ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

১৪তম ‘বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতামালা’ অনুষ্ঠিত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:২২ পিএম, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯ রবিবার

বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. পবিত্র সরকার

বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. পবিত্র সরকার

‘বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতামালা’ আয়োজনের ধারাবাহিকতায় রোববার (৮ ডিসেম্বর) সকাল ১১টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার স্টুডিও থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিত হল এর ১৪তম স্মারক বক্তৃতা।

এবারের আয়োজনে স্মারকবক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. পবিত্র সরকার এবং নাট্য সমালোচক ও সংস্কৃতিবিদ জনাব অংশুমান ভৌমিক। আয়োজনে বক্তারা বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন। 

এ সময় দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, সচিব বদরুল আনম ভূইয়াসহ অনেক সুধীজন।

এতে ‘একাত্তরের কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর ডাক’ শিরোনামে বক্তব্য উপস্থাপন করেন- নাট্য সমালোচক ও সংস্কৃতিবিদ অংশুমান ভৌমিক। তিনি বলেন, ডাক’র অনেক মানে। ডাক'র দৌলতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের খবর উড়ে এসেছে কলকাতায়। মণীন্দ্র রায়ের চিঠি বই হয়ে বেরিয়েছে। বেরিয়েছে জাহানারা ইমামের না পাঠানো চিঠি। কত একাত্তরের চিঠি এখনও অ-গ্রন্থিত। 

তিনি আরও বলেন, তেমনি আরেক ডাক হলো আহ্বান। তেমনি এক ডাক হলো- বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো। এই ডাক শুনতে শুনতে ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু পূর্ব বাংলায় নয়, পশ্চিম বাংলাতেও এই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন সংস্কৃতিকর্মীরা। যতীন সরকার যথার্থেই লিখেছিলেন-পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ছিল আবেগাপ্লুত সহমর্মিতা। সে সহমর্মিতার মূল উৎস ছিল বাঙালিত্ব। বাঙালিদের একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হবে, বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, সব কাজকর্ম হবে বাংলায়। 

অংশুমান ভৌমিক বলেন, আবহমান বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক সেই রাষ্ট্রটি। এরকম একটি সম্ভাবনা সকল বাঙালির বুকে শিহরণ জাগাতো। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগের একটি খন্ডচিত্র আঁকা আছে জন্মসূত্রে বরিশালের সন্তান ও কর্মসূত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের একটি বিখ্যাত গদ্যরচনায়। এটি আদতে পনেরো মিনিটের একটি ভাষণ, যুদ্ধপরিস্থিতি প্রবল হয়ে ওঠার পরপরই আকাশবাণী কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত। পরে চতুঙ্গ পত্রিকায় প্রকাশিত। কবি লিখেছেন- জসীম উদদীন থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান পর্যন্ত কবিরা এখন কোথায়, এই মুহুর্তে? ইয়াহিয়ার সৈন্যরা নাকি গুড়িয়ে দিয়েছে ইত্তেফাকের অফিস, ধ্বংস করেছে তার সাংবাদিক কর্মিদের? তা হলে আল মাহমুদ? কোথায়? কোথায় এখন তিনি? বোমায় বিধ্বস্ত রংপুর। কায়সুল হক? ঢাকার জসীমউদদীন রোডেও কি ঢুকেছিল ইয়াহিয়ার ট্যাঙ্ক? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আজ পনেরো দিনের পুরোনো হলো, এর মধ্যে আমরা জেনেছি কিভাবে সামরিক অত্যাচার প্রথমেই ছুটে যাচ্ছে যে কোনও বুদ্ধিজীবীর দিকে। 

তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার দল ঠিকই বুঝতে পারে যে, এইখান থেকেই জেগে উঠেছে অবিশ্বাস্য এই মুক্তিবাসনার প্রথম আগুন। আমাদের মনে থাকবে যে, ২৫ মার্চের পর থেকে ক্রমান্বয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসা শরণার্থীদের ঢল নেমেছিল। তাদের সকল ব্যবস্থার জন্য সরকারি তরফসহ স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগও সামিল হয়েছিল। সহায়তার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে বেশ কয়েকটি সংগঠন তৈরী হয়েছিল। ২৭ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের অধিবেশনে বাংলাদেশের জন্য গঠনমূলক উদ্যোগ নেবার সিদ্ধান্ত হয়। দেখাদেখি ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও নাগরিক উদ্যোগ শুরু হয়। ২১ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভারতের অন্যান্য সব রাজ্যকে পূর্ব বাংলার জনগণের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এম-এল) এর মুখপত্র গণশক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ট সহযোগ ছিল অনীকের। বলাই বাহুল্য যে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে তারা নিপাতনে সিদ্ধ বলে মেনে নেননি। ১৯৭১ এ মে মাসে প্রকাশিত অনীকের পূর্ব বাংলা প্রসঙ্গে শীর্ষক বিশেষ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, দালালরা ইতিহাস তৈরী করে না, ইতিহাস তৈরী করেনি বিপ্লবী জনতা। পূর্ব বাংলার ৭ কোটি মেহনতি জনতাকে শোষণ ও শাসন করার অধিকার নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের পশ্চিম পাকিস্তানি ও পূর্ব বঙ্গীয় দালালদের মধ্যে চলেছে যে কুকুর-কামড়া কামড়ি প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধ, তার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী জনতাই গড়ে তুলবেন বিপ্লবী যুদ্ধ, শোষণ থেকে চিরমুক্তির যুদ্ধ।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. পবিত্র সরকারের বক্তব্যে উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যেভাবে সাধারণ মানুষ জেগে উঠেছিল সেই চিত্র।

