ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

বঙ্গবন্ধুর বিজয়ের মশাল নিয়ে এগিয়ে যাবে দেশ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:২৬ পিএম, ১১ জানুয়ারি ২০২০ শনিবার | আপডেট: ১০:৪৯ এএম, ১৪ জানুয়ারি ২০২০ মঙ্গলবার

শুক্রবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের ক্ষণগণনা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী- পিআইডি

শুক্রবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের ক্ষণগণনা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী- পিআইডি

দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রামের পর স্বাধীনতার মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বিজয়ের মশাল উপহার দিয়েছেন, তা নিয়েই এগিয়ে যেতে চায় সরকার। এ মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবাষির্কী উপলক্ষে বছরব্যাপী মুজিববর্ষ উদযাপনের জন্য ক্ষণগণনার উদ্বোধন করে এ কথা বলেন তিনি। রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে শুক্রবার বিকেলে ক্ষণগণনার উদ্বোধন করেন তিনি। 

ক্ষণগণনা উপলক্ষে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা ও ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। সেদিন পকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসার সময় বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। 

অনুষ্ঠানে ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অংশ নেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, একাধিক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাসহ হাজার দুয়েক অতিথি এবং ১০ হাজার দর্শক। ছিলেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা।

বাংলাদেশ স্বাধীনের পর করাচির কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন বিকেলে তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দরে নামেন স্বাধীন দেশের রূপকার। তাই ঐতিহাসিক এদিনটিকেই বেছে নেয়া হয় জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনার দিন হিসেবে। 

বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জনগণ জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বে মযার্দার আসনে অধিষ্ঠিত করবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের হাতে বিজয়ের যে মশাল তুলে দিয়েছেন, এখন এই বিজয় নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করে বলেন, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর  বিজয়ের থেকে জাতি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল। সেদিন তার মা বেগম মুজিব, ছোট বোন এবং তিনি নিজে তাঁদের বাসায় বসে ঐতিহাসিক মুহূর্তটির ধারাবিবরণী রেডিওতে শুনছিলেন। কারণ, তারা সে সময় তার ছেলে জয়  ছোট ছিল এবং ছোট ভাই রাসেলকে রেখে কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। যেদিন বাঙালি ফিরে পায় সেই মহান নেতাকে যিনি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য সারাটা জীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

শেখ হাসিান ৭২’র ১০ জানুয়ারির স্মৃতিচারণ করে বলেন, লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল এখানে। স্বজন হারা বেদনার্ত আহত-নির্যাতিত মানুষ তাদের মহান নেতাকে ফিরে পেয়ে তাঁদের জীবনে যেন পূর্ণতা পেয়েছিলেন। হারাবার বেদনা যেন তারা ভুলতে চেয়েছিলেন তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তানীরা বাধ্য হয়েছিল জাতির পিতাকে মুক্তি দিতে। কারণ প্রায় প্রতিটি দেশের জনগণই বাংলার মুক্তিকামী জনগণের পাশে ছিল। তিনি আরও বলেন, ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে পরিবারের কথা না ভেবে জাতির পিতা চলে গিয়েছিলেন রেসকোর্সের ময়দানে, তাঁর প্রিয় জনগণের কাছে। 

শেখ হাসিনা বলেন, বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারতসহ যে সব দেশ মহান মুক্তিযুদ্ধে সব ধরনের সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়ায়, শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়,  মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে এবং জাতিসংঘে যারা এ দেশকে সমর্থন করে, সেইসব দেশের সকল জনগণের প্রতি প্রধানমন্ত্রী তাঁর শ্রদ্ধা জানান। 

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি, তাঁকে জীবন দিতে হয় বাংলার মাটিতে।

জাতির পিতা হত্যাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে বাঙালির জীবনে যে কালো অধ্যায় নেমে এসেছিল তা যেন আর কোনোদিন আসতে না পারে সেজন্য সবাইকে সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আজ মানুষকে উজ্জীবিত করা আড়াই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে অন্যতম হিসেবে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান করে নিয়েছে। আজ সে অন্ধকার সময় কাটিয়ে আলোর পথে যাত্রা করেছে বাংলাদেশ। বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষণগণনার শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। 

