ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শহীদ গোলাম কিবরিয়া ও আব্দুল বারী মোল্লা : রাজনীতির নির্মোহ বন্ধন

ড. রকিবুল হাসান

প্রকাশিত : ১২:৪০ পিএম, ৩ নভেম্বর ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ১২:৪৪ পিএম, ৩ নভেম্বর ২০১৯ রবিবার

মুুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী, প্রাদেশিক পরিষদের সাবেক সদস্য ও সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া। তিনি কুমারখালী-খোকসার মানুষের কাছে কিংবদন্তি তুল্য নেতা ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোলাম কিবরিয়ার বাড়িতে দুবার এসেছিলেন। ৬ দফা আন্দোলনের আগে একবার এবং আন্দোলনের পরে আরও একবার। ১৯৭৪ সালে কুমারখালির কিংবদন্তি নেতা গোলাম কিবরিয়া ঈদের নামাজ পড়া অবস্থায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। মুত্যুর বহু বছর পরেও এখনো তিনি আগের মতোই সমান জনপ্রিয়।

সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি- গোলাম কিবরিয়া খুব দাপুটে নেতা ছিলেন। তাঁর নাম কুমারখালী-খোকসার মানুষের কাছে নিঃশ্বাসের মতো বর্তমানেও প্রাণময়। এখন তাঁর সম্পর্কে আমার একটা ভালো ধারণা হয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমি তাঁকে দেখিনি।

কুমারখালী-খোকসার একটি পরিবারই এখনো পর্যন্ত বংশানুক্রমিকভাবে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের আদর্শ ধারণ করে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এর বাইরে দ্বিতীয় আর একটি পরিবার পাওয়া কঠিন হবে। শুধু কঠিন নয়, কঠিনের থেকেও কঠিন। এ পরিবারটি শহীদ গোলাম কিবরিয়ার পরিবার। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আদর্শের সৈনিক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন সহযোদ্ধা ছিলেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর সন্তান আবুল হোসেন তরুণ ও তাঁর স্ত্রী সুলতানা তরুণও সংসদ সদস্য ছিলেন। এই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের তরুণ সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জও বর্তমান সংসদের সদস্য। এসবই জানা কথা, কুমারখালী-খোকসার মানুষ জানে। কুমারখালী-খোকসার প্রতিটি পাখপাখালি, নদীনালা, খালবিল ধূলিকণাও এ কথা জানে।

সাধারণ মানুষের সঙ্গে এ পরিবারের গভীর সম্পর্ক। তা যেমন, রাজনৈতিক ঠিক তেমনি আত্মিকও। এ পরিবারটিকে নির্দিষ্ট একটি গণ্ডি বা চার দেয়ালের মধ্যে আটকে ফেলানো সম্ভব নয়। গোটা কুমারখালী-খোকসাই যেন এ পরিবারের অংশ। এই সময়কালেও সেই বন্ধন তারা ধরে রেখেই চলছেন। যা অনুমান করা যায়। মসনদের গরম অহংকার, দেমাগ তাদের দখল করতে পারেনি। যে কারণে এ পরিবারটি এখনো এলাকার মানুষের আশা-ভরসার জায়গাটি ধরে রাখতে পেরেছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় বহু নেতা নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। হত্যার মধ্যে দিয়ে তাঁদের জনপ্রিয়তাকে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো। গোলাম কিবরিয়াকেও হত্যা করে তাঁর জনপ্রিয়তাকে নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল খুনিরা। এমনটি ঘটে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনেও। তাকে হত্যা করে একইভাবে খুনিরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে মানুষের হৃদয় থেকে মুছে দিতে। কিন্তু তা কি সম্ভব হয়েছে? বরং আজ মানুষ তাকে আরও বেশি হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। আসলে এসব নায়ক-মহানায়করা তাঁদের খুনিদের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে আরো বেশি জীবন্ত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।
এসব বিখ্যাত মানুষ তাঁদের কর্ম, সততা, নিষ্ঠা, বিশ্বাস ও ত্যাগ দিয়ে সকলের হৃদয়ের মানুষ হয়ে উঠেছেন। তারা সন্তান না হয়েও কারও কারও কাছে সন্তান, ভাই সর্বপরি পরিবারের আপনজন হয়ে উঠেছেন। কালের যাত্রায় এসব সম্পর্কের সব হয়তো আবিষ্কৃত হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই থেকে যায় অনাবিষ্কৃত। শহীদ গোলাম কিবরিয়ার জীবনেও এরকম কিছু বিশেষ মানুষ ছিলেন। যারা তাঁর হৃদয় ও আস্থা-দুটোই দখল করেছিলেন। এদের অনেকেই হয়তো এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। আবার কেউ বেঁচে থাকলেও মৃত্যুর কাছাকাছি এসে ধুকছেন প্রতিটি নিঃশ্বাসে। যাদের একজন আব্দুল বারী মোল্লা। কুমারখালীর মানুষ একসময় তাঁকে একনামে চিনতেন। তবে এখনকার তরুণ সমাজের কাছে তিনি সেভাবে পরিচিত নন। গোলাম কিবরিয়ার সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ বলতে যে দু-চারটি নাম উচ্চারিত হয় তাদের মধ্যে বারী মোল্লা ছিলেন অন্যতম।

