ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এক স্বপ্নবাজ নগরপিতা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৪২ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০১৯ শনিবার

তার স্বপ্নের মোহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যেন সচেতন হয়েছেন নগরের সব নাগরিক। নগর জীবনে একটু প্রশান্তি, একটু সহজ করতে তিনি কাজ করে গেছেন ক্রমাগত। নিয়েছেন নানা উদ্যোগ। অনিয়মের বিরুদ্ধে হয়েছে পাহাড়ের মতো দৃঢ়। তারুণ্যের উদ্দীপনায় কাজ করেছেন তিনি। তিনি এক স্বপ্নবাজ নগরপিতা প্রয়াত আনিসুল হক। ২০১৭ সালের আজকের এ দিনে (৩০ নভেম্বর) ইহলোক ত্যাগ করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনর (ডিএনসিসি) এ মেয়র। 

বর্ণাঢ্য জীবন ছিল আনিসুল হকের। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলের মেয়র নির্বাচনে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। পূর্বে রাজনীতির খাতায় নাম না লেখানো এ নেতা মেয়র পদে অধিষ্ঠ হয়ে বিভিন্ন জনমুখি পদক্ষেপ নেন। রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও পরিশুদ্ধ নগরী গড়ে তুলতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোচিত ও প্রশংসিত হন তিনি। 

মেয়রের দায়িত্ব নিয়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের সামনের সড়ক দখলমুক্ত করতে গিয়ে বিক্ষুব্ধ চালকদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। পরে তার নেতৃত্বে ডিএনসিসি ঐ সড়ক দখলমুক্ত করে। বছরের পর বছর অবৈধ ট্রাক স্টান্ডের কাছে জিম্মি এলাকাটি উদ্ধারে তার পদক্ষেপে দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা পায়। 

ঢাকার আকাশ, সে যেন নগরবাসীর কাছে এক অবরুদ্ধ বস্তুর নাম। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই তিনি ঢাকা শহর থেকে সব বিলবোর্ড উচ্ছেদ করেন, যা নগরবাসীর কাছে ছিল অবিশ্বাস্য।

শ্যামলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবহনের যানবাহনে রাস্তা দখল ছিল। ফলে দীর্ঘসময় যানজটে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হতো। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তিনি শ্যামলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত রাস্তা গতিময় করে তোলেন। দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করেন নগরীর পার্কগুলো। পথচারী নাগরিকদের জন্য নগরীজুড়ে নির্মাণ করেন আধুনিক টয়লেট।

গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় বিশেষ রঙের রিকশা এবং ‘ঢাকা চাকা’ নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সেবা চালু করেন মেয়র আনিসুল হক। বিমানবন্দর সড়কে যানজট কমাতে মহাখালী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে ইউলুপ করার উদ্যোগ নেন আনিসুল হক। 

এছাড়াও ঢাকার খালগুলো উদ্ধারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তার নির্দেশে বনানীর ২৭ নম্বরে যুদ্ধাপরাধী মোনায়েম খানের বাড়ি ‘বাগ এ মোনয়েম’র অবৈধ দখলে থাকা অংশ উদ্ধার করে সড়ক প্রশস্ত করা হয়।

২০১৭ সালের ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবারে লন্ডনে যান আনিসুল হক। সেখানে তিনি সেরিব্রাল ভাসকুলাইটিসে (মস্তিষ্কের রক্তনালির প্রদাহ) আক্রান্ত হন। ১৩ আগস্ট তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান স্বপ্নবাজ এ মেয়র।

আশির দশকে আনিসুল হক বাংলাদেশ টেলিভিশনে জনপ্রিয় উপস্থাপক হিসেবে পরিচিতি পান। তাঁর উপস্থাপনায় বিটিভির ঈদের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ‘আনন্দমেলা’, রাজনীতিবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘মুখোমুখি’সহ বেশ কিছু অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। টেলিভিশন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎকার নিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন।

১৯৮৬ সালে তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মোহাম্মদী গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন আনিসুল হক। তার স্ত্রী রুবানা হক মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বড় ছেলে নাভিদুল হক দেশ এনার্জি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এক মেয়ে ওয়ামিক উমায়রা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওতে কর্মরত এবং আরেক মেয়ে তানিশা ফারিয়াম্যান হক মোহাম্মদী গ্রুপের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। মেয়র হওয়ার আগে ব্যবসায়ী হিসেবে তিনিই মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন।

১৯৫২ সালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন ক্ষণজন্মা এ নেতা। তবে তার শৈশবের একটি বড় সময় কাটে ফেনীর সোনাগাজীর নানাবাড়িতে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর ছোট ভাই জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান। 

২০০৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিজিএমইএ’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আনিসুল। ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিআইপিপিএ’রও সভাপতি ছিলেন।

এমএস/