ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

আরবি হরফে বাংলা লেখা চালুর উদ্দেশ্য কী ছিল?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:০১ এএম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০১:০৪ পিএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বুধবার

এতদিন পর এ প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে না নেওয়ার পক্ষে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের কী যুক্তি ছিল? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা, দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা পাঞ্জাবি হওয়ার পরও কেন পূর্ব বাংলায় ভাষার দাবিতে তীব্র আন্দোলনের মুখেও তত্কালীন সরকার এত কঠোর অবস্থান নিয়েছিল? ‘বেধর্মীদের চক্রান্ত’ বা ‘ভারতীয় চরদের ষড়যন্ত্র’—এসব বলাটা যে ছিল রাজনীতির মারপ্যাঁচ, এটা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।

ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি দেশের ভাগ হওয়া, সেই সময়ের রাজনীতির তুমুল আলোড়নের মধ্যে পাক খেতে থাকা জনগণকে বিচিত্রমুখী করে তুলেছিল। এ কথা সত্যি, আরবি হরফের প্রতি মুসলমানমাত্রেই দুর্বলতা রয়েছে। তা ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাস থেকেই। বাঙালির সাংস্কৃতিক দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকার পরও বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দু না বাংলা, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পত্র-পত্রিকায় বাঙালি মুসলমান লেখকেরা এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছেন। আরবি হরফে বাংলা লেখার দাবি তখন জোরালো হয়ে উঠেছিল।

পাকিস্তান আমলে এসে আরবি হরফ প্রবর্তনের পক্ষে একদিকে ছিল ধর্মীয় আবেগ, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সংহতির যুক্তি। বলা হচ্ছিল, উর্দু ছাড়াও পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি ভাষায় আরবি হরফ যেহেতু ব্যবহূত হচ্ছে—এখন বাংলায় এই হরফের প্রবর্তন করলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক সংহতি দৃঢ় হবে। তবে এটা বুঝতে কষ্ট হয় না, এসব কথার আড়ালে ধর্মীয় আবেগের চেয়ে রাজনৈতিক কারসাজিই ছিল বেশি। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি পূর্ব বাংলার শিক্ষাবিদদের সহযোগিতা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

১৯৪৮ সালে ফজলুর রহমান এ কাজে সহযোগিতার জন্য সৈয়দ আলী আহসানকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে বলেন। সৈয়দ আলী আহসান বলেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। ফজলুর রহমানের নির্দেশে তত্কালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মাহমুদ হাসান চিঠি দেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহেক। চিঠিতে উল্লেখ ছিল, ‘সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন পাকিস্তানকে ইসলামি মতে গঠন করতে এবং সেই উদ্দেশ্যে তারা বাংলা ভাষায় উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করতে চান। এর জন্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সাহায্য পেলে সরকার উপকৃত হবে।’

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এ চিঠির উত্তর না দিয়ে তার ভাবনার কথা লিখে সংবাদপত্রে পাঠান, যা কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৪৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে এক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে মাহমুদ হাসানের দেখা হলে মাহমুদ হাসান তার এ কাজের জন্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহেক দেশদ্রোহী বলে উল্লেখ করেন।

১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এলেও পাকিস্তান সরকারের আরবি হরফ প্রচলনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে।

১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা এক সভায় আরবি হরফ প্রচলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। এতে সভাপতিত্ব করেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। এ সভায় বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি সংসদ গঠন করা হয়। মো. নুরুল ইসলাম সভাপতি এবং ইলা দাশগুপ্তা ও আশরাফ সিদ্দিকী যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এছাড়া নজরুল ইসলাম, মমতাজ বেগম, রিজিয়া খাতুন, খলিলুর রহমানসহ অন্যদের নিয়ে বর্ণমালা সাব-কমিটি গঠিত হয়।

এদিকে এর প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ ছাত্র ফেডারেশন বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিল পরিষদ ভবনের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয় এবং আফজল হোসেন, মৃণালকান্তি বাড়রী, বাহাউদ্দীন চৌধুরী, ইকবাল আনসারী খান, আবদুস সালাম এবং এ কে এম মনিরুজ্জামান চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে। এদের জামিন না দিয়ে বন্দি রাখা হয়।

১৯৪৯ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভাষা কমিটির পক্ষ থেকে নঈমুদ্দিন আহমদ সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত লোকের হার শতকরা ১২ থেকে ১৫ জন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষিত লোকের হার শতকরা ৫ জনের কম; আরবি বর্ণমালার দোহাই দিয়ে এই ১৫ জন শিক্ষিতকে কলমের এক খোঁচায় অশিক্ষিতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। এর ফলে গোটা পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থাই বানচাল হয়ে যাবে।’

বাস্তবে ঘটছিলও তাই। পাকিস্তানের রাজধানী হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত সবই পশ্চিমাঞ্চলকে ঘিরে বেড়ে উঠছিল। শিল্পায়ন, আমদানি, বিদেশি সাহায্য কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল পশ্চিমে। পূর্ব বাংলা যে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হয়ে উঠছে, সেই বোধও গ্রাস করছিল এ অঞ্চলের মানুষদের। বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে এই বোধও গ্রাস করছিল এ অঞ্চলের অধিবাসীদের। এই বোধ থেকেই পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষ ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার প্রেরণা পেয়েছিল এই বোধ থেকেই।