ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পঁচাত্তরীয় গোয়েবলসরা আবার মাঠে নেমেছে

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

প্রকাশিত : ১২:০২ এএম, ১৬ অক্টোবর ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ১২:০৪ এএম, ১৬ অক্টোবর ২০১৯ বুধবার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩ অক্টোবর থেকে ৫ অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে দিল্লি সফর করেন। টানা তৃতীয়বার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করার পর এটাই ছিল শেখ হাসিনার প্রথম ভারত সফর। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার একই রকম বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লিতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। 

দুই প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব অঙ্গনে অত্যন্ত প্রভাবশালী লিডার হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। দুইজনই শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী নেতা হয়েও রক্ষণবাদিতাকে পরিহার এবং বহুত্ববাদের ধারক-বাহক হওয়ার কারণে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের রসায়ন ও উচ্চতা আজ অন্যতম একটা মাত্রায় পৌঁছে গেছে। এই সম্পর্কের ওপর ভর করে দুই দেশ একত্রিতভাবে আগামী দিনের বিশ্ব ব্যবস্থায় পিভট অব দ্য ওয়ার্ল্ড হিসেবে এশিয়ার গুরুত্ব ও সম্ভাবনাকে নিজের রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারলে ভারত তো বটেই, বাংলাদেশকে আর কখনও পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভারত-বাংলাদেশকে শক্তিশালী বন্ধনে থাকতে হবে।

ভিন্ন অবস্থানে থেকে বা বিপরীতমুখী হয়ে দুই দেশের কারও পক্ষেই ওই বিশাল সম্ভাবনার সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। আগামী দুই দশকে আগত সম্ভাবনার পথে দুই দেশের জন্য একই রকম চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। এই চ্যালেঞ্জ সফলতার সঙ্গে মোকাবেলার জন্য দুই দেশের ইউনিফাইড অবস্থানের কোনও বিকল্প নেই। আজকের বাস্তবতায় ভারত-বাংলাদেশের ভাগ্য এই সূত্রে গাঁথা। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের বেশ পূর্বেই নির্ধারিত ছিল যে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠকের জন্য ১১-১২ অক্টোবর ভারত আসছেন। এই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সময়ে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করে ভারত বিরল সম্মানে সম্মানিত করেছে বাংলাদেশকে। টানা তিন মেয়াদে দেশ পরিচালনায় এর আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ২০১০ সালে প্রথমবার এবং ২০১৭ সালে আরেকবার ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলেন। ফিরতি হিসেবে ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং ২০১৫ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেন।

তাই প্রতিবেশি হিসেবে আন্ত:রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এবং দুই দেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিচার বিশ্লেষণ করতে হলে বিরাজমান প্রেক্ষাপট, যে কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছি সেটি এবং বিগত সময়ে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর সফর, তার সঙ্গে গত ৯ বছরে আদান-প্রদানসহ দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত সমস্যাগুলোর সমাধানের চিত্র তুলে ধরতে হবে। বিচ্ছিন্ন, একতরফা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য যুক্তিবান মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে বাংলাদেশের কিছু কথিত কূটনৈতিক ব্যাক্তি ও দু-চারটি মূল স্রোতের পত্রিকায়, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে সাম্প্রদায়িক কুৎসাসহ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ডাহা মিথ্যাচার করছে তার প্রেক্ষিতে আজকের লেখাটি লিখতে বসেছি। দুই দেশের সম্পর্ক ও আদান-প্রদানের সার্বিক চিত্রটাই তুলে ধরতে চাই বলে একেবারে পিছন থেকে শুরু করতে হবে। ১৭ কোটি মানুষ, আমরা আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। আমরা আরও গর্বিত এই কারণে যে, মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হই। আমরা চেয়েছি, আর সীমাহীন রক্ত দিয়েছি বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এটা কারও দয়া দাক্ষিণ্যের ব্যাপার ছিল না।