বারী মোল্লার বাড়ি সান্দিয়াড়ার রাজাপুর গ্রামে। বর্তমানে তাঁর বয়স ৯৭ বছর। তিনি গোলাম কিবরিয়ার অন্ধ অনুসারী ও অনুগত ছিলেন। নিঃস্বার্থ ও নির্মোহ মানুষের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি তিনি। ব্যক্তিগত লোভ-লালসা কখনোই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। এলাকার উন্নয়ন, এলাকার মানুষের কল্যাণসাধনই তাঁর কাছে মূল ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গোলাম কিবরিয়ার নির্দেশ মেনেই তিনি অস্ত্র হাতে রাজাপুর গ্রামে রাজাকার, আল বদরদের প্রতিরোধের দূর্গ গড়ে তুলেছিলেন। গোলাম কিবরিয়া যুদ্ধের সময় সান্দিয়াড়ার রাজাপুর এলাকায় রাজাকারদের প্রতিরোধ করার জন্য তিন জনকে তিনটি কাটা রাইফেল দিয়েছিলেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন আব্দুল বারী মোল্লা। অন্য দুজন সিরাজুল ইসলাম ও আব্দুল মালেক।

সিরাজুল ইসলাম ‘সিরাজ দোকানদার’ ও আব্দুল মালেক ‘মালেক ডাক্তার’ নামে পরিচিতি ছিলেন। এ দুজন এখন আর বেঁচে নেই। কমান্ডার লুৎফর রহমানের নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী এই তিনজন কাটা রাইফেল নিয়ে নিজের এলাকায় স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিরোাধ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরা রাতের পর রাত জেগে প্রতিরোধের শক্ত প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজাকাররা বহুভাবে চেষ্টা করেও রাজাপুর এলাকাতে ঢুকতে পারতো না। যে কারণে রাজাকাররা বারী মোল্লাসহ অন্য দুজনকে বিভিন্নভাবে হত্যার চেষ্টা করেছিল। তবে তারা সফলকাম হতে পারেনি। অস্ত্রহাতে তিনজন গ্রামের বিভিন্ন জায়গাতে এমন কৌশলে অবস্থান গ্রহণ করতেন, এমনভাব দ্রুত স্থান পরিবর্তন করতেন, এমনভাবে গুলি ছুঁড়তেন, স্বাধীনতা বিরোধীদের ধারণা জন্মেছিল যে তারা সংখ্যায় অনেক, তাঁদের কাছে অনেক অস্ত্র রয়েছে।

তাঁদের কৌশলী অবস্থানের কারণে রাজাপুর গ্রাম মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্পূর্ণ সুরক্ষিত ছিল। কোন ধরণের ক্ষতির শিকার হয়নি। অনেক চেষ্টা করেও রাজাকাররা রাজাপুর গ্রামে হত্যা লুণ্ঠন অগ্নি সংযোগ ধর্ষণ কোনো ধরণের ক্ষতিসাধন করতে পারেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বারী মোল্লা স্বপ্রণোদিত হয়ে কুমারখালী গিয়ে তাঁর নেতা গোলাম কিবরিয়ার হাতে অস্ত্র সমর্পণ করেন। তিনি এতে খুশি হয়ে তাঁর প্রতি আরো অনেক বেশি স্নেহশীল হন।

১৯৭৩ সালে গোলাম কিবরিয়া জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর কুমারখালী-খোকসা এলাকার তাঁর প্রিয় সহকর্মীদেও নিজের বাসায় আমন্ত্রণ জানান। মিলনমেলাতে পরিণত হয় কুমারখালী শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত তাঁর বাড়ির প্রাঙ্গণ। তিনি সবার কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমরা কে কী চাও?’ নেতা-কর্মীদের মধ্যে কেউ তার এলাকার গরিব মানুষের জন্য অর্থ সাহায্য চাইলেন, কেউ রিলিফ সহযোগিতা চাইলেন, কেউ ঘর করার জন্য টিন চাইলেন। আব্দুল বারী মোল্লা কিছুই চাইলেন না। তিনি চুপ করে বসে থাকলেন। হুট করে ব্যাপারটি গোলাম কিবরিয়া খেয়াল করলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, সবাই তো কিছু না কিছু চাচ্ছে। বারী, তুই তো কিছু চাইলি না।

বারী মোল্লা বললেন, ‘আমি যা চাবো, তা কি আপনি দেবেন?’

