ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পুতিনের দুই দশক 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:১৪ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ রবিবার

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতার ২০ বছর পূর্ণ করবেন ৩১ ডিসেম্বর। লেনিনগ্রাদের জন্মগ্রহণকারী ক্ষমতাধর এই শাসক গত দুই দশক ধরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এই দীর্ঘ সময়ে অর্থনীতিতে যেমন সমৃদ্ধি এনেছেন, তেমনি যুদ্ধ বিগ্রহেও জড়িয়েছেন। আবার অলিম্পিক থেকে শুরু করে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরও বসিয়েছেন দেশটিতে। 

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির একজন এজেন্ট ছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুতিন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে রুশ প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করায় তাঁর এই দায়িত্বভার গ্রহণ। তিনি যখন রাশিয়ার হাল ধরেন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন।

পুতিনের ক্ষমতার এই ২০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিন প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটেনের পাঁচ প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করেছেন। কিন্তু তিনি থেকে গেছেন রাশিয়ার ক্ষমতার মসনদে।

২০০০ সালে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন। তারপর ২০০৪ সালের নির্বাচনে পুতিন দ্বিতীয় মেয়াদে পুণরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। তার এ মেয়াদ শেষ হয় ২০০৮ সালের ৭ মে। কিন্তু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে পুতিন ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।

পরবর্তীতে ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে দিমিত্রি মেদভেদেভ বিজয় লাভ করেন। আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দিমিত্রি মেদভেদেভ রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেন ভ্লাদিমির পুতিনকে। কিন্তু অনেকে মনে করেন, মেদভেদেভ ছিলেন পুতিনের হাতের পুতুল।

অতঃপর ২০১১ সালে পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন যে, তিনি তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
করবেন। ২০১২ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় বারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পুতিন। তাঁর এই ৬
বছরের মেয়াদকাল শেষ হতে চলেছে।

কেজিবির সাবেক এ কর্মকর্তা ১৯৯৯ সালে যখন ক্ষমতাসীন হলেন তখন দ্বিতীয়বারের মতো চেচনিয়া যুদ্ধ শুরু হয়। কিছু অ্যাপার্টমেন্টে বোমা হামলার জবাবে সে অভিযান শুরু করে রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের সূচনা হয়েছিল রাশিয়ারদক্ষিণাঞ্চলের অস্থির সংঘাতের মধ্য দিয়ে।

তখন চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনি অবরোধ করে রাখে রাশিয়ার সৈন্যরা। ২০০৩ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে গ্রোজনিকে বিশ্বের সবচেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ২০০৯ সাল পর্যন্ত চেচনিয়াতে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।

এরপর কয়েক বছর ধরে জঙ্গি হামলায় আক্রান্ত হয় রাশিয়া। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ২০০৪ সালে বেসলান স্কুলে হামলা, সেখানে ৩৩০ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল শিশু।

২০০০ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন পুতিন। এর কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি ইমেজ সংকটে পড়েন। কার্স্ক সাবমেরিন বিপর্যয়ে ১১৮ জন নাবিক মারা যায়। ২০০০ সালের অগাস্ট মাসে যখন কার্স্ক সাবমেরিন বিপর্যয় ঘটে তখন নিহত নাবিকদের পরিবারকে বিষয়টি অবহিত করা হয়নি। বেশ কয়েকদিন পর বিষয়টি জানানো হয়।

তখন পুতিন অবকাশ যাপনে কৃষ্ণ সাগরে ছিলেন। কিন্তু সাবমেরিন বিপর্যয়ের পর তিনি অবকাশ যাপন থেকে ফিরে আসেননি। যা নিয়ে দেশটিতে সমালোচনা হয়েছিল।

ক্ষমতার প্রথম দশকে পুতিনের সঙ্গে পশ্চিমা নেতাদের সম্পর্ক ভালোই ছিল। ২০০৬ সালে রাশিয়া প্রথমবারের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ‘জি এইট’ সম্মেলনের আয়োজন করে। এর মাধ্যমে ওই জোটে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তিও ঘটে।

জর্জিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সাউথ ওশেটিয়া অঞ্চলের কর্তৃত্ব ফিরে পাবার জন্য ২০০৮ সালে জর্জিয়া যখন সেখানে সৈন্য পাঠায়, তখন রাশিয়া জর্জিয়ার ভেতরে আক্রমণ করে। স্বল্প সময়ের এই যুদ্ধ ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য পুতিন সরকারের একটি সতর্কবার্তা। 

২০১৪ সালে রাশিয়া যখন পূর্ব ইউক্রেন আক্রমণ করে তখন পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেবার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপ করে। এছাড়া শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংগঠন ‘জি এইট’ থেকে রাশিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করা হয়।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার চার বছর পরে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে রক্ষার জন্য রাশিয়া যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। তখন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ প্রায় পতনের মুখে চলে ছিল। সিরিয়াতে রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান এবং সরঞ্জাম পাঠানোর কারণে সেখানকার ভারসাম্য অনেকটাই বদলে যায়। এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আসাদ টিকে আছেন সিরিয়ায়।

২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করার পর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বলতে থাকে, এই নির্বাচনে রাশিয়া হস্তক্ষেপ ছিল।

২০১৮ সালে রাশিয়ার সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সার্গেই স্ক্রিপালকে ব্রিটেনের মাটিতে বিষ প্রয়োগে হত্যার ঘটায় রাশিয়াকে অভিযুক্ত করে ব্রিটেন।

ক্ষমতায় থাকার পুরো সময় জুড়ে পুতিন তার নিজের এবং দেশের ইমেজ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নিজের কিছু ছবি দিয়ে
প্রচারণার মাধ্যমে পুতিন নিজেকে একজন শক্তিমান ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ২০১৪ সালে শীতকালীন অলিম্পিক এবং ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের মাধ্যমে পুতিন ক্রীড়াঙ্গনে রাশিয়ার ভালো অবস্থান তুলে ধরতে চেয়েছেন। অনেকটা সফলও হয়েছিলেন এ বছর। 

যদিও ডোপ কেলেঙ্কারির জন্য গত সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি-ডোপিং এজেন্সি বা ওয়াডা রাশিয়াকে চার বছরের জন্য খেলাধুলার বড় আসরগুলোতে নিষিদ্ধ করেছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ডোপিং-এর অভিযোগ ওঠে ২০১৫ সালে। সে বছরের নভেম্বরে রাশিয়ার অ্যান্টি ডোপিং সংস্থা
‘রুসাডা’ মাদক বন্ধে সহযোগিতা করছে না বলে ঘোষণা করে ওয়াডা। সংস্থার এক রিপোর্টে তখন বলা হয়েছিল, রাশিয়ায়
সরকারি মদদেই ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলেটিক্সে ব্যাপকভাবে মাদক ব্যবহৃত হচ্ছে।

ওয়াডা থেকে অভিযোগ ওঠে, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার যেসব তথ্য হস্তান্তর করেছিল রাশিয়া, তাতে
কারসাজি করা হয়। তাই ডোপিং কেলেঙ্কারির জন্য ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকস এবং ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলে রাশিয়া অংশ নিতে পারবে না।

ব্যক্তিগত জীবনে পুতিন বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনাম হয়েছেন। খবর রয়েছে, দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবন ভেঙ্গে দিয়েছেন প্রেমে পড়ার কারণে। ১৯৮৩ সালে বিয়ে করা লিদমিলা শ্রেবনেভার সংসারে পুতিনের দুই মেয়ে রয়েছে। 

এএইচ/