ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লবন-পেঁয়াজের উত্তাপ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:২১ এএম, ২০ নভেম্বর ২০১৯ বুধবার

‘কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে’- কবির এ কবিতার লাইন যেনো আবারও সত্যি প্রমাণিত হলো। কান হারানোর সংবাদে কানে হাত না দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের চিলের পেছনে ভোঁ দৌঁড় দেওয়ার দৃশ্য দেখেছে বিশ্ববাসী।

পেঁয়াজ নিয়ে কেলেঙ্কারি দূর না হতেই দেশে হঠাৎ লবণ নিয়ে ঘটে গেলো লঙ্কাকাণ্ড। গুজবের এই তেলেসমাতিতে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, শিক্ষিত ও সচেতন মানুষরাও সামিল হয়েছে। গ্রামে গ্রামে প্রচার করতে শোনা গেছে লবন সঙ্কটের কথা।

‘চাচী তাড়াতাড়ি বাজার থেকে লবণ আনো। কাল থেকে ২’শ টাকা কেজি হবে, আমরা ৫ কেজি এনেছি। আম্মার কাছে টাকা নাই আব্বা আসলে আরও আনব।’ এভাবেই গ্রামের প্রতিবেশির ঘরে গিয়ে লবণ কেনার জন্য প্রচার করা হয়। মূহুর্তে মানুষের মুখে মুখে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সয়লাব হয়ে যায় ‘বৃদ্ধি পেয়েছে লবণের দাম’। যে লবনের খুচরা মূল্য ৩০ টাকা কেজি, তা কয়েক মিনিটে ৪০, ৫০ এবং শেষ পর্যন্ত ১৫০ টাকায় পৌঁছে যায়।

লবণের মূল্য আগামীকাল ২০০ টাকায় পৌঁছাবে এমন গুজব শুনে বাজারে দৌড়াতে থাকেন শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। তারা ৫ থেকে ১০ কেজি যার যা সামর্থ আছে সর্বোচ্চ কেনার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে দেশব্যাপী অনেক ব্যবসায়ী লবণ মজুদ করতে শুরু করেন আরও দাম বৃদ্ধির আশায়।

শুরুর দিকে সিলেটে এমন একটি ঘটনা গত পরশু শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহারে গুজব ছড়িয়ে যায় সর্বত্র।

পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সোচ্চার হয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। দেশের কোথাও লবণের অতিরিক্ত দাম চাইলে জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ এ কল দিয়ে তা জানানোর আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স।

এদিকে গুজব ছড়িয়ে অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রির অভিযোগে সারাদেশে এ পর্যন্ত ১৩৩ জনকে আটক করা হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে অনেক অসাধু ব্যবসায়ীকে। ফলে সবাই বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে বিষয়টি আসলেই গুজব।

পেঁয়াজ ও লবনের এই তেলেসমাতিতে সরব সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারিরা। কেউ কেউ এ ইস্যুকে সামনে রেখে ব্যঙ্গাত্মক ভিডিও (টিকটক) তৈরি করছেন। কেউ বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। কেউ আবার প্রতিবাদ করছেন।

লবন নিয়ে কেউ লিখেছেন, ‘লবন ছাড়াও তো রান্না করা যায়। আমি কিন্তু লবন ছাড়া ২২ রকমের রান্না পারি।’

কেউ লিখেছেন, ‘পেয়াজ, রসুন, লবন, আদা, তুই খাস কেন রে গাঁধা? পেয়াজ ছাড়া কি তরকারি, সুস্বাদু লাগে না ভারী?’

