ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পটুয়াখালিতে আধাপাকা আমন ধানে ‘শীষকাটা লেদা’র আক্রমণ

এমএ বশার, বাউফল (পটুয়াখালি) সংবাদদাতা

প্রকাশিত : ০৩:৩৪ পিএম, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯ রবিবার

‘বুলবুলে ফুল ঝড়ানে চিডা অইয়া গ্যাছে, এ্যাহন কনি কনি ছড়া কাইট্টা ধান ঝড়াইয়া হালায় ধানকাডা পোকায়। আধগানি জমিনে কোম অইলেও ৮০ মোন ধান পাইতাম। এ্যাহন ২০ মোন অইলেও অইতে পারে!’ নিজ আমন ক্ষেতে পোকার আক্রমণে এমন হতাশার কথা জানালেন কৃষাণী পারুল বেগম। পাশের কয়েকজন শ্রমিক দিয়ে বিরি-৪০ জাতের আধা-পাকা ধানকাটার তদারকি করছেন। একই সঙ্গে শীষকাটা লেদা পোকায় ক্ষেতে ঝড়ানো ধান কুড়াচ্ছিলেন ছোট ঝুড়িতে।  

সম্প্রতি প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ঝড়ে ব্যাপক ক্ষমির মুখে পড়ে পটুয়াখালির বাউফলের নানা জাতের ধানের ক্ষেত। আধা পাকা ধানে শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমণে অন্যান্য ক্ষেতের মধ্যে পারুলের একমাত্র সম্বল ক্ষেতটিও পড়ে যায়। পাশের ক্ষেতে ধান কাটছিলেন সুলতানাবাদ গ্রামের মোসলেম দেওয়ান ও দক্ষিণ সুলতানাবাদ গ্রামের হারুন বিশ্বাস এবং সেরাজ মাতবর। 

উপযুক্ত সময়ে পনের দিন আগেই ধান কাটতে হচ্ছে তাদের। শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমণ থেকে সামান্য রেহাই পেতে ধান পরিপক্ক হওয়ার আগেই তাদের এ আয়োজন। 

বিশাল বিশাল মাঠ জুড়ে চোখ জুড়ানো সোনালী-হলুদাভাব ধান। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতের পরে কীটনাশকেও ভাল ফল না পাওয়ায় এবার শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমণে দিশেহারা হয়েছেন কৃষকরা।

হারুন রাঢ়ী, শাহআলম, আহেদ রাঢ়ী, আলতু রাঢ়ী, রাজ্জাক, আলাউদ্দিন, বড়ডালিমা গ্রামের জাহাঙ্গির মৃধা, তালতলী গ্রামের ছোবহান হাওলাদার, ভরিপাশা গ্রামের সেলিম গাজীও নেমেছেন ধান কাটতে। শুধু ধানদী-সুলতানাবাদ গ্রামই নয় তাঁতেরকাঠি, কেশবপুর, ভরিপাশা, নওমালা, শৌলা, বীরপাশা, কনকদিয়া, দাশপাড়াসহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ও বিচ্ছিন্ন চন্দদ্বীপের কৃষকদের সঙ্গে কথা বললে তারাও ধানে পোকা আক্রমনের কথা জানান। 

পারুল বেগম অনেকটা হতাশা প্রকাশ জানান, প্রায় দেড় যুগ আগে তার স্বামী পরলোকগ গমন করেছেন। নিজের সন্তান ও নাতিদের মুখে অন্ন’র সংস্থান হয় এ ক্ষেতকে কেন্দ্র করে। আরও পনের দিন পর ধান কাটতে পারলে লোকসান হতো না। এখন এ ধানে তার সাড়ে সাত হাজার টাকার বেশি আসবে না। 

তবে বিশ্ব ব্যাপি আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন কৃষকরা। আবহাওয়া ও কৃষি অধিদফতরের দায়িত্বশীলতা এবং কার্যকরী প্রশিক্ষণ পোকা দমনে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 

এদিকে, পোকায় আক্রমণের ফলে ক্ষেতের ধানের নির্ধারিত ক্ষতির পরিমাণের চেয়ে বেশি হবে বলে মনে করেন কৃষকরা। সুলতানাবাদ গ্রামের মোসলেম দেওয়ান বলেন, বাজারের ওষুধেও কোন কাজ হচ্ছে না করছে না। দিনের বেলায় লেদা পোকা ধানের গোছার গোড়ায় লুকিয়ে থাকে আর রাতে শীষ কাটে। পোকারা ধান খায় না। তবে শীষ ও শীষের কানা কেটে ধান ঝড়িয়ে দেয়। ফাজিলপুর গ্রামের মোতাহার আকন জানান, এবার পোকার আক্রমণ ছাড়াও আমন মৌসুমের শুরুতেই ধানের বাজার দরেও কৃষকরা হতাশ। 

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তর ধানের হাট কালাইয়ায় গত সপ্তাহে আগাম জাতের ইরি ধান চার থেকে সাড়ে চার শত এবং শাইল ধান সাড়ে পাঁচ শত টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। প্রতিমন ধান ৬৫০ টাকা হিসেবে ৫০মন ধানের বায়না করেও হাটে দাম না ওঠায় স্থানীয় একজন ধান ও বায়নার টাকা ফেরত না নিয়েও ক্ষতি এড়াতে ধান নেননি। 

ধানে পোকার এ আক্রমণের বিষয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, আবহায়ার বিরুপ প্রভাবে অসময়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিপাত, রোদ, তাপমাত্রা, শীত, গাছের শক্তিমত্তা এসব কারণে বংশবৃদ্ধি ঘটে পোকার আক্রমন হতে পারে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এমন বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল হয়ে প্রশিক্ষণ ও তদারকির উপর গুরুত্বের কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক। 

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানটমোলজি বিভাগের অধ্যাপক  ড. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে এ ধরণের অবস্থা প্রায়ই হয়ে থাকে। ১০-১২ বছর আগে একবার পাতা মোড়ানো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল। শীষ যখন বের হয়ে আসে তখন শীষ কাটা লেদা পোকা অক্রমণ করে। এই পোকা এক ধরণের মথ। মথগুলো এক একটি ২০০-৩০০ ডিম দেয়। আর মাত্র এক জোড়া মথই একটি ফসলের জমি ধ্বংস করতে যথেষ্ট।

বাউফল উপজেলা কৃষি অফিসার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, উপজেলায় মোট ৩৬ হাজার ১৯০ হেক্টর জমি আমন চাষের আওতায় এসেছে।  এবার শীষকাটা লেদা পোকার অক্রমণে উচু জমির আমনের ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের লোকজন লিফলেট বিতরণসহ মাঠে কৃষকদের সচেতন করে নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। 

পোকার আক্রমণে শতকরা এক থেকে দুই ভাগ ক্ষতি হতে পারে বলে জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, এ উপজেলা থেকে এবার এক হাজার ৪০ টাকা মন হিসেবে (২৬ টাকা কেজি) ২৫৬৪ মেট্টিকটন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চার হাজার কৃষকের তালিকা তৈরী করা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন।

এমএস/