ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ইলিশ ধরতে গিয়ে ধরা খেলো ৫ পুলিশ, অতঃপর... 

বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৮:৪৮ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৯:২৩ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০১৯ সোমবার

ইলিশ শিকারে এসে আটক হওয়া পাঁচ পুলিশ সদস্যকে কোন আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জসীম উদ্দীনের বিরুদ্ধে। রোববার (২০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীর ধুলিয়া পয়েন্টে বিশাল আয়োজন করে মাছ ধরার সময়ে তাদেরকে আটক করা হয়। 

নিষেধাজ্ঞার দ্বাদশতম দিন রোববার (২০ অক্টোবর) স্পিডবোর্ড, ভাড়ায় চালিত ট্রলার, নৌকা ভর্তি জাল ও চুক্তিতে আসা কয়েকজন জেলেসহ ইলিশ শিকারে এসে সন্ধ্যার দিকে পটুয়াখালীর বাউফলের তেঁতুলিয়া নদীর ধুলিয়া পয়েন্টে নৌ-ফাঁড়ির পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের অভিযানে আটক হন মোহাম্মদ আলী ও মো. জুলফিকারসহ পাঁচজন। যারা বরিশাল বন্দর থানা পুলিশের সদস্য বলে জানা গেছে।

অভিযানকালে প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, সন্ধ্যায় তেঁতুলিয়া নদীর ধুলিয়া পয়েন্ট থেকে ইঞ্জিন চালিত একটি স্টিলবডি ট্রলার ও নৌকাভর্তি বিপুল পরিমাণ জাল ও ইলিশসহ আটক করা হয় বরিশাল বন্দর থানার পুলিশের পাঁচ সদস্যকে। এসময় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জসীম উদ্দিন অজ্ঞাত একজনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ছেড়ে দেয়া হয় আটককৃত ওই পাঁচ পুলিশ সদস্যের তিনজনকে। 

তিনি আরও জানান, এরপর রাত ১০টার দিকে ওই মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলী ও মো. জুলিফিকার নামে ওপর দুই পুলিশ কনস্টেবলকে আটকের বিষয়টি মিডিয়া কর্মীদের জানালেও কোনও ধরণের আইনী প্রক্রিয়া ছাড়াই তাদেরকে কালাইয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সোহাগের কাছে হস্তান্তর করেন। 

এরপর কালাইয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জও কোনও ধরনের আইনী প্রক্রিয়া ছাড়াই ওই দুই পুলিশ সদস্যকে
তড়িঘড়ি করে একটি মাইক্রোযোগে বরিশাল বন্দর থানার উদ্দ্যেশে পাঠিয়ে দেন বলেও জানান তিনি।

এদিকে, নিষেধাজ্ঞাকালীন ইলিশ শিকারে এসে পাঁচ পুলিশ আটক হওয়া এবং কোন প্রকার আইনী প্রক্রিয়া ছাড়াই তাদেরকে ছেড়ে দেয়ার এ ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয়দের মাঝে। 

নিষেধাজ্ঞা কাজে লাগিয়ে পুলিশের ওই সদস্যরা জেলেদের দামি জাল ও ইলিশ লুট করেছে- এমন অভিযোগ তুলে অভিযানে প্রশাসনের সঙ্গে থাকা ওই ব্যক্তি বলেন, ‘দিনে-রাতে অবাধে জেলেরা তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকার করে চলছে এই অবরোধেও। অজ্ঞাত কারণেই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ বছর অনেকটাই ঢিলেঢালাভাবে তেঁতুলিয়ায় অভিযান পরিচালনা করছেন। আগের দিন কোস্টগার্ডের হাতে তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন পয়েন্টে ১৪ জন অসাধু জেলে আটক হলেও তার ক্রেডিট নিতে মৎস্য কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন 'ওই জেলেরা উপজেলা প্রশাসনের অভিযানে আটক হয়েছে' বলে মিডিয়া কর্মীদের জানিয়েছেন।’

