ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

শেখ নিয়ামত আলীর অবিস্মরনীয় কীর্তি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:১৪ পিএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সোমবার

কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার শেখ নিয়ামত আলী

কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার শেখ নিয়ামত আলী

শেখ নিয়ামত আলী, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রাতঃস্মরনীয় একটি নাম। একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক। এদেশের সুস্থধারার চলচ্চিত্রে তার অবদান অবিস্মরনীয়। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার ছিলেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনবার শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। 

সত্তর দশকের শেষার্ধে তিনি চলচ্চিত্রকার মসিউদ্দীন শাকেরের সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেন সূর্যদীঘল বাড়ি। এছাড়াও তিনি নির্মাণ করেন দহন, অন্যজীবন, আমি নারী’র মতো সৃজনশীল চলচ্চিত্র। সূর্য দীঘল বাড়ি চলচ্চিত্রটি দেশে বিদেশে বিশেষভাবে প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত হয়। চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের সুস্থধারার চলচ্চিত্রের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। 

শেখ নিয়ামত আলী ১৯৪০ সালের ৩০ এপ্রিল ভারতের চব্বিশ পরগনায় (তৎকালীন) জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার পৈত্রিক নিবাস খুলনার বাগেরহাটে। ১৯৫৬ সালে তিনি কলকাতার দক্ষিণ গড়িয়া যদুনাথ বিদ্যা মন্দির থেকে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পাশ করেন। ১৯৬১ সালে নন কলেজিয়েট এক্সটার্নাল স্টুডেন্ট হিসেবে কলা বিভাগ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন এবং ১৯৬৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ পাশ করেন। 

ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়েই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। তিনি ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং তখন থেকেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ঢাকায় এসে যুক্ত হন বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন চলচ্চিত্র সংসদ ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদের’ সঙ্গে। স্বাধীন বাংলাদেশে পত্রপত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রচুর লেখালেখি করেন তিনি। 

১৯৭৯ সালে যৌথভাবে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সূর্য দীঘল বাড়ী (The Ominous House) ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। ছবিটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী। বিশিষ্ট গ্রন্থকার আবু ইসহাক-এর ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত (উপন্যাস) সূর্য দীঘল বাড়ি অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করা হয়। 

কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাককে আজকের দিনের পাঠকদের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তিনি অল্প লিখলেও, সে সব লেখা সুপরিচিত এবং পাঠকপ্রিয়। তিনি সর্বাধিক খ্যাতি পেয়েছেন তার সূর্য দীঘল বাড়ি উপন্যাসের জন্য। তবে এটা ছাড়াও তার আরও দুটি উপন্যাস আছে। তা হলো- পদ্মার পলিদ্বীপ (১৯৮৬) ও জাল (১৯৮৮)। 

সূর্য দীঘল বাড়িই বাংলাদেশের প্রথম সরকারী অনুদান প্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। সূর্য দীঘল বাড়ি ছবিটির যৌথ পরিচালক শেখ নিয়ামত আলী সর্বমহলের প্রশংসা কুড়িয়ে নেন এবং দেশ বিদেশে অনেক পুরস্কারে পুরস্কৃত হন। ছবিটি শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ মোট ছয়টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। ১৯৭৯ সালে সূর্য দীঘল বাড়ী ছবিটি বাংলাদেশ সিনে-জার্নাল এসোসিয়েসন-এর মোট ছয়টি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। 

আন্তর্জাতিকভাবেও সূর্য দীঘল বাড়ী ছবিটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। ১৯৮০ সালের ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসব, জার্মানিতে অংশগ্রহণ করে এবং তিনটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে এবং একই বছর পর্তুগালে ফিগুএরা দ্য ফোজ চলচ্চিত্র উৎসবে একটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। এছাড়াও ছবিটি ফিল্ম ডুকাট্ পুরস্কার, ডন কিজোট পুরস্কার, ক্যাথটিক জুরি পুরস্কার এবং এভান্গেলিক্যাল জুরি পুরস্কার লাভ করে।

সূর্য দীঘল বাড়ী’ছবির কাহিনী সংক্ষেপ-
বাংলা ১৩৫০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অবিভক্ত ভারতের বাংলায় ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে পঞ্চাশের আকাল নামে যে দুর্ভিক্ষ হযেছিল তাতে প্রাণ হারায় বহু লক্ষ দরিদ্র মানুষ। যারা কোনমতো শহরের লঙ্গরখানায় পাত পেতে বেঁচে থাকতে পেরেছিল তদেরই একজন আকালের সময় স্বামী পরিত্যক্তা জয়গুন। সঙ্গে তার মৃত প্রথম স্বামীর ঘরের ছেলে ও দ্বিতীয় স্বামীর ঘরের মেয়ে। আরো আছে মৃত ভাইদের স্ত্রী-পুত্র। তারা গ্রামে ফিরে এসে এমন একখণ্ড জমিতে ঘর ওঠায় যা অপয়া ভিটা বলে পরিচিত ছিল। জীবনের যুদ্ধে যখন সে প্রাণপণে লড়ছে তখন তার প্রতি দৃষ্টি পড়ে গাঁয়ের মোড়লের। দ্বিতীয় স্বামীও তাকে আবার ঘরে তুলতে চায়। সে কারো প্রস্তাবেই সায় দেয় না। কিন্তু এ দুজনের সাক্ষাৎ ঘটে এবং মোড়ল তার প্রতিযোগীকে হত্যা করে। ঘটনার একমাত্র দর্শক হিসেবে জয়গুনকেও মূল্য দিতে হয় অন্যভাবে। 

