ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ইতিহাসে ঢুকে গেল গাম্বিয়া-আবুবকর

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:৪০ পিএম, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ বৃহস্পতিবার

মিয়ানমারে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মুখে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ওই ঘটনার দুই বছরের বেশি সময় পর গত ১১ নভেম্বর অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনের (ওআইসি) সমর্থনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ দায়ের করে গাম্বিয়া।

দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া এই মামলার শুনানি আজ বৃহস্পতিবার শেষ দিন। 

আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করতে পারত অনেক দেশই। কিন্তু সবাই যখন আহা-উহু করে, নিন্দা জানিয়ে বিষয়টি পার করে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই গণহত্যার মামলা করে গাম্বিয়া সবাইকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করল।

মিয়ানমারে বিরুদ্ধে মামলার মূল উদ্যোক্তা হচ্ছেন গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারবিষয়ক মন্ত্রী আবুবকর তামবাদু। আন্তর্জাতিক আদালতে রায় কী হবে, সেটা পরের বিষয়। কিন্তু গণহত্যার মামলা হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারকে গণহত্যাকারী বলা যাবে। আবুবকর প্রমাণ করে দিলেন, একজন ব্যক্তিই ইতিহাসে ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন।

গাম্বিয়া পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্র এক দেশ। তিন দিকে সেনেগাল দিয়ে ঘেরা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গাম্বিয়ার কোনও প্রভাবের কথা তেমন শোনা যায় না। এমনকি ওআইসিতেও গাম্বিয়াকে বড় ধরনের শক্তি হিসেবে কেউ বিবেচনা করে না। তবে গাম্বিয়া মানবিকতার দিক থেকে এখন শীর্ষেই থাকবে বলে মত বিশ্লেকদের।

গত বছর ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ঢাকা বৈঠকে গাম্বিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে না পাঠিয়ে শেষ মুহূর্তে বিচারবিষয়ক মন্ত্রী আবুবকর তামবাদুকে পাঠায়। আবুবকর ওআইসির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে গিয়ে গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবুবকর জানান, রোহিঙ্গাদের প্রতিটি কথায় গণহত্যার কাহিনি লেখা আছে। আমি এখানে রুয়ান্ডার গণহত্যার সঙ্গে মিল খুঁজে পাই।

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার জন্য আবুবকর ওইআইসিতে প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং এই বছর ওআইসিকে মামলায় সহযোগিতা করতে সম্মত করেন। এভাবেই আবুবকর পশ্চিম আফ্রিকার এক ক্ষুদ্র দেশ গাম্বিয়াকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সামনে নিয়ে আসেন।

যুক্তরাজ্যে আইন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে গত শতকের শেষ দিকে গাম্বিয়া ফিরে আইন পেশায় যোগ দেন আবুবকর। ২০০০ সালে একটি ঘটনা আবুবকরের চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ওই বছর ১৪ জন শিক্ষার্থীকে রাজপথে হত্যা করে সরকারি বাহিনী। এরপরই আবুবকর মানবাধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০০৩ সালে জাতিসংঘে যোগ দিয়ে তানজানিয়ায় রুয়ান্ডা গণহত্যার বিচারে কৌঁসুলি হিসেবে অংশ নেন। বলা হয়ে থাকে, আবুবকরের কৌশলী ও দৃঢ় ভূমিকার কারণে সাবেক সেনাপ্রধান আউগুস্টিন বিজিমুনিগোর ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয়।

তবে গত তিন বছরে অনেকটাই বদলে গেছে গাম্বিয়া। ২২ বছরের শাসনামলে গাম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া জামেহ বিরোধীমত দমন করে এক ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন। হত্যা, গুম, আটক করে নির্যাতন নিত্যকার ঘটনা ছিল গাম্বিয়াবাসীর জীবনে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে আদম ব্যারো প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া জামেহকে পরাজিত করেন। এরপরই গাম্বিয়ার পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। পরবর্তীকালে নতুন সরকার ট্রুথ কমিশন গঠন করলে ইয়াহইয়ার আমলের অনেক কুকীর্তি বেরিয়ে আসে। ইয়াহইয়ার দুঃশাসনই গাম্বিয়াকে মানবতার পক্ষে লড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে গণমাধ্যমকে আবুবকর জানান। আর রুয়ান্ডা গণহত্যা বিচারের অভিজ্ঞতা আবুবকরকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করতে সাহস জুগিয়েছে।

জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন অনুসারেই একটি দেশ আরেকটি দেশের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করতে পারে।

শেষ পর্যন্ত মামলার ফলাফল যা-ই হোক, ইতিহাস তাদের মনে রাখবে এই কারণে যে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা পরিচালনার আর্থিক সক্ষমতা না থাকার পরও রোহিঙ্গাদের রক্ষায় আবুবকর নামের এক আইনজীবী তার দেশ গাম্বিয়াকে নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। কাজেই গাম্বিয়া ও আবুবকর তামবাদু উভয়েই ইতিহাসে পাতায় ঢুকে গেলেন।

একে//