ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আমার কবিতা ও কবিতা ভাবনা

ড. রকিবুল হাসান

প্রকাশিত : ০৮:৫১ পিএম, ৩ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:০০ পিএম, ৩ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার

১. 
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিশীলতা, সমসাময়িক ঘটনা, নারী নির্যাতন, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনাসহ চিরায়ত কিছু বিষয় আমার কবিতায় থাকে। আমার কবিতায় এসব নিয়েই গল্প লুকিয়ে থাকে। এসব গল্পে আমার নিজস্ব আবিষ্কৃত শব্দের বেশি ব্যবহার থাকে। শব্দচয়ন, গতি ও অলঙ্কার প্রয়োগে আমি গ্রামীণমুখী। তবে শহরকে একেবারে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়। গ্রামীণ আর শহুরে জীবন থেকে অব্যহৃত শব্দ খুঁটে খুঁটে বের করে কবিতায় ব্যবহার করি। অলঙ্কারের ক্ষেত্রেও তাই। কবিতায় সবসময় আমি একটা গল্প বলতে চাই, তা হোক যতো ক্ষুদ্র। আর সেটাকে অনেক যত্ন করে চিত্রময় রূপ দিয়ে ফ্রেমে বাঁধাই করি। এতে করে একটা পূর্ণ বার্তা পাঠকের কাছে পৌছানোর প্রয়াস থাকে। সেই বার্তাটা আলো আঁধারের রহস্যের মতো নয়। এ জায়গাটিতে আমার কবিতা আলোর মতো স্পষ্ট করে তুলতে চেষ্টা করি। দূর্বোধ্য ও দূরূহতা থেকে আমি কবিতাকে দূরে রাখতে পছন্দ করি। কবিতা লেখার সময় আমার কান গভীরভাবে নিবিষ্ট থাকে নদীর স্রোতের কাছে। নদীর মিষ্টি অথবা শাণিত এমনকি বিক্ষুব্ধ স্রোতটা আমি শব্দে গেঁথে নিতে চেষ্টা করি। কবিতা আমার কাছে দূর্দান্ত গতিশীল একটি ব্যাপার-অবাধ্য স্রোতের মতোই অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটে চলা-এই ছুটে চলার ভেতর জীবন থাকে-সাহস থাকে-বিপ্লব থাকে-সুর থাকে-ছন্দ থাকে-ভাঙা-গড়ার আনন্দ-বেদনা-বোধের গভীরতা থাকে।

