ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ইরানের বিরোধী দলগুলো কতটা শক্তিশালী?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৪৯ পিএম, ১৬ জানুয়ারি ২০২০ বৃহস্পতিবার

ইউক্রেনের আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের একটি বিমানকে 'ভুল করে' ভূপাতিত করার কথা স্বীকার করার আগে ইরানের কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে 'মিথ্যে' বলায় তেহরান এবং অন্যান্য শহরগুলোতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে।

বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে দেশটির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শোনা যায়।

কিন্তু ইরানের ভেতরের এই সরকারবিরোধীতা কতটা প্রবল? কতটা শক্তিশালী সেখানকার বিরোধী দল? আন্দোলনকারীরাই বা কী চায়?

আন্দোলনকারীরা কাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে?

বিমান দুর্ঘটনায় আরোহীদের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ইরানের তেহরান শহর থেকে শুরু করে ইস্পাহানের মতো আরও কয়েকটি শহরে সাম্প্রতিক সময়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে সাধারণ মানুষ।

তাদের বেশিরভাগই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।

প্রথমেই প্রকৃত ঘটনার বিষয়ে সত্যি না বলার জন্য তারা কর্তৃপক্ষের নিন্দা করে। তবে আন্দোলনকারীরা দেশটির সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ খামেনি এবং ইসলামী শাসনের বিরুদ্ধেও স্লোগান দেয়।

কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বকে ঘিরে এই বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে, এমন কোন ইঙ্গিতও নেই।

পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানি অধ্যাপক ফাতেমেহ শামস বলছেন, ‘এটা বলা কঠিন যে, এখানে এমন কোন ব্যক্তি আছে, যাকে ঘিরে মানুষ এখন ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।’

কী ধরণের বিরোধী রাজনীতি ইরানে অনুমোদিত?

ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্বাচনের অনুমতি দেয়, তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের কঠোর সীমানার মধ্যেই কাজ করতে হয়।

২০১৬ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে, ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিল প্রায় অর্ধেক প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। ই

রানের ইসলামী ব্যবস্থার ব্যাপারে প্রার্থীরা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে কিনা সেটাই তদারকি করে এই গার্ডিয়ান কাউন্সিল বা অভিভাবক পরিষদ।

আর আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য হাজার হাজার সম্ভাব্য প্রার্থীকে আবারও অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, যার মধ্যে ৯০জন বর্তমান আইনপ্রনেতাও রয়েছেন।

ইসলামী প্রজাতন্ত্রবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর যে কোনও প্রার্থী, যারা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে পুরোপুরি পরিবর্তন করতে চান, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোন অনুমতি নেই।

গার্ডিয়ান কাউন্সিল যে কোনও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে এবং পার্লামেন্ট থেকে পাশ হওয়া যে কোনও আইনকে ইরানের সংবিধান এবং ইসলামী আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে না হলে তাতে ভেটো দিতে পারে।

ইরানের রাজনৈতিক কাঠামোর শীর্ষে থাকা আয়াতুল্লাহ খামেনি এই সংস্থার অর্ধেক সদস্য নিযুক্ত করেন।

এই সুপ্রিম লিডার সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা এবং প্রধান বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন।

সুতরাং বাস্তবে, ইরানের প্রেসিডেন্ট এবং পার্লামেন্ট - তারা পরিবর্তনের পক্ষে থাকলেও -তাদের ক্ষমতা সীমিত।

আবার ইরানের ভেতরে যে কুর্দি, আরব, বালুচিস এবং আজারবাইজানিদের মতো জাতিগত সংখ্যালঘুরা রয়েছেন, তাদের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতেও আন্দোলন হয়।

এসব বিরোধীদলের মধ্যে রয়েছে, ইরানিয়ান কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি- যারা একটি সশস্ত্র দল এবং যারা ইরান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে লড়াই করে আসছে।

বিরোধীদের কি নেতা আছে?

ইরানে বহু বছর ধরে একটি সংস্কারবাদী আন্দোলন চলছে, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামিকে এর প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসাবে দেখা গেছে।

১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন মিস্টার খাতামি কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে এসেছিলেন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন।

রক্ষণশীল স্বার্থরক্ষার কারণে আরও বড় ধরণের পরিবর্তনগুলো আটকে দেয়া হয় এবং মিস্টার খাতামির গতিবিধি ও গণমাধ্যমের সামনে তার হাজির হওয়া সীমিত করার মাধ্যমে তাকে কোণঠাসা করা হয়।

২০০৯ সালে, এক বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কট্টরপন্থী মাহমুদ আহমাদিনেজাদ জয়লাভের পরে দেশটির সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ আসে।

পরাজিত মীর হোসেইন মুসাভি এবং মেহেদী কারুবি ভোটের ওই ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ জানান এবং তারা গ্রিন মুভমেন্ট হিসাবে পরিচিতি একটি দলের নেতা হয়ে ওঠেন।

পুনরায় নির্বাচনের দাবীতে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, তবে আয়াতুল্লাহ খামেনি জোর দিয়ে বলেন নির্বাচনের এই ফল যথাযথ।

প্রতিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া

সে বছর বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক তাণ্ডব শুরু হয় এবং বেশ কয়েকজন বিরোধী সমর্থক নিহত হন বলে জানা যায়।

বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় অনেক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। মিস্টার মুসাভি এবং মিস্টার কারুবি এক দশক পরেও গৃহবন্দী রয়েছেন।

সাম্প্রতিককালে, অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি নিয়ে ২০১৭ সালের শেষে এবং ২০১৮ সালের শুরুতে বিক্ষোভ হয়।

দেশের কিছু অংশে বেকারত্বের মাত্রা বাড়তে থাকায় তরুণ জনগোষ্ঠী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও উদারপন্থী হিসাবে বিবেচিত প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সরকারের অর্থনীতি পরিচালনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যোগ দেয়।

যারা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল তারা দেশটির নেতাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়, এবং রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানায়, ১৯৭৯ সালে যার পতন হয়েছিল।

এই অস্থিরতার কারণে দেশটিতে রক্তাত্ব বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে যে, ওই সহিংসতায় ৩০৪ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, তবে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ১৫০০ জন বলে দাবি করা হয়।

ইরানী কর্তৃপক্ষ দুটি পরিসংখ্যান বাতিল করে দিয়েছে। দেশটিতে টানা পাঁচদিন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। এতে সারা দেশের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হল, এগুলো প্রায়ই নেতৃত্বহীন ছিল এবং মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং বৈষম্যকে আরও প্রশ্রয় দিয়ে তৃণমূলকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

তবে, তীব্র অস্থিরতা সত্ত্বেও, বিরোধীদের বিরুদ্ধে দমনমূলক পদক্ষেপ সেইসঙ্গে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের মধ্যে দিয়ে সরকার নিয়ন্ত্রণে থাকতে পেরেছে।

সূত্র: বিবিসি