ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

হাজার প্রাণীর জীবন বাঁচিয়েছেন টায়ার মিস্ত্রি!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:৪৮ পিএম, ১১ জানুয়ারি ২০২০ শনিবার

প্রাণীদের ভালবাসেন এমন অনেক মানুষ আছেন। কিন্তু আহত প্রাণীদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে এবং নিজের কাছে রেখে যত্ন-আত্তি করে শুশ্রূষা দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর মতো মানুষ খুব কমই আছে। এ রকম একটি নয় হাজারেরও বেশি প্রাণীর জীবন বাঁচিয়েছেন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাজস্থানের টায়ার সারানোর মিস্ত্রি পীরারাম বিষ্ণোই।

পশ্চিম রাজস্থানের খুবই নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া পীরারাম শুধু গাড়ির টায়ারই নয়, জীবনও বাঁচান। ৬৫ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে ছোট একটা দোকান চালান পীরারাম বিষ্ণোই। মূলত গাড়ির টায়ার সারান তিনি। সারাদিনে যা উপার্জন হয়, খাওয়ার খরচেই তার সবটা লেগে যায়। 

তাঁর বাড়ির একদিকে ভারতের গুজরাট আর একদিকে পাকিস্তানের সীমানা। এই এলাকার পাশেই ছিল ঘন জঙ্গল। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে মাঠে চাষাবাদের কাজ করতেন পীরারাম। মাঝে মধ্যেই সেই জঙ্গল থেকে ময়ূর, খরগোশ, হরিণ বেরিয়ে চাষের জমিতে চলে আসত। কখনও ফসল নষ্ট করত, আবার কখনও জমিতে খেলা করে বেড়াত।

পীরারাম খুব অবাক হয়ে দেখতেন, ফসল নষ্ট করলেও তাঁর বাবা কখনও সেই সব প্রাণীদের তাড়িয়ে দিতেন না। বাবা তাকে বলতেন, এই প্রাণীগুলো না থাকলে মানুষও বাঁচতে পারবে না।

এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। ৬৫ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে টায়ার মেরামতির একটি দোকান খুলেন পীরারাম। এখানে এক গাড়ি চালকের কাছে জানতে পারেন, মাঝেমধ্যেই রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় অনেক বন্যপ্রাণীদের। সে দিনই প্রথম নিজেকে অসহায় লেগেছিল পীরারামের। তাঁর একার পক্ষে কী ভাবে এই বন্য প্রাণীগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। 

এ রকমই একদিন বাড়ি থেকে দোকানে যাওয়ার সময় তাঁর সামনেই মোটরবাইকের সঙ্গে একটি হরিণের দুর্ঘটনা ঘটে। পীরারামের ব্যথিত হৃদয় তা চোখের সামনে দেখতে পারছিল না কোনক্রমেই। হরিণটিকে কোলে তুলে নিয়ে একটি গাড়ি থামিয়ে তিনি পশু চিকিৎসালয়ে নিয়ে যান। নিজে সমস্ত খরচ চালান। তারপর বাড়িতে নিয়ে এসে হরিণটিকে নিজের হাতে খাওয়ানো থেকে যত্ন-আত্তি সবই করতে থাকেন।

এরপর থেকে যখনই কোনও আহত পশুর কথা শুনতেন বা দেখতেন, তাকে নিজের বাড়িতে এনে চিকিত্সা করতেন পীরারাম। তাঁর পরিবারও তাঁকে সাহায্য করতেন এই কাজে।

২০১২ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের দিন তিনি একটি সংগঠন তৈরি করেন। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন আরও কয়েক জন সমাজকর্মী। তাঁকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর এবং আশেপাশের গ্রামের লোকেরাও অসুস্থ বা জখম প্রাণী দেখলেই তাঁর কাছে নিয়ে আসতে শুরু করেন।

তবে এরমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে বন্যপ্রাণী ঘরে রাখার অভিযোগ জমা পড়ে। পর দিনই বন দফতরের লোকেরা তাঁর বাড়িতে এসে হাজির। পীরারাম ভাবছিলেন তাঁকে হয়তো গ্রেফতার করার জন্যই এরা এসেছে। কিন্তু বন্যপ্রাণীদের প্রতি তাঁর এবং তাঁর পরিবারের ভালবাসা দেখে বনবিভাগের অফিসাররা পীরারামকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। 

সরকারি একটি জমি পীরারামকে বরাদ্দ দেন তাঁরা। ওই অঞ্চলের রক্ষী করে দেওয়া হয় তাঁকে। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ১৮০টি প্রাণীর জীবন বাঁচিয়েছেন তিনি। আর বরাদ্দ পাওয়া আড়াই হেক্টর এলাকা জুড়ে বন্যপ্রাণীদের জন্য আশ্রয় গড়ে তোলেন পীরারাম। বর্তমানে সেখানে প্রায় চারশ’ আহত প্রাণী রয়েছে। বাকিদের সুস্থ করে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন।

আগে এই কাজটি পীরারাম একাই করতেন। এখন তাঁর পাশে রয়েছে প্রায় দু’হাজার মানুষ। বন্যপ্রাণীদের জন্য গড়ে তোলা এই ফার্মের দেখাশোনা করা, পশু পাচার বন্ধের নানা কাজকর্মে লিপ্ত তাঁরা। প্রতি মাসে ফার্ম চালাতে তাদের খরচ হয় এক লাখ টাকা। সরকারি এবং বিভিন্ন সংস্থা থেকে ইতিমধ্যে সাহায্য পেতে শুরু করেছে পীরারামের সংগঠনটি।

সূত্র: আনন্দবাজার

এএইচ/