ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪,   বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

যেখানেই ব্যর্থ হয়েছে সিটি কর্পোরেশন সেখানে সফল সোসাইটি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:২৩ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ বৃহস্পতিবার

রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন বেশিরভাগ এলাকায় ব্যাপক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চোখে পড়লেও ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় হাতে গোনা কয়েকটি সোসাইটিতে।

বিশেষ করে গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরার মতো কয়েকটি সোসাইটিতে গেলে দেখা যায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে, ড্রেনেজ সিস্টেম এমনকি যান চলাচল সব কিছুতেই রয়েছে একটি আধুনিক নগরের শৃঙ্খলার ছাপ। কারণ, সেখানকার সার্বিক ব্যবস্থাপনা দেখভাল করছে স্থানীয় কমিউনিটির লোকজন। খবর বিবিসি’র।

বেহাল দশা সিটি কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রিত এলাকায়:
ঢাকাকে একটি আধুনিক রূপ দিতে ২০১১ সালে সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করে শহর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপরও দুই সিটি কর্পোরেশন তাদের আওতাধীন এলাকাগুলোয় এমন সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি। এর প্রমাণ দেখা যায়, ঢাকার মগবাজারের রেললাইন সংলগ্ন এলাকা পার হয়ে রামপুরা, বনশ্রী এবং মেরাদিয়ার বেশ কয়েকটি স্থানে। সেখানে চোখে পড়ে কিছুদূর পর পর পড়ে আছে আবর্জনার স্তূপ। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। এবং খোলা ড্রেনের দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বনশ্রী সি ব্লকের কাছে একটি স্কুলের পাশেই চোখে পড়ে ময়লার ভাগাড়, সেখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা যত্রতত্রভাবে পাশের লেকে ময়লা ফেলছেন। 

সিটি কর্পোরেশনকে প্রতিমাসে টাকা দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে হতাশ এই এলাকার বাসিন্দা মৌটুসি রহমান বলেন, ‘যখন ওই লেকের পাশ দিয়ে আসি দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপর রাত হলে মশার তাণ্ডব। এই যে রাস্তার পাশে ময়লা ফেলে রেখেছে, এগুলো পরিষ্কারের নাম নেই। পানি জমে মশা হচ্ছে, দেখার কেউ নেই। আমরা কিন্তু এই সার্ভিসগুলোর জন্য প্রতিমাসে টাকা দিচ্ছি। কিন্তু কোন সেবা পাচ্ছি না।’

সোসাইটিগুলো সফল কেন?
অথচ পুরো ভিন্ন চিত্র রামপুরা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে গুলশান, নিকেতন, বনানী, বারিধারা ও বসুন্ধরা এলাকায়। এই এলাকাগুলো জনবহুল হওয়া সত্ত্বেও রাস্তাঘাটে কোন আবর্জনা নেই। সবখানেই ছিমছাম পরিবেশ। এর একটাই কারণ এই প্রতিটি এলাকা তাদের নিজস্ব কমিউনিটির উদ্যোগে এই কাজগুলো করিয়ে থাকেন। এজন্য তারা স্থানীয়দের থেকে চাঁদা ও দানের মাধ্যমে বাড়তি জনবল নিয়োগ দিয়ে থাকেন যেমন কমিউনিটি নিজস্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ট্রাফিক পুলিশ, পাহারাদার। 

যেসব ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের সহায়তার প্রয়োজন হয় সেখানে এই সোসাইটি তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে কাজ আদায় করে থাকে বলে জানান গুলশান সোসাইটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান সদস্য শিরিন শিলা। তিনি বলেন, ‘আমরা সোসাইটির পক্ষ থেকে মূল যে কাজটি করি সেটা হচ্ছে আমরা কর্তৃপক্ষের ওপর প্রেশার ক্রিয়েট করি, যে আমার এই এরিয়ার জন্য এই জিনিসটা চাই। এটা হাজার জন হাজারভাবে বলে লাভ নেই। এটা সমন্বিতভাবে চাপ দিলেই আদায় করা যাবে। আমরা আমাদের চাওয়াগুলো গুছিয়ে নিয়ে সিটি কর্পোরেশনকে বলি, বোঝাই এবং আদায় করি। এটাই সোসাইটির শক্তি।’

সিটি মেয়র কী বলছেন?
যেখানে একটি কমিউনিটির লোকজন একটি আদর্শ নাগরিক জীবনের সেবাগুলো নিশ্চিত করতে পারছে সেখানে স্থানীয় সরকার সংস্থা হিসেবে সিটি কর্পোরেশন কেন একক প্রচেষ্টায় তা পারছে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র সাইদ খোকনের কাছে এমন প্রশ্ন রাখলে তিনি প্রথমেই তাদের স্বীকার করে নেন যে সিটি কর্পোরেশনের যথেষ্ট কাজে ঘাটতি রয়েছে। তবে এর পেছনে জন সচেতনতার অভাব সেইসঙ্গে জনবল সংকটের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজের দুর্বলতা যে নেই তা আমি বলবো না। তবে সিটি কর্পোরেশন তার চাহিদার মাত্র ৩৮% জনবল নিয়ে কাজ করছে। তবে জনবল যদি শতভাগও হয় তাও এই সুশৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না। যতক্ষণ না নাগরিকরা আমাদের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এই কমিউনিটিগুলো সফল কারণ তারা আমাদের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে।’

সিটি কর্পোরেশন থেকে সোসাইটির মতো সেবা পাওয়া সম্ভব কীভাবে?
নগরে শৃঙ্খলা ফেরাতে যে বড় বড় সোসাইটির মাধ্যমেই কাজ করতে হবে, বিষয়টি এমন নয় বলে জানান নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান। তিনি মনে করেন প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনের অধীনে যে ওয়ার্ড কাউন্সিলগুলো রয়েছে সেগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।

মেয়রকে সকল ক্ষমতার কেন্দ্র না বানিয়ে দায়িত্ব ছড়িয়ে দিতে হবে এবং ওয়ার্ডগুলোর জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। এতে ওই ওয়ার্ড কাউন্সিলগুলো, সোসাইটির চাইতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে জানান তিনি। আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনকে শতভাগ কার্যকর বানানো সম্ভব দুইভাবে, প্রথমত এর অধীনে যে নির্বাচনগুলো হয় সেটার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যেন জনগণ তার আস্থাভাজন প্রতিনিধিকে বেছে নিতে পারে, যারা তাদের দুর্দশার অংশীদার হবে। এরপর যারা ক্ষমতায় আসবেন তাদের কাজ হল সিটি কর্পোরেশনকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে রেখে দল, মত নির্বিশেষে জনগণকে সম্পৃক্ত করা।’

আর জনগণকে সম্পৃক্ত করার কাজটি করবে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। তারা জনগণের চাওয়া পাওয়ার কথা মেয়রকে জানাবেন। মেয়র তাদের বাজেট দেবেন। সে অনুযায়ী কাজ হবে। এখানে মেয়রকে ক্ষমতার কেন্দ্র না বানিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা খুব জরুরি বলে মনে করেন তিনি। সারাবিশ্বে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা যেভাবে জনগণের সাথে সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করে থাকে সিটি কর্পোরেশনের সেদিকে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বলে মত এই নগর পরিকল্পনাবিদের।

এমএস/এসি