তিনি বলেন, চোখে না দেখেও যাকে নেতা হিসেবে বুকে ঠাই দেয়া যায়, যার ডাকে সাড়া দেয়া যায় সেই নেতাই হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে আমরা ছোটখাটো কয়েকজন মিলে কিছু কাজ করেছিলাম। আমি তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। তখন ওই বিশাল মানুষটির ছায়া আমাদের প্রেরণা দিয়েছে। ১৯৬৯ সালে ফুলব্রাইট বৃত্তি পেয়ে আমি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাই। পড়াশুনার পাশাপাশি অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে যাই পূর্ব বাংলার পত্রপত্রিকা ও বইপত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে বাংলা বাইয়ের সংগ্রহ ছিল এমন যে অন্য কোথাও ছিল কিনা সন্দেহ। দুই বাংলার বই ছিল লাইব্রেরীতে এবং বাংলা ও ইরেজী পত্রিকা। সেগুলো পুরোনো হলে তারা একটি আলমারীতে সংরক্ষণ করতো। সেখান থেকেই সব খবর জানতে পারতাম। 

তিনি আরও বলেন, ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ১৯৫২-১৯৫৪ সালের নির্বাচন, আইয়ুব খান, রাশা, রবীন্দ্র শতবার্ষিকী তা থেকে ১৯৬৬, ছয়দফা এই খবরগুলো আমরা রাখছি। কিন্তু বয়স কম ছিল বলে আমরা তখন বুঝতে পারি নাই যে, এই খবরগুলো কোথায় গিয়ে পৌঁছবে। পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের কাছে যখন খবর পৌঁছলো বাংলায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ছয়দফা থেকেই আমাদের অনুমান করা উচিত ছিল। ১৯৬৯ এ একটি বিষয় আমি লক্ষ্য করি যে, ইয়াহিয়া খান ৫টি বই নিষিদ্ধ করেন। সবগুলো বইয়ের নাম আমার এখন মনে নেই। এর মধ্যে ছিল জেলের ৩০ বছর, হাল ছেড়ো না এবং আব্দুল মান্নানের একটি বইয়ের কথা। সব বইগুলোই শিকাগো গ্রন্থকেন্দ্রে পাওয়া গেছে। বাংলার প্রেক্ষাপটে এই বইগুলো পড়ে আমরা উদ্বুদ্ধ হতাম। বর্তমান বাংলাদেশ পৃথিবীর ছোট্ট একটি দেশ যেখানের মানুষ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার দিকে এগুচ্ছিলো। শিকাগোতে ১৯৭০ সাথে একটি সম্মেলন হয়েছিল বাংলা নিয়ে, মনে হচ্চিল পুরো সম্মেলনটাই বাংলার। আমরা কেই বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি কিন্তু তার জেনে তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম। আমরা তখন শিকাগোতে বসবাসকারী কয়েকজন মিলে একটি সংগঠন করেছিলাম। সংগঠনের ডাক দিতাম ডিনার ডেকে। কারণ ওখানে ডিনারে খুব প্রচলন। এছাড়াও অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে। 

পবিত্র সরকার বলেন, এভাবে প্রায় ১০ হাজার ডলার তুললাম। যে অর্থ দিয়ে পরবর্তী বাংলার মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্ত্র, রাবারের নৌকা এবং ডুবরীদের জন্য পোষাক কিনে পাঠিয়েছি। যুদ্ধের জন্য জীবন দিতে পারিনাই কিন্তু চেষ্টা করেছি কিছু একটা করার জন্য। হিন্দু-মুসলমান মিলে যে একযোগে মাঠে নেমে আসা যায় তা বুঝতে পারছি বঙ্গবন্ধুর মত নেতার ডাকের মাধ্যমে।

এনএস/