২.
কোনো কিছু লেখার আগে তা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে-তাকে কিভাবে ধরবো-সেটা একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমি তাতে সম্পূর্ণ নিমগ্ন হওয়ার চেষ্টা করি। বলতে পারি ধ্যানী হয়ে উঠি। কখনো তা ধরতে পারি-কখনো পারি না। যা বলতে চেয়েছি তা যদি শব্দ ছন্দ মাত্রা গতি সবকিছুর সমন্বয়ে শৈল্পিক করে স্পষ্ট করে বলতে পারি, ভালো লাগে-স্বস্তি অনুভব করি। কিন্তু সবসময় তা পারি না। পারা যায় না। তখন এক অস্বস্তি ও যন্ত্রণা আমাকে ভীষণভাবে তাড়া করে ফেরে। অন্য আর কিছুতে মন বসাতে পারি নে। অধরা কবিতা আমার ভেতর বিক্ষুব্ধ ঝড়ের মতো হয়ে ওঠে। ভেতরে ভেতরে আমি বিধ্বস্ত হতে থাকি। হতে পারে এ আমার অপারগতা। আমার মাথার ভেতর কবিতা হয়ে উঠবে বলে যা কিছু ঘুরপাক খায়-তা আমার সব সময় ধরা হয়ে ওঠে না। এটা খুব যন্ত্রণার। আবার অনেক সময় যুতসই শব্দ না পেলে কবিতাকে কবিতা মনে হয় না। শব্দের ব্যবহারের উপর কবিতার গতি অনেকখানি নির্ভর করে। গতিই তো কবিতা। ফলে একটা ভালো কবিতা হয়ে উঠতে গতির ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে। গতির সাথে ছন্দ মাত্রা অলঙ্কার-এসবের সফল সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ। কোনোটার একটু এদিক ওদিক ঘটলেই দূর্দান্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনাময় কবিতারও অপমৃত্যু ঘটে যায়। আমার কাছে কবিতা পুরো সাধনার মতো। ফলে কবিতা আমার কাছে সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়। নিজের ভেতর-বাইরের আপন-প্রকাশ। আত্মাই যদি হয় আমার সর্বস্ব বা আমার সত্তাই যদি হই আমি- তাহলে আমার কবিতা তো আমিই। হয়তো সেটা সব সময়ই এই সত্য পুরোটা ধারণ করে না। বিষয় এখানে বড় একটা ভ’মিকা রাখে। আয়নার সামনে নিজেকে যেভাবে দেখা যায়, কবিতায় সেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়-ভাবের ভেতর দিয়েই নিজেকে কবিতায় স্থাপন করতে হয়। আর এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। ফলে আগের কবিতা আর পরের কবিতা এর মধ্যে অনেক পার্থক্য ঘটে যায়। নিজেকে নিজের চিন্তাকে- নিজের ভাবকে-নিজের প্রেমকে সার্বজনীন করে তুলতে পারাটা একজন কবির বড় শক্তি। এটা আমাকে ভাবায়। কবিতাকে সহজ সাবলীল এবং বোধগম্য করে রাখতেই আমার বেশি পছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। জটিল বৃত্তে বন্দি করে আলোছায়ার ভেতর কবিতাকে আটকাতে ইচ্ছে করে না। আর এটা যেনো নিজেকেই অস্বচ্ছ ও অন্ধকারে রেখে দেয়া- ফলে যে বার্তাটি পাঠকের কাছে দিতে চাই, তা অধরাই থেকে যায়। এটা অনেক সময় নিজেকে প্রকাশের ক্ষেত্রে হয়-নিজেকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেও খানিকটা সরিয়ে রাখার মতো ব্যাপার। আমি যে এটা থেকে আমার কবিতাকে পুরোপুরি মুক্ত রাখতে পারি, তাও নয়। আমার কিছু কবিতার ভেতরও রহস্যময়তা আছে। দেশ-কাল-রাজনীতি অনেক সময় আলোছায়ার একটা রহস্য কবিতার মধ্যে গেঁথে দিতে হয়। রহস্যের আশ্রয় নিতে হয়-সত্যভাষণ গভীরে রাখতে হয়-সমুদ্রের গভীরতার মতো।  

৩.
কবিতায় নানামাত্রিক বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। জীবনেরও নানা বাঁক থাকে। নদীরও তাই। চর্যাপদ থেকে এই সময়কালে কবিতা নদীর মতো বহু পথ ঘুরেছে-বহু বাঁক খেয়েছে-বহু রূপ পরিবর্তন করেছে-বহু রূপ ধরেছে। গভীরতা ও অর্থবহতাও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা পেয়েছে। ফলে সময়ের সিঁড়ি ধরে কবিতায় নতুন নানা বিষয় যুক্ত হয়েছে। অন্তর্জগত আর বহির্জগত সবই কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। অন্তরের আত্ম-সাধনা, প্রেমের একান্তু বেদনা, খাঁটুনি শ্রমিকজীবন আর ধর্ষিতা নারীর যন্ত্রণা অপমান, রাজনীতির শুদ্ধতা অশুদ্ধতা সবই কবিতার বিষয়। একসময় প্রেম আর ধর্মচেতনাতেই বন্দি ছিলো কবিতা। কবিতা সে সীমাবদ্ধতার প্রাচীর ভেঙে জীবন-সমাজ-রাষ্ট্রের অলিগলিতে অবাধে ঢুকে পড়েছে। আন্তর্জাতিক আবহ কবিতা এখন ধারণ করে। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে দেশ আর বিদেশ সবই কবির জানার ভেতরে চলে এসেছে। কবিতাও তা ধারণ করছে। ফলে কবিতা সীমানার কাঁটাতার ভেঙে বিশ্বের হয়ে উঠছে। তেমনি নিজের কবিতা নিজের কাছেও নানারকম বাঁক নেয়। নিজেকেই নিজের অতিক্রম করতে হয়। নিজেকেই নিজের বৃত্ত ভাঙতে হয়। তা না হলে কবিতা নিজের কাছেই গতি হারায়। আমি চেষ্টা করি আমার কবিতায় প্রতিনিয়ত এই পরিবর্তন আনতে বা বাঁক খেলার খেলাটা খেলতে। নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে বিশ্বায়ন কবিতায় ধরার চেষ্টা থাকে আমার। নিম্নে আমার কয়েকটি কবিতা প্রসঙ্গত উল্লেখ্য:

একটু ভালোবাসলে কী এমন হয়

        একটু ভালোবাসলে কী এমন হয়!
               কী এমন সর্বনাশের আগুন জ্বলে!
                     এই আষাঢ় কিভাবে কেঁদে কেঁদে ফেরে
                               দেখেছো কখনো কষ্টের কেমন রঙ!