সূর্যদীঘল বাড়ীর কিহিনীর বিচিত্রতার মধ্যে মূল বিষয় একটিই; তা হচ্ছে কুসংস্কার, সম্পদ, ধর্ম, প্রতিপত্তি, সামাজিক বাধা-নিষেধ, এমনকি জাতীয়তাবোধ- এ সব কিছুকেই কাজে লাগিয়ে শ্রমজীবি ক্ষুধর্তো মানুষকে ক্রমাগত শোষণ। ছবিটির শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেন,ডলি আনোয়ার, জহিরুল হক, রওশন জামিল, আরিফুল হক, কেরামত মাওলা, এ টি এম শামসুজ্জামান, হাসান ইমাম, ফখরুল হাসান বৈরাগী, নাজমুল হুদা বাচ্চু, লেনিন, ইলোরা গহর প্রমুখ। সূর্য দীঘল বাড়ী ছবিটির সংগীত পরিচলনা করেছেন আলাউদ্দিন আলী।

শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি ‘দহন’। ১৯৮৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। সুস্থ্যধারার চলচ্চিত্র হিসেবে ছবিটি ব্যাপক প্রশংসা কুঁড়ায়। দহন এটিও একটি রাষ্ট্রীয় অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্র। মোহাম্মদ শামী নিবেদিত এই ছবিটির কাহিনী ও চিত্রনাট্য পরিচালনা করেছেন শেখ নিয়ামত আলী। পরিচালকের নিজ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শেখ নিয়ামত আলী প্রডাকশন্স এর ব্যানারে নির্মিণ করা হয় ছবিটি। 

ছবির প্রধান প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ, ববিতা ,হুমায়ুন ফরীদি, শর্মিলী আহমেদ, প্রবীর মিত্র, ডলি আনোয়ার, রওশন জামিল, আবুল খায়ের, সাইফুদ্দিন, আসাদুজ্জামান নূর ও সৈয়দ আহসান আলী। এছাড়াও বিভিন্ন চরিত্র অভিনয় করেছেন ফকরুল হাসান বৈরাগী, আশিষ কুমার লোহ, জহীর চৌধুরী, খায়রুল বাশার, হুমায়ুন খালেদ, মিনু রহমান সহ আরও অনেকে। ছবিটি তিনটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং দশটি বিভাগে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে।

১৯৮৫ সালে তার নিজের প্রযোজনা সংস্থা এস নিয়ামত আলী প্রডাকশন্স থেকে নির্মাণ করেন তার নিজের কাহিনী ও চিত্রনাট্যে দহন। এই চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের তিনটি বিভাগে ও বাচসাস পুরস্কারের দশটি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে।

দহন ছবির কাহিনী সংক্ষেপ-
ব্যক্তিগত প্রেমের চেয়ে সমষ্টিগত প্রেমই গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে। গল্পে আরো অনেক গুরুপ্তপূর্ণ বিষয় স্হান পেয়েছে যেমন- বাজেট নিয়ে আলোচনা, মানুষ নিয়ে রাজনীতি, শেরে বাংলা নগরে প্রেমাভিসার প্রভৃতি। গল্পে অর্থনৈতিক সামাজিক পুরানো পদ্ধতি ভাঙার সংগ্রামী প্রচেষ্টাকে তুলে ধরেছে, খুজেছে মুক্তির পথ। ফ্যাক্টস, ফিকশন, সিম্বল, হিওমার ব্যবহার করে কাহিনীতে সৃষ্টি করেছে একটি দলিলচিত্র। 

এছাড়া তার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র ‘অন্য জীবন’। ১৯৯৫ সালে তার নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকে নির্মাণ করেন এটি। চলচ্চিত্রটির সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন শেখ নিয়ামত আলী নিজেই। এস নিয়ামত আলী প্রোডাকশন্স প্রযোজিত চলচ্চিত্রটির অভিনয়শিল্পীরা হলেন- রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা, আবুল খায়ের, শান্তা ইসলাম, সাইফুদ্দিন ও আরও অনেকে। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের এগারটি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে।

শেখ নিয়ামত আলী ‘জন পরিবহন’ নামেও একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়াও তিনি শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘রানী খালের সাঁকো’ ও ১৯৯৬ সালে ‘আমি নারী’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরী করেন। 

চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য দেশী বিদেশী প্রায় ৬০টি পুরস্কার অর্জন করার সৌভাগ্য লাভ করেন শেখ নিয়ামত আলী। এছাড়া তিনি নাটকও পরিচালনা করেছেন। ১৯৯৬ সালে বিটিভির জন্য নির্মাণ করেছিলেন দিলারা ডলি রচিত ‘শেষ দেখা শেষ নয়’ নাটকটি।

বাংলাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার শেখ নিয়ামত আলী ২০০৩ সালের ২৪ নভেম্বর রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন।

এনএস/