ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

কবিতার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর মাহবুবুল হক শাকিল

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:২৯ পিএম, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯ শুক্রবার

‘তুমি চলে গেলে মন পুড়ে যায়, পুড়ে যায় বন
পুড়ে যায় প্রজাপতি, ঘাস, উড়ে যায় বাউল বাতাস
পুড়ে যায় স্বপ্নচুম্বী জয়রথ, রয়ে যায় বিষণ্ন বিলাপ।’

                 [অন্য পাড়ায় বাড়ি, (মন খারাপের গাড়ি)]

প্রত্যেক কবির কবিতায় একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর থাকে, আর সেই কবি যদি হন বড় মাপের কবি তাহলে তার সেই স্বাতন্ত্র্য বুঝে নিতে সচেতন পাঠক বা সমালোচকের কোনোই অসুবিধা হয় না। মাহবুবুল হক শাকিল ছিলেন তেমনই। যিনি আধুনিক কবিতার এক নিপুণ কারিগর ছিলেন।

শাকিল কবিতা লেখেন পরিণত শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে, কিন্তু তিনি রাজনীতির সাথে পারিবারিকসূত্রে জড়িয়ে আছেন সেই বাল্যকাল থেকেই; রাজনীতির ঘোরটোপে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে শাকিলের কবি পরিচয় অনেককাল লুকিয়ে ছিলো বাঙলা কবিতার পাঠকদের কাছে; কবি পরিচয়ের বাইরে রাজনীতিক হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। শাকিলের খুব কাছের মানুষ ছাড়া তেমন কেউ জানতেন না তার কবিতাচর্চার কথা। আসলে কবিতা হচ্ছে ছাইচাপা তুষের আগুনের মতো। কারো কারো ক্ষেত্রে আগ্নেয়গিরির আগুনের মতো; জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ করেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। শাকিলের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে।

তার কবিতার হাত ছিল এক কথায় অসাধারণ। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫ সালের ৬ষ্ঠ দিন অন্বেষা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় মাহবুবুল হক শাকিলের কবিতার বই ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’। রাজনীতিক থেকে কবি বনে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলের ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’ কবিতার বইটি ছিল এক অনন্য সৃষ্টি।

তার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’ ছাড়াও ‘মন খারাপের গাড়ী’ ও ‘জলে খুঁজি ধাতব মুদ্রা’ বেশ প্রশংসিত হয়েছে। মাহবুবুল হক শাকিল অনেককাল আগে থেকেই নিভৃতে কবিতা লিখতেন। কিন্তু গ্রন্থভুক্ত কবি হিসেবে তার সরব উপস্থিতি চলে যাওয়ার অল্প কিছু বছর আগে। প্রকাশিত কবিতা বোদ্ধা মহলে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হিসেবে কাজ করেছে। তিনি সকলের কাছে একজন রাজনীতিকের পাশাপাশি কবি হিসেবেও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন।

তার কবিতায় যেমন ছিল প্রেম, আবেগ তেমনি ছিল রাজনীতির ছোঁয়া। তিনি লিখেছিলেন-

‘রোদ ছিল না এক রত্তি, আকাশজুড়ে কান্না
গ্রিক পুরাণের পাখির মতো আপনি ফিরে এলেন
নির্বাসনের অশ্রু পেরিয়ে, পিতার শ্যামল মাটিতে।

তেরো শত নদীজুড়ে বয়ে গেল স্রোত
                        ধানশালিকের উদ্দাম ওড়াউড়ি।’

              [শেখ হাসিনা, আপনি এলেন (মন খারাপের গাড়ি)]

প্রকৃতপক্ষে কবি হিসেবে মাহবুবুল হক শাকিলের গ্রন্থভুক্ত উত্তরণ অনেককেই বিস্মিত করে। তিনি পরিণত বয়সে তার কবিতার গ্রন্থভুক্ত প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আসলে রাজনীতির পাশাপাশি যখন একজন কবি কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন তিনি অন্য কবিদের থেকে অনেক বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে ওঠেন। কবিরা যা দেখেন কল্পনায়, রাজনীতিবিদ তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকেন বলেই কল্পনা ও বাস্তবের মিশেলে একটি ঘনঘোর আবহ সৃষ্টি করে কবিতা লেখেন।