হিসেবের চারকোণ যে জীবন
মেঘনা যমুনা গড়াই মধুমতি স্রোতময়ী যে জীবন
কবিতার মতো লালটিপ স্বরবৃত্ত যে জীবন
সেখানেও থাকে দুঃখের গহীন-
চিত্তহরিণী পাপড়ির নিচে থাকে অদৃশ্য কষ্টের ভাঁজ

সেই বেদনায় ভালোবেসেছিলো রাধিকাও গোপন শিশিররাত্রি
লাবণ্যময়ী মাদাম বোভারি রোদলফকে বেঁধেছিলো
                                            গোপন তাবিজে

বৃক্ষশরীরে জড়িয়ে থাকে শরমহীন সোহাগিনী স্বর্ণলতা
অচিন পাখির মতো তুমি কেনো অধরা দূরের পাখি
একটু ভালোবাসলে কী এমন হয়!
    কী এমন সর্বনাশের আগুন জ্বলে!

হিসেবের চারকোণ ছিঁড়ে ফেলো দেবতী প্রেমের
 বেনারসি উড়ছে পাগলা হাওয়ায়
নকশি আঁচলে আঁকো নতুন যৌবন
তোমার সৌরভ উজ্জ্বলতা হীরক টুকরো রাশি রাশি
অদৃশ্য ঝড়ের মতো জেগে থাকে মাতাল মধ্যরাত
শুষ্ক ঠোঁট  কাঁপে যেনো ঢেউখেলা অসহ্য রোদ্দুর
বর্ষার অবাধ্য নতুন জলের মতো ছুটে আসো দীঘল চুম্বনে

একটু ভালোবাসলে কী এমন হয়!
            কী এমন সর্বনাশের আগুন জ্বলে!


দেবতীদেউল

পাপ বুঝিনা দেবতী
পুণ্যও চিনি না
তোমাকে চিনি
তোমাকে চাই
খরস্রোতা নদী যেভাবে সমুদ্র চায়।

অঙ্ক বুঝিনা দেবতী
পদ্যও বুঝি না
তামাকে বুঝি
তোমাকেই চাই
পদ্মা যেভাবে পাগলা ঢেউয়ে সবকিছু নিজের ক’রে চায়।

বাণিজ্য শিখিনি দেবতী
লাভ-লোকসান বুঝি না
তোমাকে বুঝি
তোমাকে চাই
স্বর্ণলতা যেভাবে মেঘের মতো ঢেকে রাখতে চায় বৃক্ষশরীর।

বন্দিত্ব জানিনা দেবতী
মুক্তিও বুঝি না
জীবনসত্য তুমি
তোমাকে চাই
বন্যার জলে মিশে যেভাবে উর্বরতা বোনে বন্ধ্যাভূমিতে।

তুমি কার-কার ছিলে কবে
কার আছো এখন
বুঝি না হিসেবের কড়ি
চাই তোমাকে প্রবল
কবিতা-গহীনে যেভাবে জেগে ওঠে কাঁচা চরের মতো নতুন কবিতা।

পাপ বুঝিনা দেবতী
পুণ্যও চিনি না
স্বর্গ-নরক বুঝি না
তোমাকেই চাই
জীবন উৎসবে যেভাবে জেগে ওঠে যুবতীজমিন।

তুমি কী নিজেই কবিতা

ভুল অভিমান কবিতা হয়ে রোদ্দরু বোনে রাতের গহিনে
অভিমান কী তবে ভুলের কবিতা- ফেরার ব্যাকুলতা!
শব্দে শব্দে তাকে নির্মাণ করি পাড়সাদের মতো।

একদিন এই শহরে পাগলা ঝড় উঠেছিল
আমার উঠতি যৌবনে গড়াই নদীর অপ্রতিরোধ্য প্রমত্ত ঢেউ
কী ভীষণ বেদনায় আছড়ে পড়তো-

তুমি শাণিত চোখে ভেসেছিলে ঢেউয়ের ফণায়
শ্যামলা চেহারা -লাউডগার মতো সতেজ সুন্দর
কী আশ্চর্য রোদমাখা হাসি ছড়িয়ে থাকতে চোখের জাঙলায়

তুমি কেমন আছো-কোথায় থাকো-এখনো কী বেণি করো
কুষ্টিয়া শহরের সব পথে পথে ছড়ানো কবিতার মতো;
অথচ তুমি কবিতা ভালোবাসতে কিনা আজো জানি না।

তুমি অভিমান করেছিলে কিনা জানি না
নাকি আমিই অভিমানে চলে এসেছি একজীবন দূরত্বে
আমার কবিতা কী অভিমানের নিশিফুল বিনিদ্র হাসনাহেনা!

