রাজনীতিতে হতাশ জীবন কাটানো এই নেতা এক সময় বিড়ি শ্রমিক লীগ, জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন, আওয়ামী লীগ করেও পেছনের কাতারে অবস্থান করছিলেন। তবে যুবলীগ তাকে নিয়ে গেছে শীর্ষ স্থানে। যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার পর একে একে সব চিত্র পাল্টে গেছে। সফল করেছেন পুরোনো সব ব্যর্থতাকে।

২০০৩ সালে যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন ওমর ফারুক। এর আগের কমিটিতে কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আর ২০১২ সালে হন চেয়ারম্যান। এরপর থেকে যুবলীগে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। এক সময়ে নিজের সম্পদ নিলামে ওঠার পরিস্থিতিও সামলে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের শীর্ষ পদ পাওয়ার পর। ধনাঢ্য জীবন যাপন করা এ নেতার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই।

সবকিছু মিলিয়ে তাকে নিয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একপ্রকার ক্ষোভ দেখা গেছে। যুবলীগের একাধিক নেতা জানান, চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাদের সরাসরি আলাপ করার সুযোগ কম। যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। পিয়ন থেকে যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক হওয়া এই আনিসুর চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের সহায়তায় বিত্তবৈভব গড়ে তোলেন। ইতিমধ্যে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া এ নেতা সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম জেলা বিড়ি শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন আওয়ামী লীগের প্রয়াত কেন্দ্রীয় নেতা এস এম ইউসুফ ছিলেন তার রাজনৈতিক গুরু। বিড়ি শ্রমিক লীগের নেতা হয়ে মিয়ানমার থেকে টেন্ডু পাতা আমদানি শুরু করেন ওমর ফারুক। তামাকের বিকল্প এ টেন্ডু পাতা বিড়ির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় আসার সময় ওমর ফারুক শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জাতীয় পার্টির প্রয়াত নেতা নাজিউর রহমান (মঞ্জু) এরশাদের মন্ত্রিসভার সদস্য হলে ওমর ফারুক দল বদল করেন। জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন যুব সংহতির চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ওমর ফারুক চৌধুরী নাজিউর রহমানের ভায়রা ভাই এবং শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভগ্নিপতি।

তৎকালীন মন্ত্রী নাজিউর রহমানের উৎসাহে ওমর ফারুক জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন যুব সংহতির চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এরশাদ সরকারের পতনের পর কিছুদিন নীরব ছিলেন ফারুক। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলে তিনি সদস্য হন। ১৯৯৭ সালে তিনি উত্তর জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ হন। ওই কমিটির মেয়াদ ছিল ২০০৪ সাল পর্যন্ত।

১৯৯২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে উত্তর কমিটিতে সদস্য ও কোষাধ্যক্ষ ছিলেন ওমর ফারুক চৌধুরী। এরশাদের আমলে যুব সংহতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ওমর ফারুকের আয় বাড়তে থাকে। মালিক হন পোশাক কারখানার। ১৯৮৮ সালে রাউজানে পোশাক কারখানা স্থাপন করেছিলেন তিনি, যা পরে চট্টগ্রাম শহরের জুবিলি রোডে স্থানান্তর করেন।

তবে এই ব্যবসা করতে গিয়ে সম্পদ নিলামে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয় ওমর ফারুকের। ব্যাংকঋণের দায়ে নগরের একটি বাড়ি এবং রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের জমি ও ঘর নিলামে ওঠার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ ঘটনা ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে। ওই সময় নিলামে তোলার দিনক্ষণও ধার্য করেছিলেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ এনে নিলাম ঠেকান ওমর ফারুক।

১৯৯৭ সালে সোনালী ব্যাংকের চট্টগ্রামের কে সি দে রোডের শাখা থেকে ওমর ফারুক চৌধুরী ও তার স্ত্রী শেখ সুলতানার নামে থাকা প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাওনিট অ্যাপারেলস ও মেসার্স রাও গার্মেন্টসের নামে ১১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়, যা পরে সুদ-আসলে সাড়ে ৪৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। টাকা আদায় না করতে পেরে অর্থঋণ আদালতে যায় ব্যাংক। চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে সোনালী ব্যাংকের করা মামলা দুটি ১০ বছর ধরে ঝুলে আছে। উচ্চ আদালতে দুই মামলারই কার্যক্রম এখনো স্থগিত রয়েছে। এ কারণে ওমর ফারুকের শহরের বাড়ি এবং গ্রামের জমি ও ঘর নিলামে তোলা যায়নি। নানা প্রতিকূলতায় তিনি শিল্পপ্রতিষ্ঠান দুটি দাঁড় করাতে পারেননি। এ জন্য তার ব্যাংক দেনা বাড়ে। সোনালী ব্যাংক এখনো টাকা পাবে। সুদ মওকুফের জন্যও আবেদন করা রয়েছে।

সম্পদ নিলামে ওঠার দুই মাস আগেই যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন ওমর ফারুক চৌধুরী। আওয়ামী লীগও ওই বছরের শুরুতে ক্ষমতায় আসে। পরিস্থিতি বদলাতে থাকে তার। ব্যাংকঋণের একটি অংশ পরিশোধ করেছেন তিনি। তবে এখন আর ওমর ফারুক চৌধুরীর দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই।

একাধিকবার দল পরিবর্তন এবং ৭১ বছর বয়সেও যুবলীগের চেয়ারম্যান পদে থাকা এই নেতা কোন এক অদৃশ্য কারণে যুব সংগঠনটির নেতৃত্বে রয়েছেন। এ অবস্থায় সংগঠনের শীর্ষ অনেক নেতার পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে যে- ৪০ বছরের বেশি কারও কোনোভাবেই যুবলীগের নেতা হওয়া উচিত নয়।

এদিকে প্রতাপশালী চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর পাশে থাকছে না তার সংগঠন যুবলীগ। বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে সরকারি নিষেধাজ্ঞা, ব্যাংক হিসাব তলবসহ নানা সমালোচনার মুখে থাকা যুবলীগ চেয়ারম্যানকে ছাড়াই কিভাবে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কংগ্রেস করা যায়, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। গতকাল শুক্রবার যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের এক সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয় বলে সংগঠনের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র মতে, যুবলীগের কংগ্রেসে কে সভাপতিত্ব করবেন, তা ঠিক করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুবলীগ। এ ক্ষেত্রে দুর্দিনে সংগঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, এমন পরীক্ষিত কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য তারা শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানাবেন।

প্রসঙ্গত, রাজধানীতে মাদক-ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে গ্রেফতার হন যুবলীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। এরপর এসব নেতার সঙ্গে যুবলীগ চেয়ারম্যানের সখ্যের তথ্য উঠে আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তার মদদেই রাজধানীতে অনেক যুবলীগ নেতা ক্যাসিনো ব্যবসা করেন বলে অভিযোগ উঠে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে নানান অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে ওমর ফারুক চৌধুরীর দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তলব করা হয় ব্যাংক হিসাব। এর পর থেকে রাজনীতি থেকে অনেকটাই আড়ালে চলে যান ওমর ফারুক।
এসএ/