ঢাকা, বুধবার   ১১ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ২৬ ১৪৩১

ডায়াবেটিসে গর্ভবতী নারীরা যা একেবারেই উপেক্ষা করবেন না

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৭:৪৬ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৯ বৃহস্পতিবার

নারীদের গর্ভধারণের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের বিভিন্ন ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। টাইপ-১ বা টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত নারীরা গর্ভধারণের সময় এবং গর্ভধারণের পর যেমন বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন, তেমনি যেসব নারীর ডায়াবেটিস নেই তারাও গর্ভাবস্থায় বিশেষ ধরণের ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার পর বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারেন। খবর বিবিসি’র।

তাই গর্ভে সন্তান আগে থেকেই ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা যেন তৈরি না হয় সে জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখা প্রয়োজন। গর্ভধারণের ক্ষেত্রে নারীরা মূলত দুই ধরণের ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতার মধ্যে পড়তে পারেন। যাদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস (টাইপ-১ বা টাইপ-২) থাকে এবং যারা গর্ভকালীন অবস্থায় ডায়াবেটিস (জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস) আক্রান্ত হন।

লক্ষণ:
গর্ভধারণের আগে থেকেই যেসব নারীরা টাইপ-১ বা টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত থাকেন তাদের গর্ভধারণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। 

>শিশুর আকৃতি অপেক্ষাকৃত বড় হওয়া, যার ফলে সাধারণের তুলনায় বেশি প্রসব বেদনা অনুভব করতে পারেন নারী।

>গর্ভবতী নারীর চোখে (ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি) ও কিডনিতে (ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি) জটিলতা তৈরির সম্ভাবনা থাকে।

>টাইপ-১ ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ডায়াবেটিক কেটোঅ্যাসিডোসিস হতে পারে যার কারণে রক্তে ক্ষতিকর রাসায়নিক কেটোন তৈরি হতে পারে গর্ভকালীন সময়ে এ ধরণের রোগ তৈরি হতে পারে অথবা এসব রোগ থাকলে গর্ভকালীন সময়ে তার তীব্রতা বাড়তে পারে।

যেভাবে সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে:
সন্তান গর্ভে থাকার সময় মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে নানাভাবে সন্তানের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

>জন্মগ্রহণের পরপরই স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা তৈরি হতে পারে (হৃৎপিন্ড ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা)। 
>ভবিষ্যতে স্থূলাকৃতির দেহ (অতিরিক্ত ওজন) হওয়ার বা ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 
>এছাড়া জন্মের পর থেকেই স্নায়ুতন্ত্র এবং হৃৎপিন্ডের সমস্যার পাশাপাশি আরও কিছু সমস্যা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

যা করণীয়:
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব হেলথ সায়েন্সের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডাক্তার হাজেরা মাহতাব বলেন টাইপ-১ বা টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে গর্ভধারণের অন্তত তিনমাস আগে থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন।

অধ্যাপক মাহতাব বলেন, ‘ডায়াবেটিস আক্রান্ত নারীর গর্ভধারণের পরিকল্পনার আগে নিশ্চিত করতে হবে যে তার ডায়াবেটিস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।’

স্বাভাবিক অবস্থায় ডায়াবেটিসের জন্য যেসব ওষুধ গ্রহণ করতে হতো, গর্ভকালীন অবস্থায় ওষুধ গ্রহণের মাত্রা এবং ওষুধের ধরণ পরিবর্তিত হয় বলে জানান ডাক্তার মাহাতাব।

‘টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগী গর্ভধারণ করলে সাধারণভাবে খাওয়া যায় এমন হাইপোগ্লাইসেমিক এজেন্ট (রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ানোর ওষুধ) বন্ধ করতে হবে এবং উচ্চ রক্তচাপের ওষুধও পরিবর্তন করতে হবে।’

অধ্যাপক মাহাতাবের মতে, গর্ভকালীন অবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। ‘গর্ভকালীন অবস্থায় খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৪.৫ মিলিমোল/লিটার থেকে ৫ বা সর্বোচ্চ ৫.৫ মিলিমোল/লিটার হতে পারে। আর খাওয়ার দু ঘন্টা পরে ঐ মাত্রা ৫ থেকে ৬ মিলিমোল/লিটার হতে পারে।’

