ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মুহাম্মদ (সা.) ’র একনিষ্ঠ সহচর আবু বকর সিদ্দিক (রা.)

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:২২ পিএম, ২০ নভেম্বর ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ০১:২৪ পিএম, ২০ নভেম্বর ২০১৯ বুধবার

তিনি ‘সিদ্দিক’। তিনি ‘বিশ্বস্ত’। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ (সা:) এর প্রধান সাহাবি, ইসলামের প্রথম খলিফা এবং প্রথম মুসলিমদের মধ্যে অন্যতম। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণের সম্মান তাকেই দেওয়া হয়। এছাড়া তিনি রাসুল মুহাম্মদ (সা:) এর শ্বশুর ছিলেন। রাসুল মুহাম্মদ (সা:) এর মৃত্যুর পর তিনি খলিফা হন এবং মুসলিমদের নেতৃত্ব দেন। যিনি আর কেউ নন, আবু বকর সিদ্দিক (রা.)।

রাসুল (সা.)-এর জন্মের দুই বছরের কিছু সময় পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং অনুরূপ সময়ের ব্যবধানে তারা উভয়ে ইন্তেকাল করেন। তাই মৃত্যুকালে আবু বকরের বয়স হয়েছিল রাসুল (সা.)-এর বয়সের সমান।

আবু বকর (রা.)-এর আসল নাম আব্দুল্লাহ বিন আবু কুহাফা। তার উপাধি ছিল ‘সিদ্দিক’। মিরাজের ঘটনাকে সর্বপ্রথম মনেপ্রাণে  বিশ্বাস করেছিলেন বলেই রাসুল (সা.) তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন।

হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছিলেন, ‘আমার উম্মতের মাঝে আবু বকরই সবচেয়ে বেশি দয়ালু।’ নবী করিম (সা.) আরও বলেন, ‘বন্ধুত্ব ও সাহায্য আবু বকরই আমাকে বেশি করেছিলেন। ইহজগতে যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে আবু বকরকেই করতাম।’

ছোটবেলায় আবু বকর অন্যান্য আরব শিশুদের মতো বেদুইনদের মাঝে খেলা করতেন উট নিয়ে। উট খুবই পছন্দ করতেন তিনি। ছাগল আর উটের বাচ্চা নিয়ে তার অতিরিক্ত ভালোবাসার জন্য লোকে তার নাম দেয় ‘আবু বকর’, যার অর্থ উটের বাচ্চার বাবা।

আবু বকর ছিলেন উজ্জ্বল গৌরবর্ণ ও পাতলা ছিপছিপে। তার ছিল প্রশস্ত ললাট। শেষ বয়সে চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। মেহেদির খিজাব লাগাতেন। যতটুকু হাত দেখা যেত তাতে লোম চোখে পড়ত না।

তিনি ছিলেন সম্মানিত কুরাইশ ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও সৎ চরিত্রের জন্য মক্কার সব মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তিনি। আরববাসীর নসব বা বংশসংক্রান্ত জ্ঞানে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ। কাব্য প্রতিভাও ছিল তার। ছিলেন অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী।

হযরত মুহম্মদ (সা.)-কে সবসময় তিনি ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশায়, সহায়-সম্বলহীনতায় এবং দুস্থদের সাহায্য করতে তিনি ছিলেন নিবেদিত। ইসলাম গ্রহণ করার সময় তার কাছে সঞ্চিত ৪০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ইসলামের কল্যাণে তিনি রাসুলুল্লাহর কাছে প্রদান করেন।

তরুণ বয়সে আবু বকর (রাঃ) একজন বণিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। তিনি প্রতিবেশী সিরিয়া, ইয়েমেন ও অন্যান্য অঞ্চলে ব্যবসার কারনে ভ্রমণ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি সম্পদশালী হয়ে উঠেন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি তার গোত্রের একজন নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ইয়েমেন থেকে বাণিজ্য শেষে ফেরার পর তিনি মুহাম্মদ (সা.) এর ইসলাম প্রচারের সংবাদ পান। এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণ অন্য অনেকের ইসলাম গ্রহণের উৎসাহ যুগিয়েছে। আবু বকরের (রাঃ) মেয়ে আয়িশার সঙ্গে মুহাম্মদ (সা.) এর বিয়ের ফলে তাদের দুজনের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে।

আবু বকর (রা.) একজন একনিষ্ঠ সহচর হিসেবে মুহাম্মদ (সা.) এর সহযোগিতা করেছেন। তার জীবদ্দশায় আবু বকর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আবু বকরের (রা.) খিলাফত দুই বছরের কিছু বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান। তার খিলাফতকাল দীর্ঘ না হলেও তিনি একজন সফল শাসক ছিলেন। মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পর নবী দাবি করা ব্যক্তিদের তিনি রিদ্দার যুদ্ধে সফলভাবে দমন করেছেন এবং তৎকালীন দুটি পরাশক্তি পারস্য ও বাইজেন্টাইনদের উপর সফল অভিযান পরিচালনা করেছেন।

কুরআনে আবু বকরকে ‘গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। হিজরতের সময় মুহাম্মদ (সা.) এর সঙ্গে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেয়ার কারণে এভাবে সম্বোধন করা হয়েছে।

হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। মুহাজির ও আনসাররা নিজেদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচনের পক্ষে ছিল। কিছু গোত্র পুরনো প্রথা অনুযায়ী, গোত্রভিত্তিক নেতৃত্ব ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়। আনসাররা সাকিফা নামক স্থানে একত্রিত হয়ে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। এরপর আবু বকর, উমর ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ ওই আলোচনা সভায় গিয়ে হাজির হন। সভার আলোচনায় এক পর্যায়ে উমর ইবনুল খাত্তাব আবু বকরের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহও তার অনুসরণ করেন। এরপর বাকিরাও আবু বকরকে নেতা হিসেবে মেনে নেন। সুন্নিরা তাকে ‘খলিফাতুর রাসুল’ বা  ‘আল্লাহর রাসুলের উত্তরাধিকারী’ বলে সম্মান করে থাকে। যদিও শিয়ারা আবু বকরকে বৈধ খলিফা বলে স্বীকার করে না। শিয়া মতাদর্শ অনুযায়ী, আলি ইবনে আবু তালিবই প্রথম খলিফা হিসেবে যোগ্য।

খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর হযরত আবু বকর (রা.) তার প্রথম ভাষণে বলেন, ‘আমি আপনাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ নই। আপনাদের সকলের সাহায্য ও পরামর্শ আমার কাম্য। আমি ন্যায় ও সত্যের পথে থাকলে আপনারা আমাকে সমর্থন করবেন। বিপথগামী হলে আমাকে উপদেশ দেবেন। আমি বরণ করব সত্য, বর্জন করব মিথ্যা। আমার চোখে ধনী-নির্ধন, সবল-দুর্বল সকলেই সমান। আপনারা আমাকে ততক্ষণ মেনে চলবেন, যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তার রাসুলকে মেনে চলব। অন্যথায় আপনাদের নেতা হওয়ার আমার কোনো অধিকারই নেই।’

হযরত আবু বকর (রাঃ) পক্ষকাল অসুস্থ্য থাকার পর ৬৩৪ খ্রীস্টাব্দের ২৩ অগাস্ট পরলোকগমন করেন। তিনি ছিলেন সেই দশ আশীর্বাদপুষ্টদের একজন যাঁদেরকে মহানবী (সাঃ) সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে তাঁদের জান্নাতে ভূষিত করা হবে।

আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মদিনার একটি বাগানে রাসুল (সা.) এর সঙ্গে ছিলাম। এক ব্যক্তি এসে দরজায় করাঘাত করল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তার জন্য দরজা খুলে দাও এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও।’ আমি দরজা খুলে দেখলাম, তিনি আবু বকর (রা.)। আমি তাকে রাসুল (সা.) এর ফরমান অনুসারে জান্নাতের সুসংবাদ দিলাম। তখন তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করলেন। (বোখারি : ৩৪৯০)।

এক নজরে আবু বকর (রা.) :
পূর্ণ নাম : আবদুল্লাহ বিন আবি কুহাফা (আবু বকর নামে পরিচিত)
উপনাম : খলিফাতুর রাসুল, সিদ্দিক।
জন্মগ্রহণ : অক্টোবর ৫৭৩ সালের দিকে, মক্কার কোরাইশ বংশের ‘বনু তাইম’ গোত্রে।
জন্মস্থান : মক্কা, আরব উপদ্বীপ।
পিতার নাম : উসমান আবু কুহাফা।
মাতার নাম : সালমা উম্মুল খাইর।
ইসলাম গ্রহণ : আবু বকর (রা.) সম্পর্কে বলা হয়েছে, অন্য সবার ইসলাম গ্রহণের আগে কিছু মাত্রায় দ্বিধা ছিল; কিন্তু আবু বকর (রা.) বিনা দ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ করেন।

ইসলামে তার কিছু অবদান :

(ক) আবু বকর (রা.) ছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর  প্রধান সাহাবি।

(খ) ইসলামের প্রথম খলিফা।

(গ) প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণের সম্মান তাকে দেয়া হয়।

(ঘ) এছাড়া তিনি রাসুল (সা.) এর শ্বশুর ছিলেন। রাসুল (সা.) এর ইন্তেকালের পর তিনি খলিফা হিসেবে নিযুক্ত হন এবং মুসলিমদের নেতৃত্ব দেন।

(ঙ) পবিত্র কোরআনে (সূরা তওবা, আয়াত নং : ৪০) আবু বকর (রা.) কে ‘গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। হিজরতের সময় রাসুল (সা.) এর সঙ্গে আত্মরক্ষার্থে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেয়ার কারণে এভাবে সম্বোধন করা হয়েছে।

(চ) আবু বকর (রা.) মিরাজের ঘটনা শোনামাত্রই বিশ্বাস করেছিলেন বলে তাকে রাসুল (সা.) ‘সিদ্দিক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তাই তাকে আবু বকর সিদ্দিক নামে সম্বোধন করা হয়।

(ছ) আবু বকর (রা.) একজন একনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে রাসুল (সা.) এর সহযোগিতা করেছেন।

(জ) রাসুল (সা.) এর জীবদ্দশায় আবু বকর (রা.) বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

(ঞ) তাবুকের যুদ্ধে তিনি তার সব সম্পদ দান করে দেন।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার ওপর কারও এমন অনুগ্রহ নেই, যার বিনিময় আমি দেইনি। তবে শুধু আবু বকর ছাড়া। আমার প্রতি তার এত অনুগ্রহ, যার বিনিময় আল্লাহ তায়ালা কেয়ামত দিবসে দেবেন। কারও সম্পদ কখনও আমাকে এত ফায়দা দেয়নি, যতটুকু দিয়েছে আবু বকর (রা.) এর সম্পদ।’ (তিরমিজি : ৩৬৬১)।

শাসনকাল : ৮ জুন ৬৩২ থেকে ২২ আগস্ট ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ।
ইন্তেকাল : ২২ আগস্ট ৬৩৪ (৬১ বছর)।
কবর : রাসুল (সা.) এর একই সমাধিতে পাশাপাশি কবর। মসজিদে নববি, মদিনা, সৌদি আরব।

সূত্র : বিভিন্ন ইসলামী পুস্তক, ওলামাদের লেখা ও ইন্টারনেট।
এসএ/