গোলাম কিবরিয়া বললেন, ‘আগে চাবি তো। চেয়ে দেখ- দিই কী না!

বারী মোল্লা বললেন, ‘আপনি আমার রাজাপুর গ্রামে একটা প্রাইমারি স্কুল করে দেবেন?’

এ কথা শুনে গোলাম কিবরিয়া খুব অবাক হন। তিনি কল্পনাও করেননি সদ্য স্বাধীন দেশে বৈষয়িক এবং বস্তুগত কিছু না চেয়ে, এরকম অভাবনীয় কিছু কেউ চাইতে পারেন! তিনি বিস্ময়ে একটু নীরব থেকে বললেন, ‘আচ্ছা, তোর গ্রামে আমি প্রাইমারি স্কুল দেবো।’ তিনি সবার সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফোন করে এ বিষয়টি জানান এবং নিজের কাছে খুব গর্ব অনুভব করেন।

ফোন রেখেই বারী মোল্লাকে বললেন, ‘তোর গ্রামে স্কুল হবে। স্কুল করার জন্য একখণ্ড জমি দিতে পারবি তো?’

আব্দুল বারী মোল্লা কোন কিছু না ভেবে সঙ্গে সঙ্গেই তাতে সম্মতি জানিয়ে দেন। তিনি নিজে জমি দিতে না পারলেও তাঁর বড় মেয়ের শ্বশুর এদিল মোল্লাকে জমি দিতে সম্মত করেন। সেই জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘রাজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। নেতা আর শিষ্যের শ্রদ্ধা ও  ভালোবাসার স্মৃতিস্বরূপ এ প্রতিষ্ঠানটি এখন এলাকায় আলোর ফোয়ারা হয়ে আছে।

সাংসদ গোলাম কিবরিয়া বারী মোল্লা ও তাঁর পরিবারকে এতোটাই স্নেহ করতেন, পারিবারিক সম্পর্কের মতো তাঁদের সম্পর্কের গভীরতা ছিল। পরবর্তীতেও এই সম্পর্ক দুটি পরিবারই রক্ষা করেছে। গোলাম কিবরিয়ার সন্তানেরা বারিক মোল্লাকে বড় ভাইয়ের মতো মান্য করেন এবং তার স্ত্রী নুরুননাহারকে ‘বু’ ডাকেন। রাজাপুরে তাঁদের বাড়িতে কখনো গেলে কদমবুসি করে সম্মান করেন। বারিক মোল্লার সন্তানেরাও তাদের মামা ডাকেন। তাদের সম্পর্ক এতোটাই গভীর ও আন্তরিকতাপূর্ণ যে- কোনোভাবেই বোঝার উপায় থাকে না এরা আপন মামা-ভাগ্নে নন। দুটি পরিবারের মধ্যে রক্তের বন্ধন না থাকলেও আত্মিক যে সম্পর্ক রয়েছে তা রক্তের বন্ধনের চেয়ে কোনোভাবেই কম নয়। রাজনীতি তখন শুধু আদর্শিক ও চেতনাগত বিষয় ছিল না, আত্মিক সম্পর্কেরও বড় একটা বিষয় ছিল।

আব্দুল বারী মোল্লা বর্তমানে বয়সের ভারে ক্লান্ত- মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। যে কোন সময় নিভে যেতে পারে তাঁর জীবনপ্রদীপ। তিনি তাঁর নেতা বলতে- রাজনৈতিক আদর্শ ও পারিবারিক অভিভাবক বলতে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা গোলাম কিবরিয়াকেই বুঝতেন। রাজনীতিতে আত্মার সম্পর্ক, হৃদয়ের বন্ধন যেনো নিভে না যায়।

গণ-মানুষের দরদি নেতা  শহীদ গোলাম কিবরিয়া দিপ্ত আলোর মতন কুমারখালী-খোকসার মানুষের হৃদয়ে থাকবেন চিরোকাল।

লেখক : ড. রকিবুল হাসান (কবি-কথাসাহিত্যিক-গবেষক। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ)
এসএ/