এছাড়া যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিষয়ক সরকারি ওয়েবসাইট এনএইচএস’র তথ্য অনুযায়ী ডায়াবেটিস আক্রান্ত নারীদের গর্ভধারণের চেষ্টার সময় থেকে গর্ভধারণের পর ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রতিদিন অন্তত ৫ মিলিগ্রাম ফলিক এসিড ট্যাবলেট খাওয়া উচিত। এর ফলে জন্মগ্রহণের সময় শিশুর বিভিন্ন রকম জটিলতা তৈরি হয় না। জেস্টেশনাল বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস

অনেকসময় গর্ভধারণের আগে ডায়াবেটিস না থাকলেও গর্ভধারণের পর নারীদের অনেকে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হতে পারে। অনেকসময় গর্ভাবস্থায় রক্তে শর্করার হার বেড়ে যায় এবং সন্তান প্রসবের পর তা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে, এটিকেই গর্ভকালীন বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলে। গর্ভাবস্থায় শরীর অতিরিক্ত চাহিদা অনুযায়ী অতিরিক্ত ইনসুলিন - যে উপাদান রক্তে শর্করার হার নিয়ন্ত্রণ করে - তৈরি করত না পারায় এই লক্ষণ দেখা দেয়।

গর্ভাবস্থায় যে কোনো সময়ে এটি দেখা গেলেও গর্ভধারণ করার প্রথম তিনমাস অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে এই ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অধিকাংশ সময়ই সন্তান প্রসবের পর এই ধরণের ডায়াবেটিসের লক্ষণ থাকে না।

ওয়ার্ল্ড ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ৮ থেকে ১৩ শতাংশ নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের লক্ষণ:
জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট লক্ষণ নেই। কিছু নারীর রক্তে শর্করার হার অতিরিক্ত বেড়ে গেলে কয়েকটি লক্ষণ দেখা যেতে পারে।

>তৃষ্ণা বেড়ে যাওয়া
>সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি মাত্রায় প্রস্রাবের বেগ পাওয়া
>ঘন ঘন মুখ শুকিয়ে যাওয়া
>দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যাওয়া

তবে গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেও এরকম লক্ষণ দেখা যেতে পারে। কাজেই গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

কারা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে থাকেন:
গর্ভাবস্থায় কিছু নারীর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
>যেসব নারী স্থূলতায় (অতিরিক্ত ওজনজনিত সমস্যা) ভোগেন।
>এর আগে সাড়ে ৪ কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের সন্তান প্রসব করে থাকলে।
>এর আগের সন্তান প্রসবের সময় জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস হয়ে থাকলে।
>বাবা-মা বা ভাই-বোনদের মধ্যে কোনো একজনের ডায়াবেটিস থাকলে।

যেভাবে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস গর্ভাবস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে:
>গর্ভে শিশুর আকৃতি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হতে পারে। এর ফলে সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা তৈরি হতে পারে।
>পলিহাইড্রামনিওস বা গর্ভের ভেতরে শিশুকে ঘিরে অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড তৈরি হতে পারে যার ফলে সময়ের আগেই প্রসববেদনা শুরু হওয়া এবং প্রসবের সময় জটিলতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা।
>প্রিম্যাচিউর বার্থ - অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের আগেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে পারে।
>প্রি এক্ল্যাম্পসিয়া - এর ফলে গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং গর্ভধারণে জটিলতাও দেখা দিতে পারে।
>জন্মগ্রহণের পর শিশুর রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যাওয়া ও চোখ এবং চামড়া হলুদাভ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মৃত সন্তান প্রসব করার মত সমস্যাও তৈরি হতে পারে।
>এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বিভিন্ন রকম সমস্যা তৈরি করতে পারে। পরবর্তীতে আবারো গর্ভধারণের সময়ও এই ধরণের ডায়াবেটিস হতে পারে।
>অনেকক্ষেত্রে রোগীর স্থায়ীভাবে টাইপ টু ডায়াবেটিসও হতে পারে।

যা করণীয়:
অধ্যাপক হাজেরা মাহাতাবের মতে পরিবারের সদস্যদের কেউ যদি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে এই জাতীয় ডায়াবেটিস সম্পর্কে আগে থেকে সচেতন হওয়া জরুরি। ‘গর্ভধারণের আগে থেকেই জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এটি যদি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে তাহলে দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে।’

তবে এই ধরণের ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে যদি গর্ভাবস্থায় সমস্যা তৈরি হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত খাবার গ্রহণ এবং নিয়মমাফিক হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করা উচিত বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক মাহতাব।

এমএস/এসি