ঢাকা, সোমবার   ১৪ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২৯ ১৪৩১

এখনও দক্ষিণ এশিয়ার গণমাধ্যমের বিকাশ হয়নি: সাংবাদিক তপশ্রী গুপ্তা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:২৬ পিএম, ৮ নভেম্বর ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:০৭ পিএম, ৮ নভেম্বর ২০১৯ শুক্রবার

ভারতীয় সাংবাদিক তপশ্রী গুপ্তা

ভারতীয় সাংবাদিক তপশ্রী গুপ্তা

দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন। তিনি ভারতীয় সাংবাদিক তপশ্রী গুপ্তা। নানা উত্থান-পতনে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। ১৯৮৩ সাল থেকে সাংবাদিকতা শুরু করে এখনো দীপ্ত আলোয় মানুষকে উদ্ভাসিত করার প্রয়াসে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন রাত দিন। কাজ করেছেন বিভিন্ন দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেলে। এখন সাংবাদিকতার পাশাপাশি কাজ করছেন কর্পোরেট দুনিয়ায়। এ ছাড়াও সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন ‘ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ’ সংগঠনের ভারতের সমন্বয়কারী হিসেবে। 

তপশ্রী গুপ্তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে ভারতের দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর একে একে ‘দৈনিক আজকাল’,‘মহূয়া টিভি’, ‘ইটিভি-বাংলা’সহ বিভিন্ন টেলিভিশন ও দৈনিকের প্রতিবেদক, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রধান প্রতিবেদক, বার্তা প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্মাণ করেছেন অনেকগুলি তথ্যচিত্রও। তার নির্মিত বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (নজরুলের বাসা বদল) ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (শিলাইদহ থেকে শান্তি নিকেতন) দুটি তথ্যচিত্র বেশ আলোচিত।

তপশ্রী গুপ্তা বর্তমানে ‘টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ’র গণমাধ্যম সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। একই সঙ্গে লিখে চলছেন দৈনিক আজকাল পত্রিকায়ও। প্রতিবেদক হিসেবে অনেক ঝুঁকি নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি মনে করেন, প্রতিদিন রুটিন কাজ (নিত্যকর্ম) করার চেয়ে একটু অনুসন্ধানী, খবরের পিছনের খবর তুলে আনাই বেশি আনন্দের। 

সম্প্রতি কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ সংগঠনের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ ডায়লগ’র এর নবম রাউন্ডের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তপশ্রী গুপ্তা বাংলাদেশে আসেন। অনুষ্ঠানের ফাঁকে সাংবাদিকতার কন্টকাকীর্ণ পথ, সম্ভাবনা, প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

একুশে টেলিভিশন: ৩৬ বছরের সাংবাদিকতায় আপনার উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পর্কে জানতে চাই।
তপশ্রী গুপ্তা: প্রতিদিনকার কাজ তো আর উল্লেখযোগ্য নয়। তবে এর মধ্যে আমি বেশ ভালো ভালো অ্যাসাইনমেন্ট (অর্পিত কাজ) পেয়েছিলাম। এ কাজগুলো আমি সুন্দরভাবেই শেষ করেছি। নারী হিসেবে আমি প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়নি। 

রাজীব গান্ধীকে যখন হত্যা করা হয় তখন আমি এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি কাজ করেছি। শ্রীলংকায় তামিল গেরিলাদের বিষয়ে কাজ করতে আমি জাফনা গিয়েছিলাম। সেসময় একজন নারী সাংবাদিকের কাজ করা তেমন একটা সহজ ছিল না। এ ছাড়াও তথ্য চিত্রের জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশের আনাচে কানাচে আমাকে ছুটতে হয়েছে। আপনাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও আমার যাওয়া হয়েছে। 