‘খুব বেশি দেখতে নেই ভালোবাসা, জানতে নেই কত বেশি
জীবনের ভুল। মাঝরাতে খুঁজে ফিরি ভুল কবিতা, বিষণ্ন অনুবাদ
মন খারাপের গাড়ি অভিমানের এভিনিউয়ে খুঁজে ফেরে দূর সমুদ্দুর।’

                     [মন খারাপের গাড়ি, (মন খারাপের গাড়ি)]

‘মরে যাওয়া মানুষ তুমি আর কতদূর যাবে?
খাটিয়ার গতি কি ছুঁতে পারে জীবনের সাম্পান?’

                       [অগস্ত্য যাত্রা, (মন খারাপের গাড়ি)]

‘জুড়ে থাকে ভালোবাসা, অভিশাপ, বিষাদ,
মৃত্যু এবং প্রেমের রাত, স্বপ্ন-টলোমল করিডর
জুড়ে চান্দের সাম্পান, অপবাদের নষ্ট জল।’

                   [ভালোবাসার সাদাবাড়ি, (মন খারাপের গাড়ি)]

এই ধরনের কবিতা লিখতে গিয়ে কবি হিসেবে রাজনীতিক শাকিলের তেমন কোনো দ্বৈরথ তৈরি হয়নি। তার আত্মদর্শন কিংবা তার তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় সাধন করে তিনি কবিতাকে একটি গভীর ও গূঢ়তর সৃষ্টিশীলতার মধ্যে সাঙ্গীকৃত করতে পেরেছেন, কবি হিসেবে এখানেই তার ভিন্নতা এবং সার্থকতা।

কবিতা লেখার সময় আধুনিক কবিতার যে দাবি, তা পুরণের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার সাথে এগিয়েছেন তিনি। সেটি চেতনার দিক থেকে যেমন সত্য, ঠিক তেমনি অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও সত্য। শাকিল খুব সতর্কভাবে বাঙলা কবিতার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে পরিভ্রমণ করেছেন।

যদিও শাকিলকে বলতে শোনা গেছে,-

‘সেই অর্থে আমি কবি নই। নিজের ভাবনাগুলো কেবল বাণীবদ্ধ বা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। আমার চেষ্টা তখনই সফল হবে যখন পাঠক আমার লেখা সানন্দে গ্রহণ করবেন।’

যতটুকু জানা গেছে, প্রতি রাতেই মাহবুবুল হক শাকিল কবিতা লিখতেন। আর সকালে সেগুলো গুছিয়ে রাখতেন সহধর্মিনী নীলুফার আনজুম। প্রিয় মানুষটি আজ নেই। কিন্তু তার স্মৃতি এখনও রয়ে গেছে।

মৃত্যু দুই মাস পর প্রকাশ পায় শাকিলের শেষ কাব্যগ্রন্থ- ‘জলে খুঁজি ধাতব মুদ্রা’। এর প্রকাশনা উৎসবে এসে কবি পত্নি মাইক্রোফোন হাতে বলেন, ‘ভালবাসার মানুষ হারায় না। আমি মনে করি, আমি যেমন সৃষ্টিকর্তাকে ভালবাসি, কিন্তু তাঁকে দেখতে পাই না। তেমনি খুব কাছের মানুষ, ভালবাসার জন কবি মাহবুবুল হক শাকিল আমার প্রতিটি সত্ত্বায় থাকবে, যতদিন আমি বেঁচে থাকব।’

তবে এটি বলতে হবে যে- শাকিলের কবিতাকে বুঝতে গেলে ব্যক্তি শাকিলকেও বোঝার দরকার আছে। শাকিলের ‘মন খারাপের গাড়ি’তে বিস্মিত হয়েছেন অনেকেই। কারণ তিনি তার কবিতার পরিণতির জন্য যেই কয়টি অনিবার্য সত্য পুরণ করা জরুরি, তা খুব সাহসের সঙ্গে পুরণ করার চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে কবিতার রহস্যময়তা, দর্শন, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, মিথ ও পুরাণের নিপুন এবং যথাযথ ব্যবহার কখনো কখনো তার কবিতাকে শক্তিশালী সৃষ্টি হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে।

এসএ/