কিন্তু সে সময়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির যে প্রেক্ষাপট ছিল তাতে ভারত শুরু থেকে যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ একাত্মতা ঘোষণা করেছিল সেটি যদি না করত এবং শেষ দিকে এসে সরাসরি ভারতের সশস্ত্র বাহিনী যদি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে না নামত, তাহলে কী মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা হতো? আরেকটি ভিয়েতনাম হওয়ার পরিণতি থেকে কি আমরা রক্ষা পেতাম? সঠিক সংখ্যা অফিসিয়ালি প্রকাশিত না হলেও সকলেই জানেন প্রায় ২০ হাজার ভারতীয় সেনা সদস্য আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে। বাংলাদেশের এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ, বুদ্ধিজীবি ও কূটনৈতিক, যাদের মনপ্রাণ সাত চল্লিশের সাম্প্রদায়িক চেতনায় আচ্ছন্ন, তারা এবং সে সঙ্গে সাধের পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার মনো বেদনায় কাতর, এই দুই গোষ্ঠি মিলেমিশে কুযুক্তি দেখায় এই বলে যে, ভারত তাদের স্বার্থের জন্যেই সব করেছে। বলতেই হবে এরা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ পোষণ করেন বলেই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশাল অর্জন ও প্রাপ্তির দিকে না তাকিয়ে আমাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে কোলেটারেল বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে ভারত কি সুবিধা পেয়েছে সেটিকেই বড় করে দেখায়। উগ্র সাম্প্রদায়িক ও বিশ্ব সন্ত্রাসী রাষ্ট্র পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি আর এদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় ভারত ভূ-রাজনীতির সমীকরণে যে সুবিধা পেয়েছে তাতে তো আমাদের কোনও ক্ষতি হয়নি, ক্ষতি হলে হয়েছে পাকিস্তানের। এদের মনোকষ্ট দেখে মনে হয় পাকিস্তানের ক্ষতি হওয়ায় এরা চরমভাবে ভারত বিদ্বেষী হয়ে ওঠেছে। আমরা স্বাধীন হয়েছি এটা তাদের কাছে বড় কথা নয়, বড় কথা হলো পাকিস্তানের ক্ষতি হয়ে গেল। এই মানসিকতার ধারাবাহিকতা এখনও চরমভাবে বিদ্যমান। 

দ্বিতীয়ত, বাহাত্তর সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া একটা দেশ। সে অবস্থায় মাত্র তিন মাসের মাথায় প্রায় লক্ষাধিক ভারতীয় সেনা ফিরে গেল, যার উদাহরণ বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। এই মিথ্যাচারি গোয়েবলসগণ যা বলে তা যদি সত্যি হবে তাহলে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা সারা বিশ্ব চষে বেড়াত না এবং তিন মাসের মাথায় লক্ষাধিক সেনাবাহিনী ফেরত নিত না। তখন অনেক রকম অজুহাত দেখানোর সুযোগ ছিল, যার দ্বারা ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে থেকে যেতে পারত। 
পঁচাত্তরের পর এই গোয়েবলসীয় বাহিনী অপপ্রচারের পর জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে যায়। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এর বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলতে না পেরে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং একই সঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে ভয়াবহ গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে সেই থেকে। বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা মুছে ফেলার জন্য এমন কোনও কাজ নেই যা এরা করেনি। এরা বঙ্গবন্ধু বলে না, জাতির পিতা বলে না। তাহলে বুঝুন। এদের মনোবঞ্চনা বুঝতে আর কিছু লাগে না। তারা যদি স্বাধীনতা অর্জনকে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মনে করত, তাহলে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এত মিথ্যাচার আর ক্ষোভ কেন। কান টানলে অবশ্যই মাথা আসে। তারপর আসুন বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তির কথায়। পঁচাত্তরের পর এই গোয়েবলসীয় বাহিনী এবং জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে অপপ্রচার আর মিথ্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মসহ মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়, ওটা ছিল ভারতের সঙ্গে গোলমির চুক্তি। প্রোপাগান্ডা, শেখ মুজিব বাংলাদেশকে ভারতের গোলামে পরিণত করেছে।