একুশে টেলিভিশন: পেশাগত কাজে কোন বিখ্যাত ব্যক্তির ঘটনা জানতে চাই।
তপশ্রী গুপ্তা: এ বিষয়ে বিস্তর বলা যায়। তবে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি বা বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে আমি এর বাইরে রাখব। কেননা এটা যে কেউ যে কোন বিষয়ে কাজ করতে পারবেন। এর মধ্যে থেকে ভিন্ন কোন ‘স্টোরি’ উঠে আসলে ভিন্ন কথা। আমি ব্যতিক্রমী কোন বিষয়ে বলতে চাই। 
আমার মনে আগে নব্বই দশকের গোড়ার দিকে মানে ৯২ কি ৯৩ সালে আমি পন্ডিত রবি শঙ্করের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সে সময়টা রবি শঙ্করের বেশ ভালো সময় যাচ্ছিল। যতটুকু মনে পড়ে তখন সবার অলক্ষ্যে আমাকে তিনি ভিতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে জানালেন, ‘আমি টাকার অভাবে কাজ করতে পারছি না’। আমি অবাক হলাম। কি বলেন তিনি। এর পরদিন আজকাল’ই এক মাত্র দৈনিক যে এই বিষয়ে একটি লিড স্টরি (প্রধান প্রতিবেদন) ছেপেছিল। 

এরপর শ্রীলংকার জাফনার কাজগুলো অ্যাডভেঞ্চারাস ছিল। সে সময় গেরিলারা বিমান বন্দর থেকে শুরু করে দেশটির সর্বত্র পরিচালনা করত। আমি তখন টেলিভিশনে কাজ করি।  সে সময় ঐ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে হত্যা করেছিল গেরিলারা। আমাদেরকে বেশ ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। সে দিনগুলো আমার জন্য উল্লেখযোগ্য ছিল। বিমানবন্দরে এলটিটি’র (শ্রীলংকার একটি বিচ্ছিন্নবাদী দল) প্যারা বাহিনী নজরদারি রেখেছিল। তারাই যেন রাষ্ট্র চলাচ্ছিল। সে সময় এলটিটি’র একটি প্রশিক্ষণ ভিডিও আমার হাতে আসে। 

একুশে টেলিভিশন: নারী সাংবাদিকদের কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয় কিনা?
তপশ্রী গুপ্তা: এ পেশায় সব থেকে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো মানসিক অশান্তি। বিভিন্ন কারণে সাংবাদিকরা মানসিক অশান্তিতে ভোগেন। তবে নিজ গণমাধ্যমের চিন্তাভাবনা বা পলিসি এবং এডিটোরিয়াল বোর্ডের (সম্পাদকীয় পর্ষদ) জন্য সাংবাদিকরা পছন্দ মতো করতে পারেন না। নিজ মিডিয়া হাউসের কারণে সাংবাদিকরা অনেক কাজই করতে পারেন না। এটা যে নির্দিষ্ট কিছু সাংবাদিকদের জন্য হয় তা কিন্তু নয়। সব সাংবাদিককে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যেতে হয়। নারী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা নেই তা বলা যাচ্ছে না। কিছুটা প্রতিবন্ধকতা এখনও আছে। তবে আগে যেমন ছিল এখন তেমন একটা নেই। ভারতে এমন নেই, বাংলাদেশেও আগের চেয়ে নারী সাংবাদিকরা সমান সুযোগ পাচ্ছেন বলে জানি। 

একুশে টেলিভিশন: কেন সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন?
তপশ্রী গুপ্তা: সাংবাদিকতাকে সেই ছাত্র জীবন থেকেই ভালোবাসি। সে সময়ে কয়েকটি কাগজেও কাজ করেছি। নিজেকে সব সময় একজন সাংবাদিক হিসেবেই কল্পনা করেছি বলে অন্য পেশা কখনও যাইনি বা চেষ্টা করাও হয়নি। সাংবাদিকতা এমন একটা পেশা যার দায়িত্ববোধ এত বেশি যে অন্য কোন পেশায় যেতে হবে তা কখনও অনুভব করিনি।
 
একুশে টেলিভিশন: আশির দশকের এবং এখনকার সময়ে সাংবাদিকতার কোন পার্থক্য দেখেন কিনা? 
তপশ্রী গুপ্তা: আশির দশকে দর্শক, শ্রোতা বা পাঠক খুবই সিরিয়াস ছিল। কোন রাজনৈতিক স্টোরি বা অন্য কোন বিষয়ে দর্শক বেশ শক্তভাবেই দেখতেন। এখন খবরটায় বিনোদন থাকে, জনপ্রিয় করার একটা তাগাদা থাকে। এখন প্রযুক্তির উন্নয়ন হওয়ার কারণে আমরা যারা দেশের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কাজের জন্য ছুটে যাই, তা অনেক সহজ হয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিমিষেই খবর পাঠাতে পারি। এত পালা বদলে সাংবাদিকতার কিছুটা পরিবর্তন তো হবেই। 