তোমাকে খুব চুমু খেতে ইচ্ছে করেছিলো-
গড়াই নদীটি যেভাবে আলতো স্পর্শে খুব যত্ন করে
রমণীশরীরের মতো কয়া বাজারের ঘাটকে চুমু খেতে চেয়েছিল।

মনে আছে তোমার! তুমি সন্ধ্যাকে আলোর উৎসব করে
পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে ফুটে উঠেছিলে মুগ্ধতার সবটুকু হয়ে
আর কখনো কী চোখের গহিনে লিখেছো নতুন চোখের তৃষ্ণা!

তোমাকে এখনো দেখতে ইচ্ছে করে বর্ষায় ভরা গৌরিপাড়ে 
তোমার বাড়ির পথের পথটি মরে গেছে সেই কবে
অভিমানের কাফনে কবিতা জন্মই-তুমি কী নিজেই কবিতা! 

সুরহীন একতারা

আমার মৃতচোখ মাটিপোকার ঘর হবে
বরফঠাণ্ডা ঠোঁটে চুমু খাবে সর্পিনীা;
তোমার তিমির অভিমান 
          ফুটে থাকবে রূপশ্রী নগরে।

শরীর মিশে যাবে মাটিঘরে-
পাবে না অভিমানের চিরকুট-
             ভালো থেকো তুমি-

আমাকে ভেবো না-
‘বিষলক্ষ্মা তীরে’ বিদ্ধ করো সবুজজমিন
পান করে নেবো সরল বিশ্বাস
আমারও যে কামরাঙা ঠোঁট ছিলো-
বিবর্ণ দুপুর জানেনি সে কথা।

চলে যাবো মৃত্তিকারমণী 
কীভাবে ছোঁবে উজানতরীর বাদামী বৈঠায়;
জীবননগর ভাঙা আলপথ-সুরহীন একতারা। 