এই কথাগুলো তো পাকিস্তানের কথা, যা এদের মুখ থেকে গড়গড় করে বের হচ্ছে। এটা নিয়ে তারা অনেক লেখালেখি করেছে, সভা সমিতিতে বক্তৃতা করেছে। কিন্তু ওই চুক্তিতে কতটি দফা ছিল এবং তার কোন দফা, বাক্য বা শব্দের দ্বারা গোলামি বোঝায় তা আজ পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেনি। স্পেসের অভাবে চুক্তির সব দফা নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। শুধু এতটুকু বলি, ওই চুক্তির পঞ্চম দফায় বাণিজ্য ও পরিবহন এবং ৬ষ্ঠ দফায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি, বিদ্যুত সম্পর্কে যেসব প্রস্তাবগুলো ছিল তা যদি বাস্তবায়ন হতো তাহলে আজ ভারতের সঙ্গে আমাদের এত বড় বাণিজ্য ঘাটতি থাকত না এবং নদীর পানি নিয়ে যে সমস্যা হচ্ছে সেটিও অনেক আগেই মীমাংসা হয়ে যেত। দ্বিতীয়ত এই চুক্তির নবম দফার জন্য বাহাত্তরে বাংলাদেশকে আরেকটি ভিয়েতনাম হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। 

১৯৬৪ সালে যেমন মার্কিন সেনাবাহিনী নিজেরা অজুহাত তৈরি করে ভিয়েতনামে নেমে পড়েছিল, তেমন মার্কিন সপ্তম নৌবহর যে কোন অজুহাত তৈরি করে বাংলাদেশে নেমে পড়তে পারতো। কিন্তু মৈত্রী চুক্তির নবম দফা এবং ঠিক এরকম আরেকটি চুক্তি ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে থাকার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন পিছিয়ে যায়। নবম দফায় ছিল, দু'দেশের মধ্যে যেকোনো একটি দেশ যদি তৃতীয় কোন দেশের দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে দুই দেশ সম্মিলিতভাবে সেই তৃতীয় শক্তিকে প্রতিহত করবে। দুই দেশের সম্পর্কের হিসাব কখনো পাটিগণিতের অংকের মত হয় না। তারপরেও তালিকা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের প্রাপ্তি ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। 

যেমন- এক; গঙ্গা নদীর পানি বন্টনের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হয়েছে, যা জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়ার সরকার ২৬ বছর ক্ষমতায় থেকেও করতে পারেনি। দুই; পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের এক দশমাংশ সম্পদশালী অঞ্চলের ভৌগলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে সমস্ত হুমকির নিরসন হয়েছে। তিন; ২০১৫ সালে ছিট মহল বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে চিরস্থায়ীভাবে ভারত যা পেয়েছে তার থেকে তিনগুণ বেশি জমির সার্বভৌম মালিকানা লাভ করেছে। চার; সত্তর বছর ধরে জিইয়ে থাকা সমুদ্র সীমানার শান্তিপূর্ণ সমাধান হাওয়ায় বাংলাদেশ এক লাখেরও অধিক কিলোমিটার সমুদ্র এলাকার ওপর নিরবিচ্ছিন্ন সার্বভৌমত্ব লাভ করেছে। ভারত না চাইলে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কখনো কার্যকর হতো না। এরকম উদাহরণ বিশ্বের অনেক দেশে আছে, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় হওয়ার পরেও তা কার্যকর হয়নি। পাঁচ; বাংলাদেশ ভারতের বাণিজ্যের মধ্যে এখনো সঙ্গত কারণেই ভারতের পক্ষে থাকলেও গত এক বছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে শতকরা ৫২ ভাগ। ভারতের পেঁয়াজ থেকে শুরু করে সব ধরনের মশলাপাতি বাংলাদেশের না এলে এসব দ্রব্য কয়েকগুণ বেশি মূল্য কিনতে হতো বাংলাদেশের মানুষের। ছয়; ভারত থেকে বাংলাদেশ ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারছে। সাত; আসাম থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরাসরি ডিজেল আসবে বাংলাদেশে, চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আট; ১৫ লাখ বাংলাদেশের মানুষ বছরে ভারতে যেতে পারছে চিকিৎসা সেবা গ্রহণসহ অন্যান্য কাজে। এর জন্য ভিসাপ্রক্রিয়াসহ যাতায়াত ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সহজীকরণ করা হয়েছে। নয়; বাংলাদেশকে ৮ বিলিয়ন ডলার সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে ভারত। এদিক থেকে ভারতের পক্ষ হতে বাংলাদেশেই সর্বোচ্চ সাহায্য পাওয়ার দেশ। দশ; ভুটান ও নেপালে উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ থেকে ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশ প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে। উপরে  এক থেকে দশ ক্রমিক নাম্বারে মোটাদাগে আমাদের প্রাপ্তির যে বিষয়গুলো উল্লেখ করলাম তার বিনিময়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে ভারত যা পেয়েছে সেটিকে সংক্ষেপে প্রকাশ করা যায় এভাবে, ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভূ-খন্ডগত নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের সহযোগিতার জন্য এবং একই সঙ্গে এই সাতটি রাজ্যের উন্নয়ন ও তার সঙ্গে কম মূল্যে কম সময়ে সব প্রকার যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশের স্থল, নৌপথ ও বন্দরগুলো ব্যবহারের সুযোগ পাবে ভারত, তাও সুনির্দিষ্ট মাশুলের বিনিময়ে।