সব চেয়ে বড় কথা হলো, মিডিয়ায় আগের মতো বিনিয়োগ করা হচ্ছে না। এখন যতটুকু বিনিয়োগ করা হয় তা ডিজিটাল মিডিয়ায় হচ্ছে। একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, ছাপা পত্রিকা থাকবে না। কিন্তু বিষয়টা মোটেও ঠিক নয়, ছাপা পত্রিকা থাকবে। এর আবেদন সহসা ফুরিয়ে যাবে না। 

একুশে টেলিভিশন: সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কি?
তপশ্রী গুপ্তা: যেমন ধরুন সাংবাদিকরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করছেন। এ সময় তারা বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হতে পারেন। এ জন্য একটু সতর্ক হতে হবে। অনেক সময় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে হয়। তবে সব থেকে বড় কথা হল, এক মাত্র উন্নত বিশ্ব ছাড়া গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এখন গণমাধ্যমের বিকাশ হয়নি। এখনও মিডিয়া হাউসগুলো সাংবাদিকদের সহযোগিতা করে না। আর চাকরিচ্যুত করার বিষয়টা তো আছেই। এর ফল আগামীতে তেমন একটা ভালো দেখছি না।

একুশে টেলিভিশন: ‘ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ’ সংগঠনটির কাজ সম্পর্কে জানতে চাই।

তপশ্রী গুপ্তা: এ সংগঠন ভারত বাংলাদেশের মধ্যকার বিভিন্ন সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে। বিশেষ করে কূটনৈতিক সম্পর্ককে আমরা বেশি গুরুত্ব দেই। দুই দেশ মিলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সম্মেলন এবং সাংস্কৃতিক কাজ করে থাকি। এসবের মাধ্যমে দুই দেশের বন্ধন আরও শক্তিশালী হচ্ছে। ২০১২ সালে আমাদের এ সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। এর মধ্যে আমরা ডায়ালগ’র ৯ম রাউন্ড শেষ করেছি। আগামীতে শিলং’এ ১০ রাউন্ড অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৩ সালে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তি শতবর্ষ উদযাপন করেছিলাম। আগামী বছর কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী পালন করব। এতে আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও আমন্ত্রণ জানাব। আমরা দুই দেশে প্রতিনিধির সমন্বয়ে কাজ করছি। এর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরী হচ্ছে।

 একুশে টেলিভিশন: এখন আপনি করপোরেট সেক্টরে কাজ করছেন, কেমন মনে হচ্ছে এই সেক্টর?

তপশ্রী গুপ্তা: করপোরেট সেক্টর বলতে আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি তারা আজকাল’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছে। সাংবাদিকতার সঙ্গে গবেষণা ও প্রকাশনার প্রতিও আমার বেশ টান আছে বলে টেকনো ইন্ডিয়ায় এসেছি। তবে এখনও দৈনিক আজকাল’ এ লিখে চলছি। বাংলাদেশের কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশে ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ ডায়লগ’র রাউন্ড’র খবর পত্রিকার জন্য আমিই করেছি।  

একুশে টেলিভিশন: তরুণ সাংবাদিকদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
তপশ্রী গুপ্তা: সাংবাদিকতা একটা টিম গেইম। একা একা এখানে সেঞ্চুরি করার কিছুই নেই। তবে খবরের ক্ষুধাটা সাংবাদিকের থাকতে হবে। সাংবাদের পিছনের সংবাদটা উঠিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। আসলাম, কাজ করলাম, চলে গেলাম এমনটা হলে চলবে না। সর্বপ্রথম ভালোবাসা থাকতে হবে। এরপর ব্যতিক্রমী কাজের মাধ্যমে ব্যতিক্রমি হতে হবে।

এমএস/এসি