অন্যদিকে এই অবরোধের মধ্যে তেঁতুলিয়া নদী রাতের বেলার পুরোটাই অরক্ষিত থাকে। আর তখনই মা ইলিশ শিকারের মহোৎসব চলে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে কালাইয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই সোহাগ ফকির জানান, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাসহ নৌ-ফাঁড়ির পুলিশের অভিযানে পুলিশ সদস্য মোহাম্মদ আলী ও জুলফিকার আলীকে আটক করা হয়। এ সময় জব্দ করা হয় একটি ট্রলারভর্তি বিপুল পরিমাণ জাল ও মা ইলিশ। কয়েকজন একটি স্পিডবোট, ইঞ্জিনচালিত একটি স্টিলবডি ট্রলার ও নৌকা নিয়ে বরিশালের কাউয়ার চর এলাকা থেকে তেঁতুলিয়া নদীর ধুলিয়া পয়েন্টে প্রবেশ করছিল। এসময় তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলে স্পিডবোট ও কাঠের নৌকায় থাকায় কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তবে তাদের গায়ে তখন পুলিশের পোশাক ছিল। 

তিনি আরও জানান, তাৎক্ষণিক বিষয়টি বরিশাল নৌ-পুলিশের সুপারকে জানানো হলে তার নির্দেশে পুলিশ সদস্য মোহাম্মদ আলী ও জুলফিকার আলীসহ তাদের সঙ্গে থাকা ভাড়ায় চালিত ট্রলার ও রোজ তিনশ’ টাকা চুক্তিতে ইলিশ শিকারে আসা বরিশালের চর কাউয়া গ্রামের আনছার হাওলাদারের ছেলে আশিক (২০), জালাল জোমাদ্দারের ছেলে রবিউল (১৬), রশিদ সিকদারের ছেলে নাইদুল (২৫) ও হামিদ খানের ছেলে মো. রাকিবকে (২৩) কালাইয়া বন্দর নৌ-ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে বরিশাল বন্দর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন তালুকদারসহ ওসি (তদন্ত) বাউফলে এসে ওই দুই পুলিশ সদস্যকে নিয়ে যায়। ট্রলার, জাল ও মাছসহ জেলে আশিক, রবিউল, নাইদুল ও রাকিবকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা
হয়। 

এদিকে, আটকের পর তিন পুলিশ সদস্যকে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘দুই পুলিশ সদস্যকে আটক করা হয়েছিল। ফেরার পথে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার কথা বলে কালাইয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সোহাগের সঙ্গে ডাঙায় নামেন আটক হওয়া ওই দুই জন। এরপর তারা বোটে উঠতে গড়িমসি করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে তাদেরকে কালাইয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের কাছে রেখে চলে আসি।’

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শুভ্রা দাস বলেন, ‘ডিসি স্যারকে জানিয়েই ওই দুই পুলিশ সদস্যকে নৌ পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। যেহেতু তারা একটি বাহিনীর সদস্য, তাই তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ বিষয়ে কালাইয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সোহাগ বলেন, ‘এখানে অবৈধভাবে ইলিশ ধরতে আসা কথাটি সঠিক নয়, তারা সীমানা ক্রস করে আমাদের সীমানায় ঢুকে পড়েছিলো। তাদের আটক কিংবা গ্রেফতার করা হয়নি। তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কালাইয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়।’

তবে ওই পুলিশ সদস্যদের কাছে জালসহ ইলিশ মাছ পাওয়া গেছে এবং ওই সময় তাদের সঙ্গে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের টাস্কফোর্স কমিটির কোনও সদস্যও ছিলেন না কিংবা কোনও ধরনের আইনী প্রক্রিয়া ছাড়াই তাদেরকে কিভাবে বরিশাল বন্দর থানায় পাঠিয়ে দেয়া হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বরিশাল অঞ্চলের নৌ-পুলিশ সুপার মো. কফিল উদ্দিন স্যার এবং বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান স্যারের নির্দেশে বরিশাল বন্দর থানার ওসি নিজে এসে আটক ওই দুই পুলিশ সদস্যকে নিয়ে গেছেন। এর থেকে বেশি কিছু আমার বলার নেই।’

এ ব্যাপারে বরিশাল বন্দর থানার ওসি মো. আনোয়ার হোসেন তালুকদার বলেন, ‘আমি নিজে যাইনি, তবে আমি অফিসার পাঠিয়েছিলাম।’ 

তবে এভাবে আটক হওয়া কোনও পুলিশ সদস্যকে নিয়ে আসা যায় কি না জানতে চাইলে তিনি প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে তারা অপরাধী হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হবে।’

এদিকে দুই পুলিশ সদস্যকে নিয়ে আসার বিষয়ে নির্দেশনার বিষয়টি স্বীকার করে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘দুইজন হোক কিংবা পাঁচজন, এ বিষয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এনএস/