আবার কেউ লিখেছেন, ‘এদেশে লবন ও ভাইরাল হয়...।’

কেউ লিখেছেন, ‘গুজব থাকে রাজপ্রাসাদে/গুজব ঘুমায় পাড়ায়। গুজব থাকে অনলাইনে/রুমকী ভাবীর বাসায়। গুজব থাকে সিন্ডিকেটে/পেঁয়াজ, লবন জুড়ে। গুজব গুলো গজব হয়ে/মধ্যবিত্ত পুড়ে।’

বিষয়টি নিয়ে পণ্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ‘স্বপ্ন’ তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তারা লিখেছেন-
‘আজ সকাল থেকে আমাদের বেশ কিছু আউটলেটে ক্রেতাদের একটি অংশ অস্বাভাবিক পরিমাণে লবন ক্রয় করছিলেন এবং এটি আমাদের দৃষ্টি-গোচর হবার পর আমরা ব্যাপারটি নিয়ে অনুসন্ধান করি। তখন কয়েকজন ক্রেতা আমাদের জানান যে, তারা এমন একটি গুজব শুনেছেন যে লবণের মজুদ নিয়ে ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং খুব দ্রুত মূল্য বৃদ্ধি হতে পারে। এরপর আমরা প্রস্তুতকারক এবং পরিবেশকদের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি যে এটা নিছক গুজব, লবণের স্বাভাবিক যোগান অব্যাহত রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, ক্রেতাদের একটা বড় অংশের স্বাভাবিক চেয়ে বেশি পরিমাণে লবণ কেনার কারণে আজ সন্ধার ভেতরেই আমাদের অনেকগুলো আউটলেটে স্টক শ্যূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, আর ঠিক সেই মুহুর্তে কিছু সংখ্যক ক্রেতা লবণ কিনতে এসে বেশ কিছু আউটলেটে লবণ পান নি।

যে সমস্ত ক্রেতা এই মুহূর্তে লবণ কিনতে এসে লবণ পাননি, তাদেরকে জানানো হচ্ছে আগামীকাল স্বপ্ন-এর সব আউটলেটে আবার লবণ পাওয়া যাবে। একই সাথে কাষ্টমারদের অনুরোধ করা যাচ্ছে যে আপনাদের কন্টাক্ট নাম্বার আমাদের আউটলেট ম্যানেজারকে দিন অথবা আমাদেরকে ইনবক্সে প্রদান করুন- স্বপ্ন আপনাদের বাসায় ছাড়কৃত মূল্যে লবণ হোম ডেলিভারি দেবার ব্যবস্থা করবে!

স্বপ্ন আবারো তার ক্রেতাদের কোন ধরণের গুজবে কর্নপাত না করতে অনুরোধ করছে।’

কেরানিগঞ্জ জিনজিরা এলাকার এক খুচরা ব্যবসায়ি বলেন, ‘ভাই যেখানে মাসে এক বস্তা লবন বিক্রি করতে পারিনা, সেখানে মাত্র ১০ মিনিটে চার বস্তা লবন বিক্রি করে ফেলেছি। আমি পূর্বের দামেই বিক্রি করেছি। তাই আমার লবন মূহুর্তেই শেষ হয়ে যায়।’

এদিকে এক বিজ্ঞপ্তিতে শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে সাড়ে ছয় লাখ টনের বেশি ভোজ্য লবণ মজুত রয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের লবণ চাষিদের কাছে চার লাখ ৫ হাজার টন এবং বিভিন্ন লবণ মিলের গুদামে দুই লাখ ৪৫ হাজার টন লবণ মজুত রয়েছে। তারপরও একটি স্বার্থান্বেষী মহল লবণের সংকট রয়েছে মর্মে গুজব রটনা করে অধিক মুনাফা লাভের আশায় অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য আহ্বান শিল্প মন্ত্রণালয়ের।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পেঁয়াজের পর এবার লবণ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়াচ্ছে অসাধু ও কুচক্রী একটি মহল। দেশে কোথাও লবণের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণ লবণ মজুত আছে। চক্রান্তকারীরা চালের দামও বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, যারা সংকট সৃষ্টি করছে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। গুজব ছড়িয়ে লবণের দাম বৃদ্ধির চক্রান্তকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

এসএ/