৪.
নতুনকে গ্রহণে অনেক সমস্যা থাকে। সহজে কেউ মেনে নিতে চান না। তাতে কর্ণপাত করার প্রয়োজনও অনুভব করিনি। যেমন কিছুদিন আগে আমি একটা কবিতা লিখেছি ‘টালা সুখ’। প্রত্যন্ত গ্রামীণ এক নারী যখন তার প্রিয়জনকে বহু বছর পরে হঠাৎ দেখে সারামুখে আনন্দ উচ্ছ্বাস ফুটিয়ে বলে ‘তোমাকে দেখে আমার জানটা টালা হয়্যা গ্যালো’। ‘টালা’টা তখন বহু বর্ণিল সুখ ও শান্তির সমার্থক শব্দ হয়ে ওঠে। আবার যখন বলি ‘পাকা কুঁচফলের মতো যৌবনাস্তন’-এটাও কিন্তু অব্যবহৃত। আমি কবিতায় এরকম অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করতে পছন্দ করি। সুষম ও নির্বাচিত শব্দ ব্যবহারে আমার ঝোঁক বেশি। যেমন পাটকাঠির লাউজাংলা, সিঁধেল চোর, ঘরের পোটনি, মাজিভাই, দুঃখিনী গড়াই, কচুরিপাতার মতো টানা টানা চোখের বউটি, স্যাঁতস্যাঁতে মাটির উঠোন, কিশোরিকা চাঁদ, কুঁচি দিয়ে পরা সাদাকালো শাড়ি, গরিবানা বালিশ, বিষণ্ন মেঘ, নদীর চরে বালির মেদ -আবহমান গ্রামবাংলা থেকে কুড়ানো শব্দের যেমন প্রচুর ব্যবহার আছে, তেমনি শহরের পোর্স্টমর্টেম, হেরিটেজ, লেটেস্ট মডেলের মুঠোফোন, পোস্টার প্রিন্সবাজার, অ্যাকুরিয়াম, ফ্রেমবন্দি প্রভৃতি শব্দ। আমি চাই কবিতায়  ব্যঞ্জনা থেকে ব্যঞ্জনাতীত ধ্বনিকুঞ্জ তৈরি করতে। কবিতার ফর্ম ব্যবহারে মুক্তদৃষ্টির পথিক আমি। রবীন্দ্রনাথের শ্যামলী, পত্রপুট ও পুনশ্চ মুক্তফর্মে লেখা। সমর সেন ও দাউদ হায়দার এ ফর্মের কবি। গতানুগতিকতাকেই সবাই গ্রহণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। একজন কবির কাজই তো হলো গতানুগতিক থেকে বের হয়ে এসে নতুন বার্তা শোনানো। সময়ের প্রবল স্রোতের তোড়ে গতানুগতিকবৃত্ত ভেঙে নতুন আসে- এই আসাটা অনিবার্য- এটাই কবিতার শক্তি। সেই চেষ্টাটা সবারই থাকে-আমি ব্যক্তিগতভাবে তা মনে করি। কেউ হয়তো পারেন, কেউ পারেন না। যিনি পারেন সমকালে তাকে প্রশংসার চেয়ে তিরস্কারই বেশি পেতে হয়। এটা সবকালেই ছিলো। এখনো আছে। সবকালেই নতুনকে কেউ সহজে গ্রহণ করতে চান নি। সে দেশে হোক আর বিদেশে হোক। সব দেশের কবির ক্ষেত্রেই একই রকম নিয়তি বহন করে। বোদলেয়ার, ব্লেক, র্যাঁবোও-র মতো বিখ্যাত কবিরাও এ-থেকে মুক্তি পান নি। আমাদের মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দ সব বড় কবিকেও এই যন্ত্রণাকে কম-বেশি সহ্য করতে হয়েছে।কবিতায় নতুনকে ধারণ করার একটা শক্তি ও সাহস থাকতে হয়। সময়ের সস্তাস্রোতে সাময়িক প্রশংসা পেলেও, কালের যাত্রায় তা স্থায়ী হয় না। কবিতায় জোর করে জটিল ও দূরূহভাব তৈরি করা আমার কাছে ভালো লাগে না। কবিতা পণ্ডিতি করার জায়গা নয়। এসব থেকে কবিতার মুক্তি ঘটে গেছে বহু আগেই। রবীন্দ্রবৃত্ত ভাঙতে ত্রিশে কবিতায় যে দূরূহতা তৈরি হয়েছিল, সে-বৃত্তও একসময় ভেঙে গেছে। নতুন ধারা নতুন বিষয় কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। এই যে নতুন ধারা বলছি-এর ভেতরেও আবার নানামাত্রিক বাঁক আছে-কবিতা প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল-নতুন রূপে নতুন রঙে-এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই।  
আমার কবিতায় দৈনন্দিন জীবন বাস্তবতা-দুঃখ-কষ্ট বেশি আছে। প্রতিদিন যে জীবন দেখি, যে সমাজ দেখি-দেশের যে দুঃখময় করুণ ছবি দেখি-তাকেই কবিতা করে তুলতে চেষ্টা করি। চেতনায় অন্তঃর্জগতে থাকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম-ইতিহাস-ঐতিহ্য। 

৫.
প্রথমে যে কথা বলছিলাম, আমার কবিতা আমার আত্মা-আমার সত্তা-হয়তো আমিই। এই দেশ-দেশের মাটি-মানুষ আমার প্রেম সবই তো আমার আত্মা-আমার সত্তায় গ্রোথিত। এসব বাদ দিয়ে তো আমি কেউ নই- আমি তো আমাকে দেখি না। এসবই বিশেষ ভাষা, শিল্প-শৈলী ও প্রতিকীতে আমার কবিতা হয়ে ওঠে। আর এ কবিতার ভেতরেই আমি আমাকে দেখি। আমার কবিতা ক্ষতবিক্ষত-আহাজারি-আর্তনাদের অসহ্যনীয় ছবি, কখনো আবার সুরেলা নদী, পাখির গান, সবুজের ফসলের মাঠ, আমার প্রেম-বিরহ-আনন্দ-বেদনা। আসলে কবিতায় ‘আমি’একটি সত্তা-যে নিজের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত বোঝাপপোড়া করে-করতে থাকে-এই বোঝাপোড়ার ভেতর দিয়েই কবিতা ব্যক্তিক থেকে সার্বজনীন হয়ে ওঠে। আমার কবিতায় সে চেষ্টাটাই থাকে।
(ড. রকিবুল হাসান। কবি-কথাসাহিত্যিক-গবেষক। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ)

এসি