প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেয়ার পর মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচন ও ক্ষণগণনার উদ্বোধন করেন ল্যাপটপের বোতাম চেপে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে লোগো তুলে দেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।

বিকেল ৪টা ৩৭ মিনিটের দিকে বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ ‘সি-১৩০জে মডেলের’ উড়োজাহাজ প্রতীকী হিসেবে পুরানো বিমানবন্দরের (তৎকালীন তেজগাঁও বিমানবন্দর) রানওয়েতে অবতরণ করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি বিকালে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের এরকম একটি উড়োজাহাজে করেই এসেছিলেন জাতির পিতা।

বিমানটি ধীরে ধীরে এসে টারমাকে অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে এসে থামে। এ সময় বাজানো হয় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সেই গান- ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়’।

বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের দিন বাজানো সন্ধ্যা মুখার্জির গান -‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়, তুমি আর ঘরে ঘরে এত খুশি তাই,’ গানটি অনুষ্ঠানে বাজানো হয়। পাশাপাশি জনতার মধ্য থেকে জাতীয় পতাকা নেড়ে প্রতীকী বিমানকে স্বাগত জানানো হয়।

বিমানটি টারমাকে পৌঁছানোর পর দরজা খোলা হলে ২১ বার তোপধ্বনি দেয়া হয়। ‘জয়বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে চারিদিক। লেজার লাইটের মাধ্যমে বিমানের দরজার ফুটিয়ে তোলা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে সেই আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে লাল গালিচার মাথায় ছোট্ট মঞ্চে এসে থেমে যায়। এরপর গার্ড অব অনারের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। বঙ্গবন্ধু যে আলোকবর্তিকা হয়ে সেদিন দেশে ফিরেছিলেন, তারই প্রতীকী উপস্থাপনা ছিল এ আয়োজন।

এই আয়োজনে প্রতীকী বিমান অবতরণ ছাড়াও রয়েছে আলোক প্রক্ষেপণে বঙ্গবন্ধুর অবয়ব তুলে ধরা, ২১ বার তোপধ্বনি ও সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর চৌকশ দলের গার্ড অব অনার প্রদান। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে যেভাবে এদেশের সংগ্রামী জনতা বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নিয়েছিল, প্রতীকীভাবে সেই ক্ষণটিও ফুটিয়ে তোলা হয়, ওড়ানো হয় এক হাজার লাল-সবুজ বেলুন এবং অবমুক্ত করা হয় একশ’টি সাদা পায়রা।

প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের পর প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও জনপরিসরে ক্ষণগণনা শুরু হয়। দেশের ৫৩ জেলা, দুটি উপজেলা, ১২টি সিটি করপোরেশনের ২৮টি পয়েন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর ৮৩টি পয়েন্টে কাউন্টডাউন ঘড়ি বসানো হয়েছে।

জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ পর্যন্ত ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর আগ পর্যন্ত এই ক্ষণগণনা চলবে।

বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো ও ‘মুজিব বর্ষ’ উদযাপন করবে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত এর ৪০ তম সাধারণ পরিষদের সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো বর্ষব্যাপী এই উদযাপনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

বিশ্বের অনেক নেতা ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দেবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ওআইসি মহাসচিব ড. ইউসেফ এ আল-ওথাইমিন, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী, ভারতের কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি সোনিয়া গান্ধী, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, আবুধাবির যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান-কি-মুন, ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক এবং ইউনেস্কোর সাবেক মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভো জন্মশতবাষির্কীর অনুষ্ঠানে থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

বিদেশে বাংলাদেশের ৭৭টি মিশন ২৬১টি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকার মুজিব বর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিটি এবং একটি জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেছে। উদযাপন কমিটি দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রস্তাবিত ২৯৯টির বেশি কর্মসূচির প্রস্তাব বাছাই করেছে যা বছরব্যাপী উদযাপন করা হবে।