দু'দেশের মধ্যে আরও কিছু সহযোগিতা যেমন, সীমান্ত হাট, বাস ও রেল যোগাযোগ সহজীকরণ হয়েছে, যার সুবিধা উভয় দেশের মানুষ পেলেও বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত কম আয়ের মানুষ ভারতে চিকিৎসার জন্য যান; তাদের যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক সহজলভ্য হয়েছে। এবার আসি প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সফর সম্পর্কে। গোয়েবলসীয় বাহিনী মিথ্যাচার করছে বাংলাদেশের গ্যাস দিয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতকে। এর থেকে মিথ্যাচার আর হতে পারে না। বাংলাদেশের কোন গ্যাস ভারতকে দেওয়া হচ্ছে না। অন্য দেশ থেকে এলপিজি বাংলাদেশে আমদানি করবে তার একটা অংশ আবার ভারতের কাছে বিক্রি করবে। এতে পরিবহন, বটলজাতকারণসহ সব কাজ করবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। তারপর মুনাফা যোগ করে বিক্রি করবো, এতে তো সব দিক থেকে বাংলাদেশের লাভ। ভারতের লাভ তারা ত্রিপুরার গ্যাস দিতে পারবে, যা অন্যভাবে আরও ব্যয়বহুল। ফেনী নদী থেকে মাত্র ১.৮২ কিউসেক পানি যাবে ত্রিপুরার সাবরুম শহরের মানুষের পানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য। তিস্তার পানি বাংলাদেশের নায্য পাওয়ানা; সেটা ভারত স্বীকার করেছে এবং দেওয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু কেন এখনো হচ্ছে না তা সকলের জানা। তাই বলে ১.৮২ কিউসেক খাবার পানি দেওয়া হবেনা, এরকম মনোভাব নিয়ে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা হয়না। আন্ত:রাষ্ট্রীয় সম্পর্কে এরকম দৃষ্টিভঙ্গির উদাহরণ বিশ্বে নেই। উপকূলীয় এলাকা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের এর আওতায় আনার জন্য ভারতীয় রাডার স্থাপন করা হবে। এতে বাংলাদেশ বিশাল সমুদ্র সম্পদের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখতে পারবে। বিশ্বের বহু দেশ সম্মিলিত স্বার্থের নিরাপত্তার জন্য পর্যবেক্ষণসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বিত ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। এতে দুই পক্ষের কারো নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, বরং প্রতিবেশীর সঙ্গে তথ্য আদান প্রদানের ঘাটতি ও ভুল বোঝাবুঝির জন্য আকস্মিক কোন দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে না তার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং এখন যারা কুচক্রী ও মিথ্যাচার করছে, পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, এরা সেই পুরানো পঁচত্তরীয় গোয়েবলসীয় বাহিনী। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তারা এটা করছে, যেমনটি তারা করেছিল পঁচাত্তরে। 

লেখক: রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: sikder52@gmail.com

এনএস/